ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

অভ্যাস ও উপলব্ধি : ব্যক্তিত্ব গঠনের অদৃশ্য সমীকরণ

রাশেদুল ইসলাম সম্রাট
অভ্যাস ও উপলব্ধি : ব্যক্তিত্ব গঠনের অদৃশ্য সমীকরণ

এক রাতের কথা ভাবুন, আপনি ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গেলেন, ফোনটা হাতে নিয়ে মনে মনে বললেন, ‘আর মাত্র পাঁচ মিনিট স্ক্রোল করব।’ কিন্তু কখন যে সেই পাঁচ মিনিট এক ঘণ্টায় বদলে গেল, আপনি টেরও পেলেন না। পরিচিত লাগছে না? আসলে এমনটা কম বেশি আমাদের সবার সঙ্গেই হয়। এই ছোট্ট মুহূর্তটাই পরিণতির প্রথম ইঙ্গিত দেয় যে অভ্যাসের শক্তি নীরব; কিন্তু অসীম গভীর। একেকটা ছোট, সাধারণ মনে হওয়া অভ্যাস শুধু সময়ই কেড়ে নেয় না, বরং ধীরে ধীরে আমাদের চিন্তা, মনোভাব, আর শেষ পর্যন্ত পুরো ব্যক্তিত্বের রূপটাই বদলে দেয়।

অভ্যাস আর উপলব্ধি- এই দুইটাই আমাদের জীবনের ব্যাকস্টেজ প্লেয়ার, যারা দৃশ্যের বাইরে থেকে চুপচাপ আমাদের চরিত্র আর গন্তব্য গড়ার কাজ করে। দিনের পর দিন আমরা যে কাজগুলো করে যাই, সেগুলোই গোপনে আমাদের কেড়ে নেয় অথবা গড়ে তোলে। ব্যক্তিত্ব মানে একদিনে গড়ে ওঠা কোনো চটকদার ব্যাপার না, এটি অনেকটা ধীরে ধীরে আঁকা একটা পেইন্টিংয়ের মতো, যেখানে প্রতিটা স্ট্রোক মানে একটা অভ্যাস, একটা উপলব্ধি।

অভ্যাস ও উপলব্ধি- এই দুই শক্তিই নির্ধারণ করে দেয় আপনি কে হবেন, কীভাবে চিন্তা করবেন, আর আপনার জীবনের গতিপথ কোন দিকে যাবে। যদি আপনি সচেতনভাবে অভ্যাসের নিয়ন্ত্রণ নেন, তবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবেন সেই রূপে, যা হতে চেয়েছেন সবসময়। কিন্তু যদি এই অভ্যাসগুলো গড়ে ওঠে অজান্তেই, উপলব্ধির আলো ছাড়াই, তাহলে আপনি হয়তো একসময় নিজেকেই আর চিনতে পারবেন না- নিজের ভেতরেই হারিয়ে যাবেন ধীরে ধীরে।

চলুন, আগে অভ্যাসের কথাই বলি। অভ্যাস মানে সেই ছোট ছোট কাজগুলো- যা আমরা প্রতিদিন করে যাই, কখনও সচেতনভাবে, কখনও একেবারেই না বুঝে। ঘুম থেকে উঠে ফোন চেক করা, না খেয়েই কাজ শুরু করা, বা প্রতিদিন সকালে ১০ মিনিট বই পড়া। দেখতে সাধারণ, কিন্তু সময়ের সঙ্গে এই ছোট কাজগুলোই গড়ে তোলে আমাদের চিন্তা, আচরণ আর জীবনধারা। যেমন, কেউ যদি প্রতিদিন সকালে হাঁটার অভ্যাস করে, ধীরে ধীরে সে শুধু ফিটই হয় না, বরং তার মনও ফ্রেশ থাকে, আত্মবিশ্বাস বাড়ে, আর নিজের উপর কন্ট্রোল আসতে শুরু করে। এটাই হলো- অভ্যাসের শক্তি- নীরব; কিন্তু গভীর।

এবার আসি উপলব্ধির প্রসঙ্গে। এটি হলো- আমরা চারপাশের মানুষ, ঘটনা, আর পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখি, বুঝি আর অনুভব করি। কারও কাছে একটা ব্যর্থতা হতে পারে জীবনের শেষ, আবার আরেকজন সেটা দেখবে শেখার সুযোগ হিসেবে। ধরুন, কেউ যদি চাকরি না পায়, কেউ হতাশ হয়ে পড়ে, আর কেউ সেই সময়টায় নতুন কিছু শেখার সিদ্ধান্ত নেয়। মূল পার্থক্যটা এখানে- উপলব্ধিতে। সঠিক উপলব্ধি আমাদের শেখায় কীভাবে চ্যালেঞ্জকে সুযোগে পরিণত করতে হয়, কীভাবে জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হয়, আর কোন দিকে মনোযোগ দিলে আমরা নিজেকে আরও ভালোভাবে গড়তে পারি।

একটি শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার জন্য ভালো অভ্যাস ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছোট ছোট কাজ আর চিন্তার ধারা সময়ের সঙ্গে আমাদের আত্মপরিচয় ও জীবনদর্শনকে গড়ে তোলে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল ব্যক্তিত্ব ও আত্মগঠনের প্রশ্নে এক অসাধারণ গভীরতাসম্পন্ন বক্তব্য রেখে গেছেন। তিনি বলেছিলেন :

We are what we repeatedly do. Excellence, then, is not an act, but a habit. এই উক্তিটি শুধু একটি ভাবনা নয়, বরং মানবজীবনের একটি মৌলিক সত্যের প্রতিচ্ছবি। অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিতে মানুষ শুধু তার কাজ নয়, বরং তার প্রতিদিনকার আচরণ ও অভ্যাসের সমষ্টিই তার প্রকৃত পরিচয় বহন করে। তিনি মনে করেন, শ্রেষ্ঠতা বা উৎকর্ষতা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়; বরং তা নিরবিচারে চর্চিত অভ্যাসেরই ফল। অর্থাৎ, একজন মানুষের চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব গঠিত হয় সেই ক্ষুদ্র, নিত্যদিনের অভ্যাসগুলোর মধ্য দিয়ে যেগুলোর অনেককেই আমরা তুচ্ছ ভেবে গুরুত্ব দিই না। কিন্তু ধীরে ধীরে, এই অভ্যাসগুলোই একজন ব্যক্তির চিন্তা, বিশ্বাস ও কর্মধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে তার জীবনকে গড়ে তোলে।

ব্যক্তিত্ব গঠনে নিচের কার্যকর কিছু পন্থা অনুসরণ করা যেতে পারে :

আত্মবিশ্বাস ও ইতিবাচক মানসিকতা গড়ে তুলুন : প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শক্তি ও গুণাবলীর প্রশংসা করুন। এতে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। নেতিবাচক চিন্তার পরিবর্তে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ধরে রাখলে প্রতিটি সমস্যার মাঝেও সম্ভাবনা খুঁজে পাওয়া যায়।

শৃঙ্খলা ও সময় ব্যবস্থাপনা রপ্ত করুন : একজন শিক্ষার্থী যদি দৈনন্দিন রুটিন অনুসরণ করে নির্দিষ্ট সময়ে পড়াশোনা, ব্যায়াম ও বিশ্রাম করে, তাহলে সহজেই সে তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। সময়ের মূল্য বোঝা এবং তা যথাযথভাবে কাজে লাগানো সফলতার মূল চাবিকাঠি।

জ্ঞান অর্জন ও আত্মউন্নয়ন এ মনোযোগ দিন : নতুন কিছু শেখার অভ্যাস গড়ে তুলুন। যেমন : একজন লেখক প্রতিদিন নতুন শব্দ শেখে ও বই পড়ে নিজের চিন্তাধারাকে প্রসারিত করে, যা তার পেশাগত উন্নয়নে সহায়তা করে।

ধৈর্য ও নমনীয়তা বজায় রাখুন : একজন উদ্যোক্তা বারবার ব্যর্থ হলেও শেখার মনোভাব বজায় রাখলে সে একদিন সফল হয়। ব্যর্থতাকে শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করাই একটি পরিপক্ব ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক।

সামাজিক দক্ষতা ও বিনয় চর্চা করুন : মানুষের সঙ্গে আন্তরিকতা, শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির সঙ্গে কথা বলুন। বিনয় শুধু একটি চারিত্রিক গুণ নয়, এটি নেতৃত্বের একটি সূক্ষ্ম শক্তি। একজন প্রকৃত সফল ব্যক্তি- হোক তিনি উদ্যোক্তা, শিক্ষক বা কর্পোরেট লিডার- তার চারপাশের মানুষদের সম্মান ও সহানুভূতির মাধ্যমে প্রভাবিত করেন। কর্মীদের সঙ্গে সদাচরণ, খোলামেলা মনোভাব এবং সহযোগিতার মনোভাব- এই গুণগুলোই তাকে সত্যিকারের নেতৃত্বে উন্নতি করে।

স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গড়ে তুলুন : দৈনন্দিন ব্যায়াম, সুষম খাদ্য গ্রহণ ও পর্যাপ্ত ঘুম শুধু শারীরিক নয়, মানসিক সুস্থতার জন্যও অপরিহার্য। সুস্থতা ব্যক্তিত্বের ভিত্তি গড়ে তোলে।

যোগাযোগ দক্ষতা উন্নত করুন : পরিষ্কার, আত্মবিশ্বাসী ও প্রাসঙ্গিকভাবে কথা বলার ক্ষমতা- এটাই একটি শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অন্যতম নিখুঁত হাতিয়ার। সফল মানুষদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তারা কী বলতে চান তা স্পষ্টভাবে জানেন এবং কীভাবে বলতে হবে, সেটাও দক্ষভাবে প্রয়োগ করতে জানেন। উন্নত যোগাযোগ দক্ষতা শুধু কথাবার্তা নয়- এটি মানুষের মন জয় করার, বিশ্বাস তৈরি করার এবং নিজের চিন্তা-ভাবনা কার্যকরভাবে উপস্থাপন করার একটি কৌশলী উপায়। স্মরণে রাখুন, কথার মাধ্যমেই আপনি আপনার জ্ঞান, অনুভব ও নেতৃত্ব প্রকাশ করেন। তাই, নিজের ভাব প্রকাশের স্টাইলকে যতটা সম্ভব পরিশীলিত, আত্মবিশ্বাসী ও শ্রোতাবান্ধব করে তুলুন।

নৈতিকতা ও ব্যক্তিগত মূল্যবোধ বজায় রাখুন : সততা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং ন্যায়ের প্রতি অবিচল থাকা আপনাকে সমাজে সম্মানিত করবে। একজন নৈতিকভাবে দৃঢ় মানুষ সব জায়গায় বিশ্বস্ততা ও শ্রদ্ধা অর্জন করেন।

জীবন ছুটছে, সময় থেমে নেই। আপনি হয়তো এখনো নিজেকে খুঁজে পাননি, কিংবা হয়তো প্রতিদিনই নিজের ভেতর কিছু হারিয়ে ফেলছেন। কিন্তু জানবেন- আপনার অভ্যাস আর উপলব্ধিগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই মানুষটা, যা আপনি হতে চেয়েছিলেন। তাই নিজেকে একবার ভালোবেসে প্রশ্ন করুন- আপনি কার অভ্যাসে বন্দি, আর কোন উপলব্ধির আলোয় আপনি জেগে উঠতে চান?

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত