কালবৈশাখি ঝড়ের মৌসুম চলছে। এসময় আমাদের দেশের আবহাওয়া যেমন চরম ভাবাপন্ন থাকে, তেমনি ঈশান কোণে ঘন কালো মেঘের প্রভাব, প্রচণ্ড ঝড় আর ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে চলে বজ্রপাত। গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৮৪ লাখের বেশি বজ্রপাত হয়, যার ৭০ শতাংশই হয় এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, ব্যাপকভাবে বৃক্ষ নিধন, পরিবেশ দূষণ, প্রযুক্তির অপরিমিত ব্যবহার ইত্যাদি নানাবিধ কারণে দেশে অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ন্যায় বজ্রপাতের সংখ্যা, তীব্রতা ও প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। গত ২৮ এপ্রিল সোমবার দেশের ছয় জেলায় বজ্রপাতে ১৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ১১ মে দেশের পাঁচ জেলায় বজ্রপাত ও ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছেন আরও ১৫ জন। এসব ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছে আরও অনেকে। গত কয়েক দিনে কালবৈশাখি ঝড়ের সঙ্গে বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে আরও অনেক স্থানে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতে হতাহতের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনায় ২০১৬ সালে সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বজ্রপাতকে ‘দুর্যোগ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
সাধারণভাবে বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হলেও সুনির্দিষ্ট স্থান ও সময় নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া বজ্রপাতকে প্রতিহত বা এর প্রতিকারও সম্ভব নয়। তবে শহরাঞ্চলে বাসাবাড়ি ও বহুতল ভবনে বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন করে স্বল্প আয়তনের স্থানে বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকা যায়। বজ্রপাত থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র পন্থা সতর্কতা অবলম্বন। বজ্রপাতে প্রাণহানি হ্রাসে ২০১৩ সাল থেকে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে। তবে এর বেশিরভাগই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ দেশের সড়ক মহাসড়কে তালগাছ রোপণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল ২০১৬ সালে। ধারণা করা হয়, তালগাছের কাণ্ড ও পাতা যথেষ্ট মজবুত ও গাছটি যথেষ্ট উঁচু হওয়ার কারণে আশপাশের অন্যান্য স্থাপনার চেয়ে তাল গাছে বজ্রপাতের সম্ভাবনা বেশি ও এর বজ্রাঘাত সহ্য করার ক্ষমতা অন্য যে কোনো গাছের চেয়ে বেশি। এই ধারণা থেকে সরকার সারা দেশে খোলা স্থানে বিশেষ করে রাস্তার দুই পাশে তালগাছ রোপণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তালগাছে বজ্রপাতের সম্ভাবনা ও এর বজ্রাঘাত সহ্য করার উচ্চ ক্ষমতা শুধু অনুমাননির্ভর ও জনশ্রুতি। এটা কোনো গবেষণায় প্রমাণিত হয়নি। তাছাড়া তালগাছের বৃদ্ধি অত্যন্ত ধীরগতির। এ গাছ পরিপক্ব হতে ৩০-৪০ বছর সময় লেগে যায়। এত দীর্ঘ সময় পর কার্যকরের উদ্দেশ্যে সাম্প্রতিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা নিতান্তই অনুপযুক্ত একটি সিদ্ধান্ত। তাই পরবর্তীতে সরকার এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। পরবর্তীতে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় খোলা মাঠে বজ্রাঘাত সহনশীল আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু দেশের সব স্থানে এ ধরনের পর্যাপ্ত সংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও একটি উচ্চাভিলাসী সিদ্ধান্ত। এ কারণে সরকার এ সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসে। তবে শহরাঞ্চলে বহুতল ভবনে বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন বাধ্যতামূলক করায় সীমিত পরিসরে বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি সামান্য কমানো সম্ভব হয়েছে।
বজ্রপাতের সময় সচেতনতা এবং কিছু জরুরি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই প্রাণহানির ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর বজ্রপাতের সময় নিরাপদ থাকার জন্য যে ২০টি নির্দেশনা দিয়েছে, তা প্রতিটি নাগরিকের জানা জরুরি। বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং বা পাইপ ছোঁয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং প্রতিটি ভবনে বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। খোলা স্থানে একত্রে অনেক মানুষ থাকলে বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেককে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে সরে যেতে হবে। বাড়িতে যদি যথেষ্ট নিরাপত্তা না থাকে, তবে সবাই এক জায়গায় না থেকে আলাদা কক্ষে অবস্থান করতে হবে। বড় গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া বিপজ্জনক, তাই গাছ থেকে অন্তত চার মিটার দূরে থাকতে হবে। ছেঁড়া বৈদ্যুতিক তার বা তারের নিচ দিয়ে চলাচল না করে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
এই নির্দেশনাগুলো মেনে চললে বজ্রপাতজনিত দুর্ঘটনা থেকে নিজেদের ও পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ রাখা সম্ভব। সচেতনতা ও প্রস্তুতিই হতে পারে প্রাণ রক্ষার মূল চাবিকাঠি।