ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নারীর অধিকার ও মর্যাদা

নবাব শাহজাদা
নারীর অধিকার ও মর্যাদা

নারী মানে কেবলই একটি সম্পর্ক নয়, নারী নিজেই একটি সত্তা, একটি স্বতন্ত্র পরিচয়, একটি ভাবনার নাম। যুগে যুগে সভ্যতার পরিবর্তনে নারীর পরিচয়ও পরিবর্তিত হয়েছে, তার অবস্থান নিয়েছে নানামাত্রিক রূপ। কখনও সে ছিল ঘরের চার দেয়ালে আবদ্ধ, কখনওবা যুগ বদলের অগ্রদূত। ইতিহাসের পাতায় যেমন আছে তার শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়নের চিত্র, ঠিক তেমনি আছে সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও সাফল্যের উজ্জ্বল উদাহরণ। এই প্রেক্ষাপটে নারীর অধিকার, মর্যাদা এবং তার প্রকৃত অবস্থান নিয়ে আলোচনা করা সময়ের দাবিও বটে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বিচার করি, তাহলে ইসলাম নারীর যে সম্মান ও অধিকার নির্ধারণ করেছে তা কোনো বৈষম্যের নয়; বরং তা নারীর মর্যাদা রক্ষার্থেই নির্ধারিত হয়েছে। ইসলাম নারীকে দিয়েছে শিক্ষা অর্জনের স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার, উত্তরাধিকার লাভের সুযোগ এবং বিবাহে সম্মতির গুরুত্ব। কন্যাশিশুর জন্মকেও দেয়া হয়েছে সম্মান, আর মায়ের মর্যাদাকে রাখা হয়েছে স্বর্গের সমান উচ্চতায়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তিনটি কন্যা সন্তানের প্রতি সদয় থাকে এবং তাদের লালন-পালন করে, সে জান্নাতে যাবে।’ অথচ আজকের সমাজে নারীকে দেখা হয় একরকম সহানুভূতির দৃষ্টিতে কিংবা হেয় চোখে। তার সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে তাকে বানানো হয় নিঃশব্দ শ্রোতা। সামাজিক বাস্তবতায় এখনও নারীরা নানাভাবে পিছিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় নারীদের শিক্ষার হার কম, বাল্যবিবাহের হার বেশি এবং কর্মজীবনে অংশগ্রহণের হার তুলনামূলকভাবে কম। তারা নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না হলে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা খুব সহজেই তাদের কণ্ঠরোধ করতে পারে। যদিও শহরাঞ্চলে কিছুটা অগ্রগতি দেখা যায়- কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ছে, শিক্ষার হার বাড়ছে- কিন্তু এরপরও নারীর নিরাপত্তা এবং সম্মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। অফিস, আদালত, গণপরিবহন, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নারীরা হয়রানির শিকার হন। আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে নারীদের জন্য রয়েছে বহু নিরাপত্তা বিধান। বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন এবং নারী উন্নয়ন নীতিমালার মতো অনেক আইন প্রণীত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব আইনের কতটুকু কার্যকর হচ্ছে বাস্তবে? বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, আইন প্রয়োগে উদাসীনতা এবং অনেক সময় সামাজিক লজ্জার ভয়ে নারীরা মামলা করতেও পিছিয়ে যান। তাই কেবল আইন থাকলেই হবে না; তার সঠিক প্রয়োগ ও সামাজিক মনোভাবের পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। ইতিহাসে যদি চোখ রাখা যায়, তবে দেখা যাবে নারী কখনওই পিছিয়ে ছিল না; বরং তার অবস্থান ছিল দৃঢ় ও মর্যাদাপূর্ণ। প্রাচীন মিশর থেকে শুরু করে ভারতীয় উপমহাদেশ কিংবা ইসলামি সভ্যতাণ্ড সবখানেই কিছু নারী এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন যা আজও অনুপ্রেরণার উৎস। বেগম রোকেয়া ছিলেন নারী শিক্ষার অগ্রদূত, যিনি কুসংস্কার আর সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে নারী জাগরণের চেতনায় আলোকবর্তিকা জ্বালিয়েছিলেন। বাংলার ইতিহাসে ইলা মিত্র কিংবা তারুণ্যের প্রতীক সুফিয়া কামালের নামও স্মরণীয়। এছাড়াও ইসলামি ইতিহাসে হযরত খাদিজা (রা.) ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী, যিনি মহানবী (সা.)-কে দাওয়াতি কাজে আর্থিক সহায়তা করে ইসলাম প্রচারে অসামান্য অবদান রেখেছেন। আর হযরত আয়েশা (রা.) ছিলেন একজন শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী নারী যিনি হাজারেরও বেশি হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং ইসলামী জ্ঞানের প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। নারীর মর্যাদা কেবল সম্পর্কের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়; সমাজ ও সংস্কৃতিতেও তার অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য নারীকে কখনও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করেছে, কখনও আবার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে তুলে ধরেছে তার বাস্তবতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখের বালি কিংবা শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তে নারী চরিত্রগুলো যেমন বাস্তব, তেমনি গভীর। ইসলামি সাহিত্যেও নারীর অবস্থান সম্মানজনক এবং মর্যাদাসম্পন্ন। সংস্কৃতি ও গণমাধ্যম নারীর পরিচয় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক সময় এসব মাধ্যম নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে উপস্থাপন করে। বিজ্ঞাপন, নাটক, এমনকি সিনেমাতেও নারীর শরীরকে পণ্যের মতো ব্যবহার করা হয়, যা তার মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে। আমাদের প্রয়োজন এমন একটি সংস্কৃতি, যেখানে নারী হবে আত্মবিশ্বাসী, জ্ঞানী এবং মর্যাদাপূর্ণ এক মানুষ। এখন প্রশ্ন আসে, নারীবাদ আসলে কী বলে এবং ইসলামের অবস্থান কী এর সঙ্গে? পাশ্চাত্য নারীবাদ মূলত নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা, কর্মক্ষেত্রে সমানাধিকার এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধাচরণ করে। তারা নারীর যৌন স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলে, যা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইসলামের নারীবাদ বা নারীর অধিকারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো নারী ও পুরুষ উভয়ের নিজ নিজ অবস্থান ও মর্যাদা নিশ্চিত করা, যেখানে আছে দায়িত্ব, ভারসাম্য, সম্মান ও পারস্পরিক সহযোগিতা। ইসলাম নারীকে তার সৃষ্টিগত স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে আছে পর্দা, নিরাপত্তা আর সম্মানের সমন্বয়। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতেই হবে। পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সব নারীকে তার নিজের মতো করে ভাবতে শেখাতে হবে। একজন নারী কেবল মা, বোন বা স্ত্রী নয়; সে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ, যার আছে স্বপ্ন, চিন্তা ও চাহিদা। তাকে সুযোগ না দিলে সমাজ কখনওই পূর্ণতা পাবে না। শেষকথা হলো নারী জাতি কেবল করুণা পাওয়ার যোগ্য নয়, বরং সম্মান পাওয়ার দাবিদার। তার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনলেই সমাজ হবে মানবিক। নারী তার আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চায়, কাজ করতে চায় এবং সমাজে অবদান রাখতে চায়। তার হাতে যদি থাকে কলম কিংবা করাত, তা যেন তার নিজের পছন্দের ফলাফল হয়- সমাজের চাপিয়ে দেওয়া কোনো নিয়তি নয়। নারী জয়ী হবে সেই সমাজেই, যেখানে তার অশ্রু নয়, হাসি হবে পরিচয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত