মানবসভ্যতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যখন জমে ওঠে স্থবিরতা, সমাজ দংশিত হয় বৈষম্যের বিষে, মানুষের চিন্তা-চেতনা হটে অনিশ্চয়তার গহ্বরে- ঠিক তখনই ইতিহাসে আবির্ভাব ঘটে এমন কিছু ব্যতিক্রমী সত্তার, যারা সময়ের প্রয়োজন মেটাতে সবকিছুকে ভেঙে গড়ে তোলেন নতুন ভাবে। স্থান করে নেন মানুষের হৃদয়ে, আর অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষের ভেতরে ছড়িয়ে দেন নতুন ভোরের আলোর দ্যুতি। কাজী নজরুল ইসলাম তেমনি এক দুর্দম আত্মা- একজন কবি, যিনি শুধু কবিতায় নয়, চিন্তা-চেতনায়, দর্শনে মানুষের মাঝে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার কবিতা শব্দের খেলায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা এক সংগ্রামী আত্মার উন্মেষ। বিদ্রোহ ছিল তার রক্তে, প্রেম প্রবাহিত হতো প্রতিটি ধমনীতে, আর মানবতার স্থান ছিল হৃদয়ের কেন্দ্রে।
নজরুল সেই বিখ্যাত ঘোষণা- ‘আমি চির বিদ্রোহী বীর/ বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা/ উন্নত মম শির’- এতে যেমন বজ্রনিনাদ, ঠিক তেমনি আত্মমুক্তির স্বর ধ্বনিত হয়। তিনি অন্ধকারকে চিনতেন বলেই আলোর প্রকৃত মূল্য উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং সেই আলোই তিনি খুঁজছেন মানুষের হৃদয়ে। নজরুলের মানবতাবাদ ও ব্যক্তি স্বাধীনতার দার্শনিক চিন্তাধারার কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে মানুষ- তার অস্তিত্ব, মর্যাদা ও সম্ভাবনা। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের প্রকৃত ধর্ম হলো তার মানবতা। তাই তিনি বলেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’/ এই একটি মাত্র পঙ্ক্তিতে অনুমেয় হয় নজরুলের মৌল দর্শন- যেখানে কোনো জাত, ধর্ম, বর্ণ বা শ্রেণির ঊর্ধ্বে রয়েছে একটি স্বাধীন সত্তা, মানুষ। এই মানবিক চেতনা তাকে করে তুলেছে সময়ের তুলনায় অনেক বেশি আধুনিক ও অগ্রগামী। সাম্য ও শ্রেণি নিরপেক্ষতায় নজরুলের বিশ্বাস ছিল অটল। তিনি মনে করতেন, দারিদ্র্য ও শোষণ শুধুমাত্র আর্থিক সমস্যা নয়- এটি একটি গভীর নৈতিক সংকট। তাই তিনি লিখেছেন : ‘আমি সেইদিন মানবের জয়গান গাইব, যে দিন নিপীড়িত মানুষ গাইবে বিজয়ের গান।’
এই পঙ্ক্তি সমাজতান্ত্রিক দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও নজরুল কোনো একক মতবাদের অনুগামী ছিলেন না। তার সাম্যবাদ ছিল জীবন ঘনিষ্ঠ এক অন্তর্জাগতিক চেতনার প্রকাশ- যেখানে মানুষ শোষকের মুখোশ খুলে নিজের শক্তি আবিষ্কার করে। যদিও কবি নজরুল মুসলমান ছিলেন, তবু তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা ও আন্তঃধর্মীয় সংহতির এক উদার মননে বিশ্বাসী ছিলেন। তার লেখায় আমরা দেখি- গীতা, বাইবেল, ত্রিপিটক ও বেদের বাণীকে সমান মর্যাদায় তুলে ধরা হয়েছে। তিনি ধর্মকে দেখেছেন আত্মশুদ্ধির পথ হিসাবে। কখনোই ক্ষমতার হাতিয়ার হিসাবে নয়।
‘মোরা একবৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’ এই পঙ্ক্তিতে নজরুল শুধু সাম্প্রদায়িক বিভক্তির প্রতিবাদ করেননি, তিনি রচনা করেছেন বাঙালির নিজস্ব ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি। প্রেম ও সৌন্দর্যের দর্শনেও নজরুল সীমাবদ্ধ ছিলেন না রূপ ও রোমান্টিকতায়। তার প্রেম বিস্তৃত হয়েছিল আত্মা, প্রকৃতি ও ঈশ্বর পর্যন্ত। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রেমের আবেশ মানুষেকে বৃহত্তর এক অস্তিত্বের দিকে আহ্বান জানায়।
‘আমার চেতনা আজ জাগ্রত, আমার আত্মা আজ মুক্ত’ এই অনুভব থেকেই জন্ম নিয়েছে এমন কবিতা, যেখানে প্রেম হয়ে ওঠে আলোকবর্তিকা, যা অন্ধকারকে ভেদ করে। নজরুলের দ্রোহ শুধু রাজনৈতিক ছিল না, ছিল অস্তিত্ব গত। তিনি বিদ্রোহ করেছেন মিথ্যা, ভণ্ডামি, কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, রক্তচোষা সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে, নারীর অবমাননা বিরুদ্ধে। তার কবিতা ‘বিদ্রোহী’ শুধু একটি কাব্য নয়, এটি এক আত্মণ্ড ঘোষণা। ‘আমি দলে দলে আনব আলো, দূর করব ঘোর অন্ধকার।’ এই পঙ্ক্তি তার দর্শনের অন্যতম ভিত্তি। নজরুল উপলব্ধি করেছিলেন, মানুষের আত্মবোধ ও চেতনার মুক্তি না হলে সমাজের মুক্তি সম্ভব নয়। তাই তিনি নিজের ভেতরেই অস্থিরতা, পাগলামি, প্রেম, প্রতিবাদ সবকিছুকেই একত্রে প্রকাশ করেছেন সাহিত্যে। এই আত্মমর্যাদা বোধের প্রকাশ আমরা পাই তার কবিতা, গান, গল্প, সঙ্গীতে, এমনকি তার নীরবতায়, অসুস্থতায়। যখন তিনি বাকরুদ্ধ, তখনও তার চেতনার আলো ছড়িয়ে পড়ে সাহিত্যের প্রান্তরে।
নজরুল ছিলেন একজন কবি, তবে তার কবিতায় প্রবাহিত হয়েছে দার্শনিক চিন্তার নির্ঝরিনী- যেখানে জীবন, মৃত্যু, ঈশ্বর মানুষ ও বিদ্রোহ এক হয়ে তৈরি করেছে এক চিরন্তন বার্তা- অন্ধকার কখনও চিরস্থায়ী নয়, আলো ঠিকই ফিরে আসে। নজরুল আমাদের শেখান, কীভাবে প্রশ্ন করতে হয়, ভালোবাসতে হয়, আর কীভাবে দাঁড়াতে হয় অন্যায়কে রুখে দিতে। আজ যখন সংকীর্ণতা মাথা তুলে, যেখানে মানুষের পরিচয় হয় ধর্ম, বর্ণ, জাত, শ্রেণি দ্বারা- সেখানেই নজরুলের দর্শন আমাদের প্রয়োজন, আলোর মতো। কারণ, তিনি শুধু বিদ্রোহ শেখাননি, শুধু প্রেম শেখাননি- তিনি শিখিয়েছেন দুটিকেই একসঙ্গে ধারণ করতে। আর এই সমন্বয় থেকেই জন্ম নেয় চিরন্তন সত্যের দর্শন।