বাংলাদেশ যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করেছে। ফলে আমাদের মাঝে রক্ত গরমের একটা ভাব আছে। অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে বুক টান করে দাঁড়ানোর হিম্মত ঐতিহাসিকভাবে আমাদের রক্তের শিরায় শিরায় মিশে গেছে। জালিমের জুলুম রুখতে রাজপথে আন্দোলন করা আমাদের জন্য মামুলি বিষয়। অধিকার আদায়ের আন্দোলন হলে তো কথাই নেই, আমরা হুমড়ি খেয়ে রাজপথে নামতে পারি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এই যে রাজপথে নামার দৃঢ় মনোবল এবং চেতনা, তা আমরা ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে অর্জন করেছি। এখন আবার ২৪-এর ছাত্র-জনতার জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের বিপ্লবী চেতনাকে পুনর্জাগরণ করেছে। যদিও বিগত ১৬ বছরের দমন-পীড়নের স্বৈরশাসনের কবলে পড়ে আমাদের বিপ্লবী চেতনায় কিছুটা ভাটা পড়েছিল। আবার জুলাই গণঅভ্যুত্থান সে ভাটাকে জোয়ারে পরিণত করেছে। এই জুলাই গণঅভ্যুত্থান বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বিপ্লবী চেতনাকে যেমন নাড়িয়ে দিয়েছে তেমনি আরেকটি টগবগে নতুন বিপ্লবী প্রজন্মের উত্থান ঘটিয়েছে। অবশ্য বিগত আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসই এই প্রজন্মের বিপ্লবী চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছে।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, এযাবৎকালের সফল আন্দোলন-সংগ্রামের সুফল মীরজাফর চরিত্রের রাজনীতিকরা জনগণকে ভোগ করতে দেয়নি। প্রতিটা গণআন্দোলনের ফসল ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং দলগত স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করে ভোগ-বিলাসের রাজনীতি করেছে। জনগণ রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছে আর রাজনৈতিক দল ক্ষমতার আসনে বসে আবার গণমানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষাকে উপেক্ষা করে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছে। স্বাধীনতা, জনগণের অধিকার, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ৭১-এ যে মুক্তিযুদ্ধ করা হলো সে মুক্তিযুদ্ধের পরই দমন-পীড়নের রাজনীতি, বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, অপশাসন, দুর্নীতির, অন্যায়-অত্যাচারে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করা হয়েছিল। এমনকি কৃত্রিমভাবে দেশকে দুর্ভিক্ষে পরিণত করা হয়েছিল। স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে এই দেশ ও জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করার যে সুযোগ হয়েছিল, তা স্বার্থান্বেষী, ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের কারণে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এদেশ ও মানুষ বর্বর পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্তি লাভ করলেও আমাদের দেশে জন্ম নেওয়া আয়ুবখানী শাবকদের হাত থেকে মুক্তি লাভ করতে পারছে না। জনগণের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় বসেও স্বৈরশাসক আয়ুব খানের রূপধারণ করে। শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণে যুগের পর যুগ এই দেশের জনগণের বিপ্লব বেহাত হচ্ছে।
এবার ২৪-এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান বেহাত হয় কি না, তা দেখার পালা। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পরে এই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর গণঅভ্যুত্থান হলো এই ২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থান। পলাতক স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার ছাত্র-জনতার ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক রাজপথের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী এবং পুলিশের দ্বারা নির্মম গণহত্যা চালায়। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই গণহত্যায় শিশুসহ ১৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। যদিও সরকারি গেজেট অনুযায়ী শহীদের সংখ্যা ৮৩৪ জন। আহত হয়েছে প্রায় ১৫ হাজারেরও অধিক। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ১৩২ জন শিশু-কিশোর এবং ১১ জন নারী শহিদ হয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আহতদের মধ্যে চোখ হারিয়েছে ৭০০ জন্য। এর মধ্যে এক চোখ ২১ জন এবং দুই চোখ হারিয়েছেন সাড়ে চারশোর মতো। এই নির্মম গণহত্যা চালিয়েও স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার জণগণের আন্দোলনের তোপের মুখে পড়ে প্রাণ বাঁচাতে এদেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়। বিগত ১৬ বছরে তার অতিরঞ্জিত স্বৈরাচারী অপশাসনে ধৈর্যহারা হয়ে জনগণ তাকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করতে বাধ্য হয়। পরক্ষণেই রাজপথের বিপ্লবী ছাত্রনেতাদের অনুরোধে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেয় বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফলে নির্যাতিত, নিপীড়িত, অধিকারবঞ্চিত জনগণ আবার দেশকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু আশার গুড়ে বালিই যেন এই দেশ ও মানুষের প্রাপ্য অধিকার! নির্মম গণহত্যার স্বীকার হয়েও এদেশের কতিপয় গোষ্ঠী, দুর্নীতিবাজ আমলা-কামলা, ছাপড়ি রাজনীতিবিদ, ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলের শুভবুদ্ধি উদয় হয়নি। নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক দলগুলো মানুষর দুর্ভোগের কথা চিন্তা না করে প্রায় প্রতিদিন উদ্ভট সব দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের নামে রাস্তা ব্লক করছে। দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে গত ৯ মাসে প্রায় পাঁচ শতাধিক আন্দোলন হয়ছে। একাধিক সড়ক অবরোধ করে গত ১০ দিনে ৫০টিরও অধিক আন্দোলন হয়েছে রাজধানীতে। এমনকি নেতার অবৈধ অধিকার আদায়ে নেতার মদদে নেতার আবেগী সমর্থকরা টানা কয়েকদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। আশ্চর্যের বিষয় হল, এই অবৈধ অধিকারকে আদালতপাড়া আবার বৈধ ঘোষণা করেছে! কতিপয় রাজনীতিবিদ দেশের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে ক্ষমতা দখলের তাড়নায় সভা-সমাবেশে, মিডিয়া-টকশোতে বেফাঁস বকে যাচ্ছেন। আর রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে, রাষ্ট্রের ভঙ্গুর কাঠামো সংস্কার ছাড়াই দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে এবং নিজেদের সাথে কামড়াকামড়ি করছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অংশীদারদের মাঝে কামড়াকামড়ির সুযোগে গণহত্যায় জড়িত আওয়ামী সন্ত্রাসীরা দেশ থেকে সহিসালামতে পালিয়ে যাচ্ছে, দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। কতিপয় গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অসহযোগিতার কারণে সরকার না পারছে সংস্কার করতে, না পারছে গণহত্যার বিচার করতে। আমরা নিজেদের স্বার্থে বিগত আন্দোলন-সংগ্রামের মতো এই ২৪-এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকেও ব্যর্থ হতে দিচ্ছি। অথচ এই সুবর্ণ সুযোগে আমরা চাইলেই শুধু বিগত ১৬ বছরের নয়, ৫৩ বছরের জঞ্জাল দূর করতে পারি। আমাদের উচিত দলপ্রেমের রাজনীতি না করে দেশপ্রেমের রাজনীতি করা। তবেই আমরা গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন, সুশাসন, ন্যায়বিচার, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার, অর্থনৈতিক সুরক্ষার আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারব।
লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়