ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

স্বেচ্ছায় রক্তদানে এগিয়ে আসতে হবে

আফতাব চৌধুরী
স্বেচ্ছায় রক্তদানে এগিয়ে আসতে হবে

স্বেচ্ছায় রক্তদান যে মোটেই দাতার পক্ষে ক্ষতিকারক নয়, এ কথাটি বিজ্ঞানসম্মতভাবে বুঝে, আত্মস্থ করে, তবেই নিজে রক্তদান করা এবং সেইসঙ্গে অন্যদেরও রক্তদান করতে উৎসাহিত করা উচিত। অন্যথায় আমাদের বিশ্বাসে কোনো দাগ কাটতে পারবে না। তাই, রক্তদান কেন আমাদের পক্ষে ক্ষতিকারক নয়, সে ব্যাপারে মৌলিক কিছু বৈজ্ঞানিক তথ্য নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করছি।

রক্ত বলতে আমরা লাল রংয়ের যে তরল পদার্থকে বুঝি, তা আসলে পানি, বিভিন্ন রকম কোষ, নানা রকম প্রোটিন পদার্থ ও কয়েক প্রকার রাসায়নিক লবণের সংমিশ্রণে তৈরি একটি যৌগ। পঞ্চান্ন শতাংশই কিন্তু পানি। কোষ প্রধানত তিন রকমের লোহিত কণিকা, শ্বেতকণিকা এবং অনুচক্রিকা। অ্যালবুমিন, গ্লোবিউলিন, ফাইব্রিনোজেন প্রভৃতি প্রোটিন পদার্থও থাকে রক্তে। এই সব কিছুই দেহে ঘুরে বেড়ায় বড়-ছোট রক্ত নালীগুলোর ভেতর দিয়ে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে হৃৎপিণ্ড আমাদের দেহের মধ্যে ধুকধুক করতে থাকে ওই হৃৎপিণ্ড এই রক্তকে পায়ের গোড়ালি থেকে মাথার চুলের গোড়া পর্যন্ত দৌড়াতে থাকে। আমাদের দেহটি অসংখ্য (কয়েকশ’ কোটি) কোষ দিয়ে তৈরি। এই কোষগুলো বেঁচে থাকে অক্সিজেনের মাধ্যমে আর পুষ্টি লাভ করে প্রোটিনের মাধ্যমে। অক্সিজেন আর প্রোটিন- এই দুটো বস্তুই প্রতিনিয়ত জোগান দিয়ে যাচ্ছে রক্ত। ফুসফুস থেকে অক্সিজেন কণায় সমৃদ্ধ হয়ে লোহিত কণিকাগুলো ছুটে যায় দেহের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, সঙ্গে থাকে প্রোটিন, ভিটামিন ইত্যাদি। আবার ফিরে আসে কার্বনডাই-অক্সাইড বয়ে নিয়ে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে প্রতিনিয়ত- এমনকি আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি, তখনও। এ জন্যই আমরা বেঁচে আছি। পাঁচ থেকে ছ’মিনিট সময় এই প্রক্রিয়া কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে মৃত্যু অবধারিত।

কোনো কারণে কোনো প্রাণীর দেহ থেকে খুব বেশি পরিমাণে রক্তপাত হলে অথবা রক্তের কোনো প্রকরণের ব্যাপক ঘাটতি হলে রক্ত দিয়েই তার চিকিৎসা করতে হয় এবং সে ক্ষেত্রে আরেকজন সুস্থ মানুষকেই এগিয়ে আসতে হয় রক্তদান করতে। কিন্তু সমস্যা হল, সবাই রক্তদান করতে পারেন না। রক্তদান করার কিছু শর্ত রয়েছে। প্রথম শর্ত হচ্ছে, রক্তদাতার বয়স হতে হবে ১৮ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। দ্বিতীয়ত, তার ওজন হতে হবে ৪৫ কেজি বা আরও বেশি। তৃতীয় শর্ত হলো, ইচ্ছুক দাতার রক্তে হিমোগ্লোবিন বা লোহিত কণিকার পরিমাণ হতে হবে প্রতি ডেসিলিটারে ১২ মিলিগ্রাম বা তার বেশি। এই প্রাথমিক শর্তগুলো ছাড়া আরও কয়েকটি বিষয় দাতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

কুকুরের কামড়ের ইঞ্জেকশন নিয়ে থাকলে এক বছর রক্তদান করা অনুচিত। জন্ডিস বা ম্যালেরিয়া থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পর ছয় মাস রক্তদান করা ঠিক হবে না। বড় অপারেশন হয়ে থাকলেও এক বছর পর্যন্ত রক্তদান করা যাবে না। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ গ্রহণকালে রক্তদান করা অনুচিত। এই নিয়মগুলো মেনে চললে রক্তদানে কোনো অসুবিধা নেই। তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে আরও তিনটি শর্ত থাকবে। গর্ভবতী মহিলাদের রক্ত কখনই দেওয়া ঠিক হবে না। দুগ্ধপোষ্য শিশুর মায়েরাও রক্ত দিতে পারবেন না। তাছাড়া, ঋতুস্রাব চলার দিনগুলোতে মহিলাদের রক্তদান করা যাবে না। লো প্রেসারে যারা ভোগেন তারা রক্তদানে অক্ষম। হাইপ্রেসার, ব্লাড সুগার, থাইরয়েড ইত্যাদি সমস্যার জন্য যারা প্রতিদিন ওষুধ খেতে বাধ্য, তাদের কখনই রক্তদান করা উচিত নয়। রক্তদান তারাই করবেন, যারা উপরে উল্লেখিত সমস্যাবলি থেকে মুক্ত।

আমাদের দেশে বছরে ১০-১৫ লাখ ইউনিট রক্তের প্রয়োজন হয়। আর আমাদের জনসংখ্যা এখন ১৮ কোটির এদিক-ওদিক। অর্থাৎ ১৬ জনের মধ্যে মাত্র একজন যদি বছরে একবার মাত্র রক্তদান করেন, তা হলে আর রক্তের অভাব থাকবে না। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিজন মানুষ তার সারা জীবনে যদি একবার রক্তদান করেন, তবে এই দেশের হাসপাতালগুলোকে রক্তের অভাব হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তা তো হচ্ছেই না, বরং স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমাদের প্রয়োজনীয় রক্তের একটা বৃহৎ অংশ সংগৃহীত হয়ে থাকে পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের কাছ থেকে। রোগীকে বাঁচানোর তাগিদে তার আত্মীয়স্বজনরা টাকা দিয়ে রক্ত কেনেন। তারা জানেন না, পেশাদার মারাত্মক সংক্রমণযোগ্য অসুখ-বিসুখের কথা লুকিয়ে রেখে রক্ত বিক্রয় করে থাকে। ফলে ওই রক্ত পেয়ে রোগী সুস্থ হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো নতুন নতুন অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হতে পারেন। ব্যাপারটা অনেকটা টাকা দিয়ে মৃত্যু কিনে আনার শামিল। এক্ষেত্রে নিজেরা নির্ভয়ে রক্তদান করে টাকা এবং রোগী প্রাণ দুটোই বাঁচাতে পারেন অতি সহজে।

অনেকেই আবার জিজ্ঞেস করেন, রক্তদান করলে দুর্বল কিংবা অসুস্থ হয়ে পড়ব না তো? রক্ত সম্পর্কিত বিজ্ঞানসম্মত ধ্যান-ধারণার ব্যাপক অভাবের ফলেই আমাদের মধ্যে এই ভুল ধারণা বিরাজ করছে। একজন মানুষের দেহে কত পরিমাণ রক্ত থাকবে, সেটা নির্ভর করে তার দেহের ওজনের ওপর। পুরুষ মানুষের দেহে প্রতি কেজি ওজনে রক্ত থাকে ৭০ থেকে ৭৬ মিলিলিটার। মহিলাদের থাকে ৬৬ থেকে ৭০ মিলিলিটার। অথচ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে কেজি প্রতি ৫০ মিলিলিটার রক্তই যথেষ্ট। তা সত্ত্বেও প্রত্যেক কেজিতে আমাদের দেহে গড়ে প্রায় কুড়ি মিলিলিটার রক্ত বেশি থাকে, যাতে ছোটখাটো দুর্ঘটনায় অল্পবিস্তর রক্তপাত হলেও ওই অতিরিক্ত রক্ত থেকে দেহের প্রয়োজন মিটে যায়। আমরা যখন রক্তদান করি, তখন ওই অতিরিক্ত রক্তের তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র দান করি। তাছাড়া আরেকটা তথ্য আমাদের জেনে রাখা দরকার। মানবদেহের যে স্বাভাবিক হজম এবং জারণ প্রক্রিয়া চালু রয়েছে, তাতে আমাদের নিত্যদিনের খাদ্য থেকেই প্রতিদিন প্রায় ৪০০ মিলিলিটার রক্ত প্রস্তুত হয়ে যেতে পারে। তার জন্য মাছ-মাংস-ডিমণ্ডদুধের কোনো প্রয়োজন নেই, পেট ভরা ডাল-ভাত-সবজিই যথেষ্ট। আসলে আমাদের সমাজব্যবস্থা শ্রেণিবিভক্ত হওয়ায় আমাদের বিত্ত-বৈভবে যতই আকাশ-পাতাল ফারাক থাকুক না কেন, প্রকৃতির নিয়মে কোনো ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ নেই। তাই খাদ্যের সস্তা-দামি তফাতে রক্ত তৈরির কোনো কম-বেশি নেই। নিয়মিত দামি দামি খাবার খাওয়া মানুষের দেহে যতটা রক্ত রয়েছে, নুন-ভাত খাওয়া একজন গরিব মানুষের দেহে তার চেয়ে এক ফোঁটা রক্তও কম নেই। অতএব, ভালো-মন্দ খেতে পাই না বলে রক্তদানে দুর্বল হয়ে পড়ব- এ একেবারে ভুল ধারণা।

দান করা রক্তের পরিমাণটা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পূরণ হয়ে যায়, কাজেই রক্তদানের ফলে অসুস্থ হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।

রক্ত সংগ্রহের ব্যাগ-প্যাকেটগুলোতে প্রত্যেকটির জন্য আলাদা আলাদা সূঁচ লাগানো থাকে এবং একজন দাতার শরীরে ব্যবহার করার পর সেটা নষ্ট করে ফেলা হয় আগুনে পুড়িয়ে। কাজেই সেদিক থেকেও সংক্রমণ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তা সত্ত্বেও কেউ কেউ যে মাথা ঘোরানোর কথা বলেন বা বমি করে ফেলেন, তার দুটো কারণ রয়েছে। প্রথম এবং প্রধান কারণটি হচ্ছে ভয়। মনের মধ্যে রক্তদান সম্পর্কে ভয় থাকলে তা থেকে মাথা ঘোরাতে পারে, বমি হতে পারে। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, রক্তদানের আগে-পরে মেনে চলার নির্দেশিকা মান্য না করা। রক্তদানের আগে মনে রাখতে হবে, খালি পেটে রক্ত দিতে নেই। আবার ভরপেট খেয়ে উঠেই রক্তদান করা উচিত নয়। খাওয়ার পর কমপক্ষে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করা দরকার। আর রক্তদানের পর পাঁচণ্ডসাত মিনিট শুয়ে বিশ্রাম নেওয়া এবং এক গ্লাস পানি খাওয়া খুবই প্রয়োজনীয়। তাছাড়া রক্তদানের পর এক ঘণ্টা ড্রাইভিং করা অথবা সিঁড়ি বেয়ে দোতলা-তিনতলায় ওঠা নিষেধ। বিজ্ঞান নির্দেশিত এই নিয়মগুলো মেনে চললে রক্তদান সম্পূর্ণ নিরাপদ।

রক্তদান করলে দাতাও কিন্তু পরোক্ষ লাভবান হন। তার রক্তের নানা রকম পরীক্ষা বিনা টাকাতেই হয়ে যায়। কোনো রোগব্যাধির জীবাণু রক্তে ধরা পড়লে সময়মতো চিকিৎসা করানো যায়। শরীরে যে নতুন রক্তকণিকা জন্মায়, সেগুলো দাতার শরীরকে সতেজ সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। নিজের বা আত্মীয়স্বজনের প্রয়োজন হলে বিনা এক্সচেঞ্জে এক প্যাকেট রক্ত পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা, একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের প্রাণ রক্ষা করতে পেরে এক নির্মল স্বর্গীয় প্রশান্তি আসে মনে। চোখ দান-দেহ দান এই সবই করা যায় মৃত্যুর পর; কিন্তু জীবিতাবস্থায়ই দেড়শ’বারেরও বেশি রক্তদান করার তৃপ্তি একজন মানুষকে এক মহান উচ্চতায় স্থাপিত করে। সর্ব পর্যায়ের মানুষকে তাই স্বেচ্ছায় রক্তদানে আরও বেশি করে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত