ঢাকা শুক্রবার, ০৮ আগস্ট ২০২৫, ২৪ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

টাঙ্গুয়ার বাঁচাতে প্রয়োজন পর্যটন নিয়ন্ত্রণ

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র
টাঙ্গুয়ার বাঁচাতে প্রয়োজন পর্যটন নিয়ন্ত্রণ

টাঙ্গুয়ার হাওরকে মাদার অফ ফিসারিজ বলা হত এক সময়। এক সময় মানে এখন তা অতীত হতে চলেছে। কেননা, এসবের অনেক কিছুই আগের মতো নেই। টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলায় অবস্থিত। এখানে ১৮টি মৌজা ও ৫১টি জলমহাল রয়েছে। এর আয়তন ৯ হাজার ৭২৭ হেক্টর। এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি। এটি স্থানীয়ভাবে নয়কুড়ি কান্দার ছয়তুড়ি বিল নামে পরিচিত, যেখানে ৭৪টি বিল রয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম রামসার স্থান সুন্দরবন, এরপরেই এই হাওর। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝর্ণা এসে এখানে মিশেছে। ২০০০ সালে ২০ জানুয়ারি এটি রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। টাঙ্গুয়ার হাওরটি জলমহাল হিসেবে আগে ইজারা দেওয়া হত। ১৯৯৯ সালে একে সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার ভেতর দিয়েই ইজারা প্রথার বিলুপ্তি ঘটে।

২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন। হাওরে ৮৮টি গ্রামে ৬০ হাজারের মত মানুষ বসবাস করে। টাঙ্গুয়ার হাওর ছিল এক সময় জীববৈচিত্র্যের লীলাভূমি। এখানে ১৪১ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। মাগুর, বাইম, গুলশা, চিতল, কালবাউশ, টেংরা, গজার, বেতি, কাকিয়া প্রভৃতি মাছ অন্যতম। নানা প্রজাতির জলজ উদ্ভিদও এদের বিশেষ সৌন্দর্যকে ধরে রেখেছে। যেমন হিজল, হেলেঞ্চা, পানি ফল, নলখাগড়া, শালুক, শাপলা ইত্যাদি। এখানে শীতকালে ২৫০ প্রজাতির অতিথি পাখিও আসে। এছাড়া ১৩ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৬ প্রজাতির বিলুপ্ত কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি, ২১ প্রজাতির সাপ ও ২৬ প্রজাতির বিভিন্ন বন্যপ্রাণী রয়েছে- প্রতিনিয়ত প্লাস্টিক বর্জ্য, অতিমাত্রিক মৎস্য আহরণ, আগাছা নাশ, বন উজাড়, মাটি ক্ষয় এবং প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে হারাতে বসেছে অপরূপা এই হাওরের সোন্দর্য। টাঙ্গুয়ার হাওরকে পর্যটক আকর্ষণ করার মূল কারণ হলো এখান থেকেই অদূরের মেঘালয় পর্বত। এখানকার স্বচ্ছ পানি, অসংখ্য পাখি ও হিজল করচ বন একটা আলাদা সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে।

জীববৈচিত্র্যের মারাত্মকভাবে হারিয়ে যাওয়া এবং মাছের সংখ্যা হ্রাস পাওয়াতে হাওরের মানুষের জীবন-জীবিকাও হুমকির মুখে পড়েছে। বিশ বছর আগেও এই হাওরে পাখি আসত ৫ লাখ। এখন তা কমে ১ লাখে এসেছে। ১৩৫ প্রজাতির মাছ ও ২৫০ প্রজাতির পাখি এ অঞ্চলে দেখা যায়। প্রতি বছর এখানে শীতকালে হিমালয়, চীন ও সাইবেরিয়া থেকে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আসে। ২৫০ প্রজাতির পাখির মধ্যে ৩০ প্রজাতির বুনো হাঁসের দেখা মেলে। এছাড়া বালিহাঁস, গাঙচিল, বালিহাঁস, গাঙচিল, সারস, কাক, শঙ্খচিল, তো রয়েছেই। বিরল পাখির মধ্যে রয়েছে লাল ঝুটি, ল্যাঞ্জা হাঁস, খুন্তে হাঁস, নীল মাথা হাঁস, টিকি হাঁস, ধলা বালি হাঁস, পান মুরগি, সরালি, রাজ সরালি, পাতি মাছ রাঙা, চখাচখি ইত্যাদি। এখানে ২০০ প্রজাতির জলজপ্রাণী যেমন রয়েছে, তেমনি কমপক্ষে ১৩৫ প্রজাতির মাছও রয়েছে। চিতল, বাইম, কালবাউশ, মাগুর, বাইম, তারা বাইম, টেংরা, তিতনা, গজার, গরিয়া এসব মাছের দেখা মিলে। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব এর জরিপ মতে ২০১৮ সালে ৬০ হাজার পাখি গণনা করা হলেও এখন তা ২৭ হাজারে নেমে এসেছে।

মাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার মূল কারণ মনুষ্যসৃষ্ট পরিবেশ দূষণ। মাছ ধরার অবৈধ জাল, মাছের পোনা আহরণ, নৌকার কারণে নানাবিধ দূষণ, কুষিতে কীটনাশক ব্যবহার মাছের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। মাছের ৫৪টি বিলের মধ্যে মাত্র ১২টি বিল মাছ ধরার জন্য নিষিদ্ধ করা হলেও অনেকের তথ্য মতে সেখানেও জেলেদের মাছ ধরতে দেখা যায়। টাঙ্গুয়ার হাওরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য জলজ গাছপালা। এটিও হারাতে বসেছে দিন দিন। হাওরের তীর ঘেষে হিজল ও করচ গাছ দেখা যায়। এসব গাছে মাছ ও পাখপাখালি আশ্রয় নেয়। কৃষিজমি বৃদ্ধি ও জ্বালানির কারণে এসব গাছ কাটা হচ্ছে। টাঙ্গুয়ার হাওরকে পর্যটক আকর্ষণ করার মূল কারণ হলো এখান থেকেই অদূরের মেঘালয় পর্বত। এখানকার স্বচ্ছ পানি, অসংখ্য পাখি ও হিজল করচ বন একটা আলাদা সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। এছাড়া পানিফল, বনতুলশি, নলখাগড়া, শালুক, শাপলা, হেলেঞ্চা তো আছেই।

সম্প্রতি দুটি বিশ্ববিদ্যালয় যে গবেষণা করেছে তাতে হাওরের পানিতে নিকেল, ক্রোময়িাম, সিসা, জিংক, তামা ও ম্যাঙ্গানিজ নামের ছয়টি ভারী ধাতু পেয়েছেন। দেখা গেছে সেখানকার বারেক টিলার জলে ভারী ধাতুর উপস্থিতি বেশি। এছাড়া প্রতি লিটার হাওরের পানিতে ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে ০.৩৬৪ মিলিগ্রাম, নিকেল পাওয়া গেছে ০.৩৭৩ মিলিগ্রাম। পানিতে এগুলো থাকলেই ক্ষতিকর তা নয়। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি মানদ- রয়েছে। প্রতি লিটারে কত মিলিগ্রাম থাকলে এটি ক্ষতিকর ধরা হবে তা বলে দেওয়া আছে। তাতে বলা আছে প্রতি লিটারে ক্রোমিয়াম সর্বোচ্চ ০.০৫ মিলিগ্রাম থাকতে পারে। আর নিকেল প্রতি লিটারে ০.০৭ মিলিগ্রাম থাকতে পারে। এর বেশি মাত্রায় থাকলে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ধরা নেওয়া হবে। বাংলাদেশের এ সংক্রান্ত বিধিমালায় সর্বোচ্চ মাত্রা দেওয়া আছে ০.০২ মিলিগ্রাম। এখান থেকে স্পষ্ট যে এটি নিরাপদ সীমার থেকে অনেক অনেক বেশি। শুধু নিকেল আর ক্রোমিয়াম নয়, প্রতি লিটার পানিতে জিংক পাওয়া গেছে ০.২১০ মিলিগ্রাম, তামা পাওয়া গেছে ০.২১৭ মিলিগ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ পাওয়া গেছে ০.১৫৩ মিলিগ্রাম এবং সিসার মাত্রা পাওয়া গেছে ০.১০৮ মিলিগ্রাম। এই ধাতুগুলোও নিরাপদ সীমার থেকে অনেক বেশি।

গবেষকদের মতে এই সব দূষণের প্রধান কারণ হাউজবোট থেকে নির্গত বর্জ্য। এছাড়া কীটনাশক ও শিল্প বর্জ্যও এই পানি দূষিত করছে। হাওরে পর্যটনের কারণে শত শত নৌকা চলাচল করে। এইসব নৌকা ইঞ্জিনে চলে। ইঞ্জিনের শব্দও মাছ ও পাখির চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। গত ২১ জুন টাঙ্গুয়ার হাওরের তীরবর্তী জয়পুর গ্রামে একটি মত বিনিময় সভা হয়। সভায় স্পষ্ট বক্তব্য উঠে আসে যে টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশ ধ্বংস করে পর্যটন চলতে পারে না। কেননা, যদি হাওরের পরিবেশ ভালো না থাকে তাহলে এক সময় কোন পর্যটকই আসবে না। সভায় একটি বক্তব্যে উঠে আসে যে এখানে বাদ্যযন্ত্র ও মাইকে এত শব্দ দূষণ ঘটে যে, স্থানীয়রা এতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। এসব শব্দে হাওরের জীব-জগত তো বটেই, মানুষ ও গ্রামের রোগী মানুষ ও ছাত্র-ছাত্রীদের মারাত্মক অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। তাদের ভাষায় স্থানীয়দের স্বার্থ আগে দেখতে হবে। এই সভায় টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ারের আশপাশের গ্রামের প্রায় শতাধিক মানুষ উপস্থিত ছিলেন। টাঙ্গুয়ার হাওর নিয়ে শুধু আমি নই, অনেকেই একাধিক লেখা লিখেছেন। স্থানীয়রাও ধীরে ধীরে ফুঁসছেন। এই অবস্থায় স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত