দীর্ঘদিন ধরে নানা সমস্যা-সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দেশের বৃহত্তম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সারাদেশের শতবর্ষী কলেজ থেকে শুরু করে জেলা, বিভাগীয় শহরের অনেক নামকরা কলেজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সবমিলিয়ে ২,২৮৩টি কলেজের মধ্যে ৫৫৫টি সরকারি কলেজ রয়েছে। এসব অধিভুক্ত কলেজগুলোয় প্রায় ৩২ লাখের মতো শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে। ১৯৯২ সাল থেকে এখন অব্দি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার অধিভুক্ত কলেজগুলো নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তবে শুরু থেকে বিরাট সংখ্যক এই শিক্ষার্থী নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিমশিম খেয়ে আসছে। তিন দশকের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এখনও নানামুখী সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। নব্বই দশক থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে শিক্ষা নিয়ে নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে।
নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজপ্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলে অবহেলা আর বঞ্চনার প্রতীক হয়ে দেশের সর্ববৃহৎ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও বর্তমান যুগে তুলনামূলক পিছিয়ে আছে। বিভিন্ন সময় এর পেছনের নানা কারণ উদ্ঘাটন করলেও তার কোনো সমাধান হয়নি। আ. লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করছে। শিক্ষা বোর্ড, মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিভাগে বদলি পদায়ন হয়েছে অনেক কর্মকর্তার। সবশেষ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম আমানুল্লাহ। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে আসার পর শিক্ষার মানোন্নয়ন বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করা, উপস্থিতি বাড়ানো, ইনকোর্স পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনাসহ নানা বিষয়ে কাজ শুরু করেন। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংকট মোকাবিলা করে তার গ্রহণ করা এসব পদক্ষেপ কতটা ফলপ্রসূ হবে?
সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে নতুন কিছু নীতিমালা এনেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বলা হয়েছে, কমপক্ষে ৬০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা যাবে না, ইনকোর্স পরীক্ষা হবে দুইবার এবং মূল্যায়িত উত্তরপত্র আর হাজিরা শিট সিলগালা করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে। সেখানে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করার জন্য এবং ইনকোর্স পরীক্ষায় অনেক শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থেকেও ভালো নম্বর পেয়ে যায় বলে এমন পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মূল জায়গায় সংস্কার না করে মাঝপথে এসে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করলে তা কি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে? উত্তরে নানা আলোচনা সমালোচনা চলে আসবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনেক নামকরা কলেজে হাজার হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যন্ত। এখানে দেখা গেছে, দেশের বেশিরভাগ প্রত্যন্ত এলাকা এবং দারিদ্র্য পরিবারের ছেলেমেয়েরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোতে ভর্তি হয়। আর যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারে, তাদের একটু টাকা-পয়সা থাকলে তারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যায়। এরমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করে তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাস করে।
আবার অনেকে নিজের খরচ নিজে চালাতে না পেরে বা সংসারের খরচ চালাতে গিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। ফলে তারা চাইলেও নিয়মিত ক্লাসে আসতে পারে না। আবার নতুন নিয়মে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত হতে না পারলে তারা মূল পরীক্ষায় বসতে পারবে না। এর ফলে আগের থেকে শিক্ষার্থীরা ক্লাসমুখী হচ্ছে। কিন্তু এতো এতো শিক্ষার্থীকে ক্লাসে বসার জায়গা দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। নেই পর্যাপ্ত ক্লাসরুম কিংবা অনান্য সুযোগ সুবিধা। নিঃসন্দেহে শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করার বিষয়টি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু তাদের বসার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা বা পর্যাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়াটাও জরুরি বলে মনে করছি। নিশ্চয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা নিয়মনীতি প্রণয়ন করেন তাদের অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।
অনেক সময় দেখা গেছে, সরকারি এই ৫৫৫টি কলেজ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করার জন্য তাদের অবস্থা আরো নাজুক। নেই পর্যাপ্ত ক্লাস রুম, নেই কোনো ল্যাব বা অনান্য সুযোগ-সুবিধা। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক জায়গায় এক বা দুজন শিক্ষক একটি বিভাগ পরিচালনা করেন এমন খবরও মাঝেমধ্যে খবরের পাতায় উঠে আসে। বেশিরভাগ সময় এসব কলেজে শিক্ষকের পোস্টিং হলে তারা শহরের দিকের যেসব কলেজ রয়েছে, সেখানে বদলি হওয়ার চেষ্টা করে। ফলে শিক্ষকদের ওই জায়গা শূন্য থেকে যায়। দু’একজন শিক্ষক নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন এমন অবস্থা থাকায় এতে শিক্ষার্থীরাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে এসব সমস্যার আগে সমাধান করা প্রয়োজন। যাতে কোনোভাবে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট না হয়। এজন্য শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে এসে শুধু শিক্ষার্থীদের ক্লাসে আসার নিদের্শনা দিলে তা হয়তো কাঙ্ক্ষিত ফলাফল বয়ে আনবে না; বরং এসব নিয়মনীতির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সমস্যা-সংকটগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে।
যদি ব্যাংকগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের স্বল্প লাভে ঋণ দেওয়া যায়, তাহলে তাদের আর্থিক সংকট অনেকটা দূরীভূত হবে। এমনভাবে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে পরবর্তীতে কর্মে নিয়োজিত হয়ে আস্তে আস্তে তারা সেগুলো পরিশোধ করতে পারে। আমরা দেখেছি, বছরের পর বছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ঠিকমতো কাজ করে না। ফলে প্রতিটি বর্ষের শিক্ষার্থীদের ফর্ম পূরণ এবং ফলাফল প্রকাশের সময় দীর্ঘ সময় ধরে ভোগান্তি পোহাতে হয়। এটি নিয়ে প্রতিবছর আলোচনা-সমালোচনা হলেও তা এখন পর্যন্ত সমাধান হয়নি। এর দিকেও নজর দেওয়া জরুরি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট নামক শব্দটি একটি সময় খুব বেশি পরিচিত থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে তা কাটিয়ে ওঠা গেছে। তবে সমস্যাটি পুরোপুরি সমাধান হয়নি। চার বছরের স্নাতক শেষ করতে এখনো পাঁচ বা ছয় বছর লেগে যায়। এমনভাবে সিলেবাস প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন যাতে সময়মতো শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষ করতে পারে।
আমরা জানি, একটি পরিকল্পিত এবং উন্নত অবকাঠামো শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার্থীদের জন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা গেলে তা অবশ্যই আমাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে। তাই দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় শ্রেণীকক্ষ, লাইব্রেরি, গবেষণাগার, খেলার মাঠ, ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে সার্বিকভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি আমরা আশা রাখি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মনীতি, যেখান থেকে পরিবর্তন বা নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তারা যেন অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সকল কলেজ এবং অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধাগুলো বিবেচনা করে দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যাতে কোনোভাবেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি ইতিবাচক চাপ তৈরি করতে গিয়ে তার ফলাফল বিপরীত মেরুতে চলে না যায়।
লেখক : শিক্ষার্থী, সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা।