বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এবং সংস্কৃতিতে দেশীয় কাগজ শিল্পের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বায়নের এই যুগে বিদেশি কাগজের সহজলভ্যতা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার দেশীয় কাগজশিল্পকে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই শিল্পের বিলুপ্তি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয়, বরং আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং কর্মসংস্থানের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
উন্নত-অনুন্নত প্রায় সব দেশই নিজেদের শিল্পভিত্তিকে শক্ত করার চেষ্টা করে। নিজস্ব অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করা এবং নিজস্ব জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করায় নিজস্ব শিল্প বিকাশের কোনো বিকল্প নেই। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশও তা-ই চায়; কিন্তু কখনও কখনও সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত ও তার অপপ্রয়োগ সেই ধারাবাহিকতাকে ক্ষুণ্ণ করে। তেমনি একটি সিদ্ধান্ত হচ্ছে শুল্কমুক্ত বন্ড সুবিধার আওতায় পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য কাগজ আমদানি করতে দেওয়া।
কাগজ শুধু লেখার মাধ্যম নয়, এটি সভ্যতার অগ্রগতি এবং সংস্কৃতির ধারক। প্রাচীনকাল থেকেই হাতে তৈরি কাগজের একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আমাদের দেশে বিদ্যমান। পুঁথি, পাণ্ডুলিপি এবং বিভিন্ন লোকশিল্পে দেশীয় কাগজের ব্যবহার ছিল অপরিহার্য। এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা মানে আমাদের পূর্বপুরুষদের জ্ঞান এবং সৃষ্টিকে সম্মান জানানো। আধুনিক যুগেও, হাতে তৈরি কাগজের একটি বিশেষ আবেদন রয়েছে, যা বিদেশি মেশিনে তৈরি কাগজ দিতে পারে না। এর টেক্সচার, স্থায়িত্ব এবং পরিবেশবান্ধব বৈশিষ্ট্য একে অনন্য করে তোলে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দেশীয় কাগজ শিল্পের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। এই শিল্প প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে চলেছে। বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (ঝগঊ) হিসেবে অনেক কারখানা পরিচালিত হচ্ছে, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকায় সহায়ক। বিদেশি কাগজের উপর নির্ভরশীলতা বাড়লে এই কর্মসংস্থানগুলো ঝুঁকির মুখে পড়বে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। উপরন্তু, দেশীয় কাগজ উৎপাদন দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করে, যা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। দেশীয় কাগজ শিল্প, বিশেষ করে যেখানে বর্জ্য পদার্থ বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ ব্যবহার করা হয়, তা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত উপকারী। অনেক দেশীয় কাগজ কারখানা পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়ার উপর জোর দেয়, যা কম শক্তি ব্যবহার করে এবং কম বর্জ্য উৎপন্ন করে। বিদেশি কাগজ আমদানির ক্ষেত্রে দীর্ঘ পরিবহন পথের কারণে কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়। স্থানীয়ভাবে কাগজ উৎপাদন পরিবেশের উপর চাপ কমায় এবং টেকসই উন্নয়নে সহায়তা করে। এছাড়াও, কাগজ একটি নবায়নযোগ্য সম্পদ এবং এর পুনর্ব্যবহার পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
যথাযথ দেখভালের অভাবে একটি অসাধু চক্র বিপুল পরিমাণ কাগজ আমদানি করছে এবং শর্ত ভেঙে সেগুলো খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। এর ফলে দেশীয় কাগজশিল্পের অস্তিত্ব হুমকির মুখে এসে পড়ছে। দেশে নিবন্ধিত পেপার মিলের সংখ্যা ১২৮। এর মধ্যে ১০৬টি মিলের কাগজ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে বছরে ১৬ লাখ মেট্রিক টন। কাগজের অভ্যন্তরীণ চাহিদা রয়েছে ৯ লাখ মেট্রিক টন। মিলগুলো অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত কাগজ ৪০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করছে। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। এই খাতে প্রত্যক্ষভাবে ২৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে এবং পরোক্ষভাবে এক কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। দেশীয় কাগজশিল্পের উদ্যোক্তারা এই খাতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। কাগজশিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে ৩০০টির বেশি সহায়ক শিল্প গড়ে উঠেছে। এই খাত প্রতিবছর পাঁচ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব দিয়ে আসছে। আমদানি বিকল্প শিল্প হিসেবে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) নির্ধারিত স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী চাহিদার সব কাগজ সরবরাহে সক্ষমতা রয়েছে দেশীয় মিলগুলোর।
২০ বছর ধরে এনসিটিবির সরাসরি কেনা কাগজ দেশীয় মিলগুলো নির্ধারিত গুণগত মান বজায় রেখে এবং এনসিটিবির সব শর্ত পরিপালন করে সরবরাহ করে আসছে। তা সত্ত্বেও কাগজ আমদানির জন্য প্রযোজ্য শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) মওকুফ করা হয়। এর ফলে এনসিটিবির কার্যাদেশ পাওয়া মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশীয় মিলের কাগজ না কিনে বিনা শুল্কে ছাপার কাগজ আমদানি করছে এবং শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানির শর্ত ভঙ্গ করে খোলাবাজারে তা বিক্রি করে দিচ্ছে, যা দেশীয় কাগজশিল্পের অস্তিত্বের জন্য বিরাট হুমকিস্বরূপ। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে এসব তথ্য তুলে ধরে আমদানিতে শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমএ)। সংগঠনটির পক্ষে এর আগেও শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে দেওয়া আবেদনে বলা হয়, দেশীয় কাগজকলগুলোর দেশের চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদনক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিদেশ থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাগজ আমদানি করা হচ্ছে এবং খোলাবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে দেশীয় কাগজশিল্প। এই অবস্থায় ছাপার জন্য কাগজ আমদানিতে শুল্ক মওকুফের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছে বিপিএমএ।
দেশীয় কাগজশিল্প আজ বেশ কিছু গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন : কম দামে এবং উন্নত ফিনিশিংয়ের বিদেশি কাগজের সহজলভ্যতা দেশীয় শিল্পের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তির অভাবে দেশীয় কারখানাগুলো গুণমান এবং উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ছে। কাগজ তৈরির কাঁচামাল, যেমন মণ্ড, পাল্প, বা বর্জ্য কাগজের মূল্যবৃদ্ধি উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। অনেক সময় সরকারি নীতি সহায়তা বা প্রণোদনার অভাব শিল্পটিকে দুর্বল করে তোলে। দেশীয় কাগজের বাজারজাতকরণ এবং ব্র্যান্ডিংয়ে দুর্বলতা একটি বড় সমস্যা।
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে দেশীয় কাগজ শিল্পের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি : আধুনিক এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করা অপরিহার্য। এতে উৎপাদন খরচ কমার পাশাপাশি পণ্যের গুণমানও বাড়বে। সরকারের পক্ষ থেকে শুল্ক হ্রাস, ভর্তুকি এবং সহজ ঋণ সুবিধার মতো নীতি সহায়তা প্রদান করা উচিত। এতে দেশীয় উৎপাদনকারীরা বিদেশি প্রতিযোগিতার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে। দেশীয় কাগজ উৎপাদনকারীদের পণ্যের গুণমান উন্নত করতে হবে এবং নিত্যনতুন ডিজাইন ও বৈচিত্র্য নিয়ে আসতে হবে। হাতে তৈরি কাগজ, পরিবেশবান্ধব কাগজ, বা বিশেষায়িত কাগজের মতো নির্দিষ্ট খাতের উপর জোর দেওয়া যেতে পারে। ভোক্তাদের মধ্যে দেশীয় পণ্যের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ধারণাকে জনপ্রিয় করতে হবে। নতুন কাঁচামাল এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়া উদ্ভাবনে গবেষণা ও উন্নয়নকে উৎসাহিত করতে হবে।
দেশীয় কাগজশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা শুধু একটি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং পরিবেশের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার। সরকার, শিল্প উদ্যোক্তা এবং ভোক্তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকে ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষিত রাখতে। আমরা কি আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে বিলীন হতে দেব, নাকি সম্মিলিতভাবে এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে অংশ নেব?