আদালতে মামলাজট একটি অতি পুরাতন খবর। ব্রিটিশ আইন ও পদ্ধতিতে আধুনিক যুগেও চলছে মামলার বিচারকার্য। দেশের আদালতগুলোতে দীর্ঘ মামলা জটের হার ঊর্ধ্বগতি। কর্তৃপক্ষ দাপ্তরিকভাবে নানান পদক্ষেপ নিলেও যেন বিদ্যমান আইন সংশোধন না হওয়ার ফলে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে বিচারপ্রার্থীর একটি দেওয়ানী মামলার রায় পেতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করতে হয়।
তারপর আবার সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি কর্তৃক উক্ত মামলার জন্য উচ্চ আদালতে আপিল বা রিভিশন প্রক্রিয়া। এমনও নজির আছে পিতা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছে; কিন্তু পিতা উক্ত মামলার রায়ের ফলাফল দেখে যেতে পারেনি- পরবর্তীতে সন্তানরা সেই মামলার পরবর্তী বাদী হয়ে মামলা চালাচ্ছে। মামলার বাদী মামলার রায়ের ফলাফল দেখে না যাওয়াটা বড় কষ্টের। সারা দেশের আদালতে মামলাজট একটি বড় ধরনের সমস্যায় পরিণত হয়েছে।
২০২৪ সালে আদালতে মামলাজট বেড়েছে ২ লাখ ১৭ হাজার ৪টি। এরমধ্যে শেষ ছয় মাসে বেড়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৬৪১টি। দেশের সব আদালতে বর্তমানে মামলার সংখ্যা ৪৫ লাখ ১৬ হাজার ৬০৩টি। মামলা বাড়ার তথ্য অনুযায়ী এ হার গত এক যুগে সর্বোচ্চ। চলতি বছরের দুই মাসে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৮ সালে ২ লাখ ১৫ হাজার মামলা বেড়েছিল। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি মামলার জট আপিল বিভাগে, ৩১ হাজার ১২০টি। ৬ মাসে এটি বেড়েছে ৩ হাজার ৬৪৩টি। সুপ্রিমকোর্টের অভ্যন্তরীণ শাখার বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এটি শিগগিরই চূড়ান্ত করার পর প্রধান বিচারপতির কাছে উপস্থাপনের কথা রয়েছে। এরপর প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনটি বিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ও আইন মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হবে। বার্ষিক প্রতিবেদন সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে প্রকাশ হয়ে থাকে।
সুপ্রিম কোর্টের গত ১৮ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথককরণের সময় দেশে বিচারাধীন মামলা ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার ৬৫৭টি। তথ্য পর্যালোচনা বলছে, দেড় যুগে মামলাজট হয়েছে তিনগুণ।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ও বিচার বিভাগের কিছু উদ্যোগের কারণে আদালতগুলোতে মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়লেও তা দায়ের অপেক্ষা পিছিয়ে ছিল। ২০১৬ সাল থেকে মামলাজট অপেক্ষাকৃত কমতে শুরু করে। ২০২২ সালে প্রথম ও সবশেষ মামলা দায়ের অপেক্ষা নিষ্পত্তি বেশি হয়। এরপর মামলাজট বাড়ার লাগাম অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু বিদায়ী বছরের শেষ ৬ মাসে বিচার বিভাগে কার্যত অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে।
এ সময় মামলা বেড়েছে এক লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি। অথচ প্রথম ৬ মাসে মামলা ছিল ৮১ হাজার ৩৬৩টি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধান বিচারপতিসহ রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তা পদে নতুন মুখ এসেছে। হাইকোর্টে ২৩ জন বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছে। অধস্তন আদালতেও বিচারিক পদগুলোতে হয়েছে ব্যাপক রদবদল। মামলাজট কমানোসহ বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনও গঠন করেছিল সরকার। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ওই কমিশন সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দিয়েছে। তাতেও মামলাজট কমানোর বিষয়ে উল্লেখযোগ্য সুপারিশ করা হয়েছে। (তথ্যসূত্র : দৈনিক সমকাল, ১ মার্চ, ২০২৫)। এত সংখ্যক মামলাজটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জট বেঁধেছে দেওয়ানী প্রকৃতির মামলাগুলোর। এই দেওয়ানী মামলা নিস্পত্তিতে ব্রিটিশ আইন ও পদ্ধতি অনুসরণ এবং আদালতের নানাবিধ সমস্যার কারণে বিশেষ করে দেওয়ানী মামলাজট বেড়েই চলছে।
পরিবেশ, বন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান একটা অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে একটা কথা আছে, কারও সঙ্গে শত্রুতা করতে গেলে একটা ল্যান্ড মামলাজুড়ে দাও। ফলে তিন জেনারেশনে সে মামলা শেষ হবে না। তিন জেনারেশন যেন না লাগে, এক জেনারেশনেই যেন মামলা শেষ হয়, সে জন্য সিপিসিতে কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে। যাতে করে যারা বিচারপ্রার্থী, তাদের সময় কম লাগে, টাকা কম লাগে’।
সরকার দেওয়ানী মামলা নিষ্পত্তিতে নানান সমস্যার কারণ নির্ণয় করে দেওয়ানি কার্যবিধি আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ জারি করা হয়েছে। নতুন এ সংশোধিত অধ্যাদেশে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলো হলো-
১) এখন থেকে বিবাদীর প্রতি সমন জারি করার পদ্ধতিতে যুক্ত হয়েছে বিবাদীকে মোবাইল ফোন, এসএমএস, ভয়েস কল ও ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং এর মাধ্যমে সমন পাঠানো যাবে। মামলার আবেদন করার সময় প্রতিপক্ষের মোবাইল নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর এবং ই-মেইল (যদি থাকে) উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
২) বাদী বা বিবাদীকে আদালতে দাঁড়িয়ে আরজি বা জবাব মুখস্ত করে মৌখিক জবানবন্দি দিতে হবে না। এখন থেকে বাদী-বিবাদীকে অ্যাফিডেভিটসহ লিখিত জবানবন্দি জমা দিতে হবে হবে। এর আগে এই আদালতে এই জবানবন্দি গ্রহণে দীর্ঘসময়ও অতিবাহিত হতো, যার ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসময় ব্যয় হতো।
৩) এখন থেকে অর্থ আদায়ের দেওয়ানি মামলার রায় প্রাপ্তির পর পৃথকবাবে নতুন করে আর জারি মামলা করতে হবে না। মূল মামলাতেই জারি সংক্রান্ত দরখাস্ত দাখিল করে অর্থ আদায় করা যাবে।
৪) এখন থেকে দেওয়ানি আদালত রায় ও আদেশ কার্যকর করতে পুলিশসহ যেকোনো আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিতে পারবে।
৫) নতুন এ সংশোধনীতে দেওয়ানি মামলায় বিবাদীর জেল (দেওয়ানি আটকাদেশ) হলে বিবাদীকে জেলখানায় থাকার খরচ সরকার বহন করবে। এর আগে বিবাদীকে জেলখানায় রাখার খরচ বাদীকে বহন করতে হতো।
৬) নতুন এ সংশোধিত দেওয়ানি মামলায় আপিল দায়েরের পরে আপিলকারী বা প্রতিপক্ষ শুনানির তারিখে সংশ্লিষ্ট আদালতকে উপস্থিত না থাকলে আদালত তাৎক্ষণিক কিংবা ন্যায় বিচারের স্বার্থে একটি তারিখ ধার্য করে আপিলটির রায় ঘোষণা করতে পারবে।
৭) এখন থেকে অর্থ আদাযের আদায়ের মামলায় যা মানি স্যুট বিশেষ জারির বিধান সম্পৃক্ত করা হয়েছে। দেওয়ানি আদালত অর্থ আদায় সংক্রান্ত মামলায় ডিক্রিহোল্ডারের আবেদন মোতাবেক বিবাদীকে সর্বোচ্চ ৬ মাস পর্যন্ত জেল (দেওয়ানি আটকাদেশ) প্রদান করিতে পারবে।
৮) নতুন এ সংশোধীতে দেওয়ানি মামলায় সময়ের আবেদনের সংখ্যা কমছে। আগে ছিল ছয়বার পর্যন্ত সময় এখন তা কমিয়ে ৪ বার পর্যন্ত সময় মঞ্জুরের বিধান যুক্ত হয়েছে।
৯) এখন থেকে দেওয়ানী মামলায় একজন বিবাদী একবারের বেশি একতরফা রায়-ডিক্রি বাতিলের আবেদন করতে পারবে না।
১০) এখন থেকে বাদী কর্তৃক মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। যাহা আগে ছিল ২০ হাজার টাকা।
বিচারপ্রার্থীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা দেওয়ানি মামলার ব্রিটিশ আইন ও পদ্ধতির কিছু পরিবর্তন হোক। বিচারপ্রার্থীদের প্রত্যাশা পূরণে বর্তমান সরকার এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দেওয়ানি কার্যবিধি আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ জারি করেছে। এ সংশোধনের ফলে জমি-জমা বা দেওয়ানি প্রকৃতির মামলায় বিচারপ্রার্থীদের বিচার পেতে সহজ হবে। দেওয়ানি মামলা সংক্রান্ত এ সংশোধিত আইনটি কার্যকরের ফলে দেশের আদালতে দেওয়ানি প্রকৃতির মামলাজট বহুলাংশে কমে যাবে।
লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট, জজ কোর্ট, খুলনা।