একসময় ছাত্ররাজনীতির অনেক সুনাম ও সুখ্যাতি ছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রদের অংশগ্রহণ, ১৯৯০-এর স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন সর্বশেষ জুলাই-আগস্ট ছাত্রদের অভ্যুত্থানে হাসিনার পতন আন্দোলনে ছাত্ররা মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে। সময়ের বিবর্তনে ছাত্ররাজনীতির সেই সোনালি অতীত এখন আর নেই। ছাত্ররাজনীতির পুরোনো ঐতিহ্য এখন নষ্ট হয়ে গেছে। ছাত্রদের মধ্য আগের সেই নীতি, আদর্শ ও উদ্দেশ্য এখন নেই। একদিকে ক্ষমতার মোহ ও পেশি শক্তির ব্যবহার ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করছে। অন্যদিকে ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক কারণে সাধারণ ছাত্ররা ছাত্র আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ছাত্র সংগঠনগুলো এখন ছাত্রদের কল্যাণের কথা বলে না, বরং রাজনীতিবিদদের এজেন্সির কথা বলে। বর্তমান সময়ে ছাত্ররাজনীতি হচ্ছে রাজনৈতিক দলের নিজেদের স্বার্থে ছাত্রদের ব্যবহার করার রাজনীতি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের নেতারা ছাত্রদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করছে। এমতাবস্থায় দলীয় ছাত্ররাজনীতির দ্বারা সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় আধিপত্যের প্রতিযোগিতায় অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে রক্ত ঝড়ছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নানা দাবি-দেওয়া নিয়ে সড়ক অবরোধের মাধ্যমে জনভোগান্তি সৃষ্টি করছে। এতে সাধারণ মানুষ তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। কথায় কথায় আন্দোলনের নামে বিশ্ববিদ্যালয় শাটডাউন ও সড়ক অবরোধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এতে করে পড়াশোনার চরম ব্যাঘাত এবং সেশনজট সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের দেশের মতো ছাত্ররাজনীতি পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে ছাত্ররাজনীতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাক।
বর্তমান ক্যারিকুলাম অনুযায়ী একজন ছাত্র প্রাইমারি লেবেল, হাইস্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটি পার হতে প্রায় ২৪-২৫ বছর লেগে যাচ্ছে। এই পঁচিশ বছর প্রতিটি ছাত্রের বাবা-মা এবং শিক্ষক ও শিক্ষিকাকে ওই ছাত্রের পেছনে প্রচুর টাকা, সময় ও সাধনা ব্যয় করতে হয়। একজন ছাত্র তার মেধা ও শ্রম ব্যয় করে সাফল্য অর্জন করে একটি দেশের সম্পদে পরিণত হওয়ার কথা। কিন্তু বড় দুঃখের বিষয় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় দলীয় ছাত্ররাজনীতির কুপ্রভাবে ওই ছাত্রটি দেশের সম্পদ হওয়ার পরিবর্তে দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষাঙ্গনে যখন একজন ছাত্রের হাতে কলম থাকার কথা। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা সেই কলমের পরিবর্তে কৌশলে তুলে দিচ্ছে অস্ত্র। অস্ত্র পেয়ে ছাত্ররা আস্তে আস্তে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে একসময় সে দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিদিন সংবাদ মিডিয়া ও সংবাদপত্রের পাতা খুললেই ছাত্ররাজনীতির নামে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক, ধর্ষণ, খুন, মারামারি, হল দখল, সিট বাণিজ্য, শিক্ষার্থী নির্যাতন, শিক্ষককে মারধর, নিয়োগ বাণিজ্য, হলে হলে টকসার সেল, ভিন্ন মতের মানুষের দমন, দলীয় স্বার্থ হাসিল ইত্যাদির কথা প্রায় শুনে থাকি। এই দলীয় ছাত্ররাজনীতির রোষানলে পড়ে অনেক মেধাবী ছাত্রকে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে। অনেক মা-বাবা তাদের সন্তানকে অল্প বয়সে হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রচারিত কয়েকটি ঘটনাবহুল নিউজ তুলে ধরা হলো: ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে অমানবিক নির্যাতন এবং বিবস্র করে ভিডিও ধারণ, দৈনিক যুগান্তর, ২৭-০২-২৩ইং; একের পর এক শিক্ষার্থী নির্যাতন বেপরোয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ, দৈনিক যুগান্তর ১৮-০২-২৩ইং। ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নে উত্তাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, নয়া দিগন্ত ২২-০৭-২০২২ইং। অস্থিরতা বিরাজ করছে পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়ে, দৈনিক যুগান্তর ১৫-০৩-২০২৩ইং। জাবির হলে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ, কালেরকণ্ঠ ০৪-০২-২০২৪ইং। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা উচিত বলে মনে করেন ৯৩ শতাংশ মানুষ। গত ১৪ই আগস্ট ২০২৪ইং প্রথম আলোর অনলাইন জরিপে এই চিত্র উঠে এসেছে। অবশ্য বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতারা বলছেন, ছাত্ররাজনীতি নয়, দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি চালু থাকতে হবে। সাধারণ ছাত্ররা ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ও অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের দাবি জানান।
দেশে ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্র বিবেচনা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকারের সময় দেখা গেছে, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সে দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেন। কে হলে থাকতে পারবেন আর কে পারবেন না, তা এত দিন নির্ধারণ করতেন ছাত্রসংগঠনের নেতারা।
ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অপহরণের মতো ঘটনাও ঘটিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুধু ২০২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ৩৮টি চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মারধর ও প্রতিপক্ষের ওপর হামলার ঘটনায় নাম এসেছিল ছাত্রলীগের।
রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গসংগঠন হিসেবে কোনো ছাত্রসংগঠন রাখতে পারবে না, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (জাতীয় নির্বাচন সংক্রান্ত আইন) এমন বিধান রয়েছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো কৌশলে ছাত্র সংগঠন রেখে দিয়েছে। ১০ আগস্ট এক সাক্ষাৎকারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ক্যাম্পাসগুলোতে দলীয় লেজুড়বৃত্তি, সন্ত্রাস ও পেশি শক্তিনির্ভর ছাত্ররাজনীতির কোনো প্রয়োজন নেই বলেই শিক্ষার্থীরা মনে করে। মেধা ও জ্ঞানভিত্তিক বিকাশ এবং অধিকার আদায়ের আন্দোলনের জন্য শিক্ষার্থীরা কাজ করবে, জাতীয় স্বার্থে শিক্ষার্থীরা কথা বলবে। ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি ছাত্র সংসদভিত্তিক হওয়া উচিত। কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করার জন্য শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় না। খুব দ্রুতই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ অন্য অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
সর্বশেষ বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের প্রতিবাদে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্লাস বর্জন, পরীক্ষা বর্জন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বুয়েটে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা শিক্ষাঙ্গনে উদ্যোগ ও উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯ সালের ৬ই অক্টোবর রাতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে আবরার ফাহাদ নিহত হয় হওয়ার পর থেকে ছাত্রদের দাবির মুখে সেখানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়।
বুয়েটের ছাত্ররা মনে করে, ছাত্ররা একটা মানসম্মত অবস্থানে পৌঁছেছে। তারা একটা মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে চায়। তথাকথিত ছাত্ররাজনীতির নামে বুয়েটে শিক্ষার যে বিকাশ সেটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মনে করে।
লেখক: সংস্কারক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক