২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর দেশজুড়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে শুরু হয়েছে এক ভিন্নতর যুদ্ধভর্তি। এই যুদ্ধে অস্ত্র হলো- GPA -৫, কোচিং প্রস্তুতি ও অভিভাবকদের আকাঙ্ক্ষা। লক্ষ্য- দেশের সেরা কলেজগুলোর একটি আসন। অথচ দেশের অধিকাংশ কলেজে হাজার হাজার আসন খালি থাকলেও কিছু প্রতিষ্ঠানে একটি আসনের জন্য লড়ছে ৭-১০ জন শিক্ষার্থী। এমন অসম প্রতিযোগিতা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ভারসাম্যহীনতা ও চাহিদার অসম বণ্টনেরই প্রতিচ্ছবি।
এসএসসি ২০২৫ : পরিসংখ্যান বলছে কী? ২০২৫ সালে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৯,০৪,০৯০ জন। এরমধ্যেই ১৩,০৩,৩৩১ জন উত্তীর্ণ হয়েছে। পাসের হার ৬৮.৪৫ শতাংশ গত বছরের তুলনায় অনেক কম। সর্বোচ্চ গ্রেড GPA -৫ পেয়েছে ১,৩৯,০৩২ জন শিক্ষার্থী। ঢাকা বোর্ডে GPA -৫ পেয়েছে ৬৪,৯৮৪ জন। মাদ্রাসা বোর্ডে এ সংখ্যা ১৪,২০৬ জন এবং কারিগরি বোর্ডে ৫,৬১৫ জন। বোর্ডভিত্তিক পাসের হারের দিক থেকে রাজশাহী (৭৭.৬৩ শতাংশ) ও মাদ্রাসা বোর্ড (৭৯.৩৭ শতাংশ) এগিয়ে থাকলেও সারা দেশে সমগ্র ফলাফল নিয়ে একটি ‘ভর্তি সংকট’ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। স্বনামধন্য কলেজে ভর্তির প্রতিযোগিতা, ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোর শীর্ষস্থানীয় ৩০৪০টি কলেজেই শিক্ষার্থীদের চোখ। যেমন- রাজশাহী কলেজ : আসন ৩,৪৭০, আবেদন ২৫,০০০+ আজিজুল হক কলেজ : বগুড়া : আসন ৩,৫০০, আবেদন ৫,০০০+ মতিঝিল আইডিয়াল কলেজ, ঢাকা : আসন ২,২০০, আবেদন ২১,০০০+ অন্যদিকে সারাদেশে রয়েছে- ৯,৩৪৬টি কলেজ এবং মোট আসন সংখ্যা ২৭,৮৮,৩৪৯টি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এসব আসনের মধ্যে প্রায় ১৪১৫ লাখ আসন ভর্তি মৌসুম শেষে খালি পড়ে থাকে।
তাহলে প্রশ্ন হলো- কেন এই বৈপরীত্য?
১. কেন্দ্রিক মানসিকতা ও আস্থার অভাব শহরের স্বনামধন্য কলেজগুলো ছাড়া অধিকাংশ কলেজে শিক্ষার্থীরা যেতে চায় না। কারণ, তাদের ধারণা- এসব কলেজে পড়লে উচ্চশিক্ষায় সুযোগ পাওয়া সহজ হয়। জেলা-উপজেলার অনেক কলেজে শিক্ষক সংকট, পাঠদান বিঘ্ন, অনুপ্রাণহীন পরিবেশ- সবমিলিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষার অনুপস্থিতি শিক্ষার্থীদের আস্থা নষ্ট করেছে। ২. একাডেমিক সফলতা বনাম সামাজিক সফলতা শুধু ভালো গ্রেড নয়, ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তিকেই অনেক পরিবার ভবিষ্যতের গ্যারান্টি ধরে নেয়। GPA -৫ না পাওয়া মানে অনেকের কাছে ব্যর্থতা। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন- উন্নত বিশ্বে স্কিলস ও সক্ষমতা বেশি গুরুত্ব পায়, প্রতিষ্ঠান নয়।
৩. প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা অনুপস্থিত : বিশ্বে যখন ডিজিটাল শিক্ষা, অনলাইন সার্টিফিকেশন ও স্কিলভিত্তিক কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হচ্ছে, তখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনও প্রচলিত কাঠামোয় আবদ্ধ। ফলে, শিক্ষার্থীরা বিকল্প কোনো সুযোগকেই গুরুত্ব দিতে পারছে না।
শিক্ষার্থীদের জন্য করণীয় : সর্বোচ্চ নম্বর না পেলেও শিক্ষা থেমে যায় না। শুধু ঢাকামুখী হয়ে নয়, নিজের জেলা বা উপজেলার প্রতিষ্ঠিত কলেজে ভর্তি হলেও ভালো ফল ও উচ্চশিক্ষায় সফলতা সম্ভব। কারিগরি ও স্কিল-বেইজড শিক্ষায় ঝুঁকুন। বিশ্বের হাজারো শিক্ষার্থী আজ ফ্রিল্যান্সিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, অ্যাপ ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক কাজে আত্মনিয়োগ করছে। এড়ড়মষব, গরপৎড়ংড়ভঃ, গবঃধ-এর সার্টিফিকেশন এখনই আপনি নিতে পারেন।
ইন্টারনেটকে গঠনমূলক কাজে লাগান : YouTube, Coursera, Udemy, Khan Academy এসব প্ল্যাটফর্মে রয়েছে হাজারো ফ্রি ও পেইড কোর্স, যেগুলো দক্ষতা ও ভবিষ্যৎ গড়তে কার্যকর।
অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান : সন্তানের প্রতিটি ফলাফলকে সাফল্য বা ব্যর্থতার মানদ-ে না দেখে তার আগ্রহ, মনোবল ও সম্ভাবনার দিকে মনোযোগ দিন। GPA -৫ না পেলেও ভালো কলেজে না উঠলেও সন্তানকে ভালোবাসুন, সহযোগিতা করুন। বিকল্প পথকে দ্বিতীয় শ্রেণির বলে ভাববেন না। অনেক সময় বিকল্প পথই সবচেয়ে কার্যকর হয়।
সমাজকর্মী ও শিক্ষার্থী ফুলছড়ি সরকারি কলেজ জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধ