সারা দেশে এখন চলছে ফলের ভরা মৌসুম। মৌসুমি ফলের স্বাদ গ্রহণ করতে সবাই চায় এবং চেষ্টা করে তা পূরণ করতে। ফল শরীরের পুষ্টি জোগায়। শরীরকে সজীব ও সতেজ করে। কিন্তু আজকাল আমরা ফল খাওয়ার নামে কী খাচ্ছি? এককথায় বিষ খাচ্ছি। এসব ফল গাছে যখন মুকুল আসে কীট দমন, ফলের সাইজ বড় করা, রঙিন করা, এমনকি স্বাদ বেশি হওয়ার জন্য কীটনাশক ওষুধ স্প্রে করা হয়। যেখানে মাত্রা, পরিমাণ, মেয়াদ প্রায় মানাই হয় না। আবার নানা প্রকারের বিষ প্রয়োগে বড় হতে হতে আগাম ফল পাকাতে একধরনের হরমোন স্প্রে করা হয়। এর সঙ্গে অতি দ্রুত পাকাতে ও উজ্জ্বল বর্ণ করতে একদিকে কার্বাইড ব্যবহার করা হয়, অন্যদিকে পচন ঠেকাতে ব্যবহার করা হয় ফরমালিন। এখন যেহেতু মুকুলের সময়, তাই এখনই সচেতন হওয়া উচিত। বর্তমানে ফলের রং দেখে বোঝা যায় না কোনটা ফরমালিনবিহীন ফল। বরং ফরমালিনযুক্ত ফলই দেখতে অনেক টাটকা ও পাকা টসটসে দেখায়। অর্থাৎ যে ফলের চেহারা যত ভালো সে ফল তত বেশি বিষযুক্ত। এবং এই ফল শরীরের জন্য বেশি ক্ষতিকর। ফল শরীরে ভিটামিনের অভাব পূরণ করে। কিন্তু ক্যামিকেল দিয়ে পাকানো ফল খাওয়া আর বিষ খাওয়া এক কথা। টাটকা ও অধিক রংযুক্ত ফলের রসে নিহিত থাকে বিষাক্ত বিষ। সুতরাং রং দেখে নয় বরং টাটকা ও সতেজ দেখে ফল কিনুন। ফল খাওয়ার উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। ছোট শিশু থেকে শুরু করে, কিশোর-তরুণ, প্রাপ্তবয়স্ক এমনকি বৃদ্ধদেরও নিয়মিতভাবে ফল খাওয়া উচিত। প্রতিদিন কিছু পরিমাণে হলেও ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। ডাক্তারি বিদ্যায় বলা হয়, ফল শুধু স্বাদের জিনিস নয়। ফল খাওয়া দরকার শরীরে মিনারেল আর ভিটামিনের চাহিদা জোগান দিতে। সেটা বেশি দেশি ফলে। প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি এবং বি কমপ্লেক্স রয়েছে মৌসুমি ফলে। বলা হয়ে থাকে বিদেশি ফলে ফরমালিন বা কেমিকেল মেশানো থাকে। এর উল্টো অর্থ হচ্ছে দেশি ফল কেমিকেলমুক্ত। এই ভরসায় দেশি ফলের প্রতি আকর্ষণ এবং দুর্বলতা অনেকের। কিন্তু, নানা দুঃসংবাদ। দেশি ফলেও ফরমালিন মেশানোর ঘটনা ধরা পড়ছে বিভিন্ন জায়গায়। দেশি ফলের মধ্যে প্রায় সব ফলেই ফরমালিন মেশানো হয়। ইথোফেন নামের বিষাক্ত হরমোনাল স্প্রে দিয়ে কাঁচা ফল পাকানো হয়। আবার পচা ফল তাজা রাখতেও কেমিকেল রয়েছে। সাধারণত কৃষিজমিতে ব্যবহার হলেও এখন কাঁচা ফল পাকাতে এই স্প্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি ফরমালিনের চেয়েও ভয়ানক বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তরমুজের ভেতর সিরিঞ্জ দিয়ে ক্ষতিকর এরিথ্রোসিন বি এবং স্যাকারিন পুশ করে লাল ও মিষ্টি করার কাণ্ডও ধরা পড়েছে। বাদ পড়ছে না, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, আনারস। জাতীয় ফল কাঁঠালও এর বাইরে নয়। এক সময় ‘ঘাই’ দিয়ে কাঁঠাল পাকানোর কথা শোনা যেত। ‘ঘাই’ মানে পেরেক ধরনের একটা রড বা পাইপ দিয়ে বোঁটার দিক ফুটো করে দেয়া। এতে কাঁঠাল দ্রুত পাকে। এখন ঘাইয়ের সঙ্গে বিষও দেয়া হয়। এ তালিকার সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত ফলের নাম কলা। বাংলাদেশে সবরি-চাপা-সাগর কলা উৎপাদন হয়। সময়ের আগে কলায় বিশেষ করে সবরি কলায় হরমোন স্প্রে করা হয়। অপরিণত কলা কেরোসিনের স্টোভের হিট দিয়ে নরম করা হয়। রাইপেন-ইথোফেন বা কার্বাইড স্প্রে করে পাকানো হয়। স্প্রে করার আগে কলা পরিষ্কার করা হয় সার্ফএক্সেল বা শ্যাম্পু দিয়ে। পাকানোর এই বিষাক্ত পদ্ধতি রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কলার আড়তে চলছে হরদম। সেই বিষাক্ত কলা বাজার থেকে কিনে খায় মানুষ। মৌসুমি আরেক দেশি ফল লিচুতেও পাঁচ থেকে ছয়বার কীটনাশক স্প্রে করা হয়। ঝরে না পড়া, বোঁটা শক্ত রাখা, রং চকচকে করাসহ সব কিছুর জন্য বিষ দেওয়া হয়। এখন আবার আমড়া-জাম্বুরায় পর্যন্ত কেমিকেল মেশানো হচ্ছে।
এছাড়া অপরিপক্ব কোনো কোনো ফল পাকাতে ইথোফেনের বাইরে ক্যালসিয়াম কার্বাইডও মেশানো হয়। রং উজ্জ্বল করতে এটি মূলত টেক্সটাইল শিল্পে ব্যবহার হয়। গ্যাস জাতীয় ইথাইলিন ও হরমোন জাতীয় ইথরিল অতিমাত্রায় স্প্রে করে এবং ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করার কারণে ফলগুলো ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে রীতিমতো বিষে পরিণত হয়। এ ফলগুলো খাওয়ার কারণে মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ে বিষাক্ত কেমিক্যাল। এর জেরে শরীরে বাসা বাঁধে নানা অসুখ-বিসুখ। একেবারে সাধারণ চাষি থেকে ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীই সবাই যার যার জায়গায় ফলে বিষ মেশানোর অনৈতিকতার মাধ্যমে মানুষকে রোগী বানানোর কাজটি করছে। লিচু বা আম বাগানগুলো মুকুল আসার আগে-পরে বড় ব্যবসায়ী, সুপার শপগুলো কিনে নেয়। বিষ মেশানোর অপকর্ম তারাও করে। কারও বিবেক স্বাভাবিকভাবে কাজ করে না। মুনাফাই যেন তাদের কাছে শেষ কথা, মানুষের জীবন নয়।
আমদানি করা ফলে ফরমালিন পরীক্ষা করতে ঢাকার বিএসটিআইয়ের অফিসে পাঠালে সময় লেগে যায় মাসখানেক। তদ্দিনে ওইসব ফল পচে যায়। সেইক্ষেত্রে বন্দরে তাৎক্ষণিক ফরমালিন পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা জরুরি। দেশি ফলের ক্ষেত্রে সেই জটিলতা নেই মনে করা হয়। কিন্তু, বাস্তবতা বড়ই কঠিন। বাংলাদেশ থেকে কিছু রপ্তানি করতে হলে কঠোর মান রক্ষা করতে হয়। দেশীয় লেবু, জাম্বুরা ও এমনতর ফল রপ্তানির সময় এনওসি নিতে হয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্র থেকে। সেখানকার কর্মকর্তাদের সামনে এক ধরনের রাসায়নিক দিয়ে ওই ফলগুলো ধুতে হয়। পরে তারা ফাইটোস্যানিটারি সনদ দেন, যেটা ইউরোপের দেশগুলো গ্রহণ করে।
আমাদের দেশ থেকে ফল ও সবজি রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ফলগুলো ধোয়া হয় ফলের গায়ে লেগে থাকা নানা আবরণ ওঠানোর জন্য। এক সময় বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের ফল রপ্তানি হলেই তারা নষ্ট করে ফেলত। পরে তাদের কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়। তাদের প্রতিনিধিদল তিন-চারবার বাংলাদেশ সফরের পর ওই রাসায়নিক দিয়ে ধোয়ার পরামর্শ দেয়। তা-ও সাময়িকভাবে। বছর কয়েক ধরে বাংলাদেশ থেকে ফল রপ্তানির ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকরা সরাসরি বাগান থেকে ফল কেনে। তারা কোনো রাসায়নিক ব্যবহারের চিন্তাও করে না, কারণ ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি হওয়া ফলের ৯৫ শতাংশের ক্রেতা অনাবাসী বাংলাদেশিরা।
বিএসটিআই বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ফলসহ ফরমালিন মেশানো খাদ্যবস্তু শনাক্ত করে। কিন্তু, মানুষ নিশ্চিন্তে ফল কিনতে পারে বা কেমিকেলমুক্ত ফল চেনার কৌশল বাতলে দিতে পারেনি। এ অবস্থায় মানুষকে ফল মুখে দিতে হচ্ছে আল্লাহর হাওলা হয়েই। তবে, কেমিক্যাল মিশ্রিত বা ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে উপসর্গগুলো সম্পর্কে নিয়মিত বলছেন আমাদের চিকিৎসকরা। লক্ষণ হিসেবে রয়েছে পেটে ব্যথাসহ বমি হওয়া, মাথা ঘোরা, মল পাতলা বা হজমবিঘ্নিত হওয়া, শরীরে ঘাম বেশি হওয়া এবং দুর্বল হয়ে যাওয়া, পালস রেট কমে বা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু ভেজাল খাদ্যের কারণে দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ। এ ছাড়া গর্ভবতীদের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা দেশে প্রায় ১৫ লাখ। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বছর কয়েক আগে ফল পাকানো ও সংরক্ষণে কেমিক্যালের ব্যবহার অবৈধ ঘোষণা এবং ফলমূলে কেমিক্যাল ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করতে পুলিশকে নির্দেশ দেন। দূষিত ফল যেন কেউ গুদামজাত ও বিক্রি করতে না পারে তা সর্বদা মনিটর করার জন্য বিএসটিআই ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়। এছাড়া আদালত দেশের স্থল ও নৌবন্দরে আমদানি করা ফল কেমিক্যাল মেশানো কিনা তা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে নির্দেশ দেন। কিন্তু, সেই নির্দেশ পালনের হালনমুনা তো যে কারোই বোধগম্য। সমাজের সর্বস্তরে এমন অবক্ষয়-অনৈতিকতার মাত্রাধিক্য আর কোনো দেশে আছে কি না জানা নেই। তবে ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা-নেপাল-ভুটানেও নেই, তা বলতে পারি। মিয়ানমারের অবস্থাও এমন নয়। থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর-দক্ষিণ কোরিয়া- জাপান কোনো দেশের মানুষ খাদ্যে ভেজাল বা বিষ মেশানোর কথা চিন্তাও করতে পারে না। ইউরোপ-উত্তর আমেরিকায় ফল বা খাবারে ভেজাল বা বিষের কথা কল্পনাও করা যায় না।