পুঁজিবাজারে এখন আর কেউ স্বপ্ন দেখে না। কেউ আর বলে না- ‘ভবিষ্যতের নিরাপত্তা এখানে লুকিয়ে আছে।’ এক সময় এই বাজার ছিল মধ্যবিত্তের সম্ভাবনার প্রতীক। আজ তা পরিণত হয়েছে এক নির্জন শ্মশানে-যেখানে আমজনতার পুঁজি নিঃশব্দে বিলীন হয়েছে। এটা এখন শেয়ার বাজার নয়, যেন ‘শোক বাজার’। একসময় এখানে মানুষ স্বপ্ন কিনত, এখন কিনে শুধুই হতাশা। আগে যেখানে মুনাফার খবর ছিল, এখন আছে মামলা, হাহাকার আর মাঝেমাঝে টক শোর আলগা প্রতিশ্রুতি। এই বাজার এক সময় ছিল মধ্যবিত্তের-ভরসা ও উত্তেজনার জায়গা। এখন যেন ভাঙা প্রেমের মতো-স্মৃতি আছে, ঘৃণাও আছে; শুধু বিশ্বাসটা উধাও। এক যুগ হয়ে গেল, এই বাজারে কেউ এসে বলে না- ‘এইখানে বিনিয়োগ করো, ভবিষ্যৎ নিরাপদ।’ এখন বলে- ‘ভুলেও ঘেঁষো না ভাই, এখানে বিশ্বাস গিলে ফেলে বুলডোজার!’ প্রতিবারই ‘দরবেশদের’ পকেট ফুলেছে, আমজনতার চোখ ভিজেছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমরা পুঁজিবাজার নিয়ে ‘গল্প’ শুনেছি। কেউ বলেছে, বিদেশি বিনিয়োগ আসবে, কেউ বলেছে, বন্ড মার্কেট খুলবে।
আবার কেউ কেউ বিনিয়োগকারীদের ‘স্মার্ট’ হওয়ার উপদেশ দিয়ে দায় সেরেছেন। অথচ বাস্তবতা হলো- এই বাজারে দুঃসাহসীরা নয়, বরং নিরীহরাই বারবার নিঃস্ব হয়েছে। সম্প্রতি, নতুন আশার আলো জ্বালিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস। তার পুঁজিবাজার সংক্রান্ত ৫টি নির্দেশনা নিঃসন্দেহে সাহসী ও সময়োপযোগী। এই নির্দেশনাগুলোতে ফুটে উঠেছে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ছাপ- যা শুধু সাময়িক ‘মেকআপ’ নয়, বরং সার্জিক্যাল চিকিৎসার দিকে ইঙ্গিত করে। তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন- ১. পুঁজিবাজারে আর খেলাধুলা নয়, ২. পূর্বের দুষ্টচক্রকে চিহ্নিত করতে হবে, ৩. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির রূপরেখা তৈরি করতে হবে, ৪. বিএসইসি ও ডিএসই-এর দায় নির্ধারণ করতে হবে, ৫. ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠন করতে হবে। এই পাঁচটি নির্দেশে একটা সজীবতার ছোঁয়া আছে। মনে হচ্ছে, দীর্ঘশ্বাসের দীর্ঘ সময় পার করে এই প্রথম কেউ বললেন- এই বাজার আমজনতারও। আমরা ভুলে যেতে পারি না ২০১০-১১ সালের ধসের কথা, যেখানে লাখো মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছিল। তখনও বলেছিল কেউ, ‘পুঁজিবাজার স্বাভাবিক’-কিন্তু স্বাভাবিকতা ছিল না কোনো গণমুখী পদক্ষেপে। বরং সেই সময়ের ‘পুঁজিবাজার গেমলাররা’ ছিলেন রাজনীতির ছত্রছায়ায় বেপরোয়া। এখন প্রশ্ন- তাদের চিহ্নিত করা হবে কি? ড. ইউনূসের সদিচ্ছা যদি বাস্তবে রূপ নেয়, তবে পুঁজিবাজার আবারও মানুষের আস্থা ফিরে পেতে পারে। তবে শুধু সদিচ্ছায় পরিবর্তন আসে না। প্রয়োজন সঠিক বাস্তবায়ন, আইনের শাসন, এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত নীতিনির্ধারণ। এই বাজার যেন আর কারও খেলার মাঠ না হয়- এমন প্রত্যাশা আজ দেশের লাখো বিনিয়োগকারীর। মুনাফা নয়, তারা চায় নিরাপত্তা। চায় একটি ন্যায্য প্ল্যাটফর্ম, যেখানে তথ্য থাকবে সবার নাগালে, অনিয়মকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হবে প্রকাশ্যে। আজ যদি আমরা সাহস করে প্রশ্ন না করি- কে খেলেছে এই বাজার নিয়ে, তবে ভবিষ্যতে আর কেউ প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে না। আমরা চাই, এই নির্দেশনাগুলো যেন ওয়াদা না হয়ে যায়। যেন পুঁজিবাজার শুধু গুটিকয়েক ‘অভিজ্ঞ’ জুয়াড়ির আশ্রয় না হয়। আমরা চাই- পুঁজিবাজারে আবার মানুষ আসুক। তবে বিনিয়োগ নিয়ে নয়, বিশ্বাস নিয়ে।
বর্তমান চিত্র, চ্যালেঞ্জ ও করণীয় : পুঁজিবাজারের বর্তমান (২০২৫) বাংলাদেশের চিত্র। ২০২৫ সালে এসে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখনও তার কাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীলতা ও স্বচ্ছতা অর্জন করতে পারেনি। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) দেশের মূল দুটি স্টক এক্সচেঞ্জ হলেও এদের কার্যক্রমে সাধারণ বিনিয়োগকারীর আস্থা এখনও অনেকটা দুর্বল। কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর একচেটিয়া প্রভাব এবং স্বল্প সময়ের মুনাফা অর্জনের প্রবণতা বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। IPO (Initial Public Offering) প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার ঘাটতি, দুর্বল মনিটরিং এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের প্রভাবজনিত অনিয়ম এখনও বিদ্যমান।
উন্নত বিশ্বের পুঁজিবাজারের চিত্র- উন্নত দেশগুলোর পুঁজিবাজার যেমন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ (NYSE) বা লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে (LSE) উচ্চ মাত্রার স্বচ্ছতা, অটোমেশন, শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ কাঠামো এবং বিনিয়োগকারীদের অধিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়। এসব বাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো যেমন- SEC (Securities and Exchange Commission) বা FCA (Financial Conduct Authority) সক্রিয়ভাবে কাজ করে এবং আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়। ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা দৃঢ় হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগপ্রবণতা তৈরি হয়। আর একারণেই এসব বাজার দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। যা বাংলাদেশে বিদ্যমান নেই।
পুঁজিবাজারের ঝুঁকি : বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখনও বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনির্ভরযোগ্য বাজারগুলোর মধ্যে অন্যতম। যদিও এ বাজারে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু কাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, তবুও এটি এখনও অনেক দিক থেকেই অপরিপক্ব। স্বচ্ছতার অভাব, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কারসাজি, দুর্বল রেগুলেটরি বাস্তবায়ন এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ শিক্ষা ও সচেতনতার সীমাবদ্ধতা- সব মিলিয়ে একটি অনিশ্চিত পরিবেশ তৈরি করেছে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে এখনও অনেক কোম্পানি তাদের আর্থিক বিবরণীতে প্রকৃত তথ্য গোপন করে বা ম্যানিপুলেটেড তথ্য উপস্থাপন করে। ফলে বিনিয়োগকারীরা প্রকৃত কোম্পানি মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হন এবং অন্ধভাবে গুজব বা বাজারে ভাসা খবরে ভিত্তি করে বিনিয়োগ করেন। ফলস্বরূপ, ছোট বিনিয়োগকারীরা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ফাঁদে পড়ে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। এসব গোষ্ঠী কখনও কখনও পরিকল্পিতভাবে শেয়ারদরের কৃত্রিম ওঠানামা ঘটিয়ে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করে এবং লাভবান হয়ে বেরিয়ে যায়। এর বিপরীতে, উন্নত বিশ্বের পুঁজিবাজারগুলো তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি স্থিতিশীল ও নির্ভরযোগ্য। যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে শক্তিশালী আইনি কাঠামো, স্বচ্ছ কোম্পানি পরিচালনা, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা এবং কড়া নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা বিদ্যমান। এসব দেশে প্রতিটি তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে নিয়মিত নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয় এবং ভুল বা গোপন তথ্য পরিবেশন করলে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়।
তাছাড়া, উন্নত দেশগুলোতে বিনিয়োগকারীদের জন্য শিক্ষামূলক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে পরিচালিত হয়, যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ শিখতে পারে কীভাবে ঝুঁকি বিশ্লেষণ করতে হয়, কোন কোম্পানিতে বিনিয়োগ নিরাপদ এবং কোন গোষ্ঠীর প্ররোচনায় না পড়াই ভালো। বাংলাদেশে এখনও এই ধরনের আর্থিক সাক্ষরতার উদ্যোগ খুবই সীমিত, যা বাজারে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে একটি নিরাপদ ও আকর্ষণীয় বিনিয়োগের প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর করতে হলে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়ন, বিনিয়োগ শিক্ষা সম্প্রসারণ এবং শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ কাঠামো প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। নতুবা এই বাজার আরও বেশি অনির্ভরযোগ্য হয়ে উঠবে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এতে আগ্রহ হারাতে থাকবে। পুঁজিবাজারকে আস্থার জায়গায় আনতে করণীয়- বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে একটি বিশ্বাসযোগ্য এবং টেকসই বিনিয়োগের প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর করতে হলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে।
(ক) স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা- কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন ও কার্যক্রমের সঠিক তথ্য প্রদানের ওপর জোর দিতে হবে এবং তথ্য গোপন বা মিথ্যা তথ্য প্রদানের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। (খ) কারসাজির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা : বাজারে কারসাজি ও ম্যানিপুলেশনের বিরুদ্ধে নজরদারি বাড়াতে হবে এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। (গ) নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্বাধীনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি: বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (ইঝঊঈ)-এর স্বাধীনতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা আরও কার্যকর করতে হবে। (ঘ) বিনিয়োগ শিক্ষা বৃদ্ধি : সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রশিক্ষণ, ওয়ার্কশপ ও তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক কার্যক্রম চালাতে হবে। (ঙ) ডিজিটালাইজেশন ও স্বয়ংক্রিয়তা : ট্রেডিং ও তথ্য প্রক্রিয়ায় আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজনের মাধ্যমে বাজারের স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা বাড়াতে হবে।
অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার : অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতে, বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখনো একটি অপরিণত, অগঠিত ও সীমিত কাঠামোর মধ্যেই আবদ্ধ রয়েছে। এ বাজার এখনও মৌলিক শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে ভুগছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপকরা একাধিক গবেষণায় তুলে ধরেছেন যে, বাংলাদেশে পুঁজিবাজারের ক্রমাগত ওঠানামা, কারসাজি এবং অস্থিরতার পেছনে সঠিক নীতিমালার অভাব, দুর্বল রেগুলেটরি কাঠামো এবং রাজনৈতিক প্রভাব একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। তাদের মতে, বাজারে কার্যকর তদারকির অভাবে অনেক কোম্পানি আর্থিক তথ্য গোপন করে, যার ফলে বিনিয়োগকারীরা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। এছাড়া তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে সুশাসনের অভাব এবং পরিচালনা পর্ষদের দুর্বলতা বাজারের প্রতি আস্থা তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও প্রকৌশলী প্রয়াত ড. জামিলুর রহমান একসময় বলেছিলেন, ‘বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা না ফিরলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ব্যাহত হবে।’ তার এই মন্তব্য আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ও আস্থাই একটি দেশের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কাঠামো এবং শিল্পোন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হতে পারে। বর্তমানে বিশেষজ্ঞরা একমত যে, দীর্ঘমেয়াদে মূলধন গঠনের জন্য পুঁজিবাজার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন বাজারে নৈতিকতা, জবাবদিহি এবং পেশাদারিত্বের চর্চা। উন্নত বিশ্বে যেভাবে কোম্পানি গভর্ন্যান্স, কর্পোরেট স্বচ্ছতা এবং কড়া নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে বাজারে আস্থা সৃষ্টি করা হয়, বাংলাদেশেও তেমন সংস্কার প্রয়োজন।
অর্থনীতিবিদরা আরও মনে করেন, বাজারে অংশগ্রহণকারী বিনিয়োগকারীদের আর্থিক সাক্ষরতা বাড়ানো, মিডিয়ার ভূমিকা শক্তিশালী করা এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়া গ্রহণ করলেই পুঁজিবাজার দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতির শক্ত ভিত হতে পারে। এখন প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত ও নিরপেক্ষ নেতৃত্ব। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সময় কখন আসবে : বাংলাদেশের শেয়ারবাজার দীর্ঘদিন ধরেই নানা অসঙ্গতি, কারসাজি এবং অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে চলছে। ফলে অনেক বিনিয়োগকারী বাজারে বিনিয়োগ নিয়ে দ্বিধায় রয়েছেন। তবে বিনিয়োগের সঠিক সময় নির্ভর করে কিছু মৌলিক নির্দেশকের উপর। প্রথমত, বাজারে যখন অতিরিক্ত নেতিবাচক মনোভাব বিরাজ করে এবং শেয়ারদর অনেক নিচে নেমে আসে, তখন দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য তা একটি ভালো সুযোগ হতে পারে। কারণ তখন অনেক ভালোমানের শেয়ার অবমূল্যায়িত অবস্থায় পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, বাজারে যখন সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো স্বচ্ছতা, সুশাসন এবং তথ্য প্রকাশে কঠোর ভূমিকা নেয় এবং প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে রাখে, তখন বিনিয়োগের পরিবেশ নিরাপদ হয়ে ওঠে। তৃতীয়ত, বাজারে যখন বড় বিনিয়োগকারী ও প্রাতিষ্ঠানিক ফান্ডগুলোর অংশগ্রহণ বাড়ে, তখন সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরও আস্থা ফেরে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিনিয়োগের আগে নিজস্ব বিশ্লেষণ করা এবং সঠিক মৌলভিত্তির কোম্পানিকে চিহ্নিত করা। বাজারে গুজব বা লোভের ভিত্তিতে নয়, বরং যুক্তি ও তথ্যের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করাই সবচেয়ে নিরাপদ কৌশল। সুতরাং, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সময় তখনই আসবে, যখন বাজারে আস্থা, স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে- আর বিনিয়োগকারী নিজে প্রস্তুত থাকবেন যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নিতে।
পুঁজিবাজার রক্ষায় ইউনূস সরকার কি সফল হতে পারবেন : ড. ইউনূস সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিয়ে নতুন করে আশাবাদ তৈরি হলেও সফলতা নির্ভর করবে তার নেওয়া পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের ওপর। পুঁজিবাজারের দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলো- যেমন স্বচ্ছতার অভাব, প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কারসাজি, দুর্বলনিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা এবং বিনিয়োগকারীদের অজ্ঞতা- এগুলো সহজে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তবে ইউনূস সরকার যদি প্রশাসনিক সংস্কার, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থার উন্নয়ন, কোম্পানির আর্থিক বিবরণীর স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা যেমন বিএসইসি ও ডিএসই-কে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও দক্ষ করে তুলতে পারেন, তবে কিছুটা পরিবর্তন আনা সম্ভব। বিশেষ করে প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য কমাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কঠোর আইন প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া, বিনিয়োগ শিক্ষা ও সাধারণ মানুষের আর্থিক সচেতনতা বাড়ানোও জরুরি পদক্ষেপ। সরকার যদি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে, তবেই দীর্ঘমেয়াদে সফলতা অর্জন সম্ভব।
সুতরাং, ইউনূস সরকারের সফলতা নির্ভর করবে তিনি কতটা আন্তরিক, দৃঢ় এবং নীতিনিষ্ঠভাবে এই খাতের সংস্কারে অগ্রসর হতে পারেন তার ওপর। সুযোগ আছে, তবে চ্যালেঞ্জও ব্যাপক।
উপসংহার : বাংলাদেশের পুঁজিবাজার একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র, তবে এখনও আস্থা ও স্থিতিশীলতার অভাবে পূর্ণ বিকাশ লাভ করেনি। এটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হতে পারে, যদি এটি উন্নত বিশ্বের আদলে স্বচ্ছ, দক্ষ এবং জবাবদিহিমূলক কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে হলে সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং বাজার সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলেই ভবিষ্যতে পুঁজিবাজার দেশের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে।
লেখক : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ