গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার পূর্বশর্ত নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি অবাধ, অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও সর্বোপরি সমান প্রতিযোগিতার অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন। কিন্তু আমাদের দেশে নির্বাচন এলেই শুরু হয় কটুকথা ও কুমন্তব্যের ব্যক্তিগত আক্রমণ। এক্ষেত্রে স্থানীয় কিংবা জাতীয় কোনো ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত আক্রমণের ফোয়ারা বন্ধ হয় না। নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় ভোট প্রাপ্তির প্রত্যাশায় কুকথার কুতর্ক বাঁধায়। এ নিয়ে সৃষ্টি হয় কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা। অনেক সময় সেই উত্তেজনা সংঘাতে রূপ লাভ করে। এমনকি নির্বাচন কমিশনের কাছেও এ ব্যাপারে প্রায়ই নালিশ পাওয়া যায়। দেশের সাধারণ নাগরিকরা সবসময় চেয়ে এসেছে রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও ভদ্রতার একটি ন্যূনতম মানদ- স্থাপিত হোক। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বারবার রাজনৈতিক শালীনতার সীমালঙ্ঘন করছে। নির্বাচন, সংস্কার ও সরকার পরিচালনার বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পর বিপরীতমুখী ও অনড় অবস্থানের কারণে পরিস্থিতি দিনদিন অশান্ত হয়ে উঠছে। যা বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক চেতনা ও স্বপ্নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কিন্তু এ ব্যাপার নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই।
নির্বাচন এলেই যেন কুকথার ব্যক্তিগত আক্রমণ বেড়ে যায়। রাজনীতি যেন প্রতিহিংসার নামে পারিবারিক অবমাননার মঞ্চ হয়ে গেছে। আমরা সাধারণ জনগণ প্রার্থীদের এইসব কুকথা কতটা বিশ্বাস করি, সেটা তাদের বোধগম্য হয় না।
শেষমেষ জনতার প্রতিবাদেও যেন লজ্জাবরণ হয় না তাদের। যে প্রার্থী তার বিরোধী প্রার্থী সম্বন্ধে অশালীন মন্তব্য করেন, মানুষ তার ব্যক্তিগতহীন রুচির পরিচয় পায়। সম্প্রতি নির্বাচনমুখী আবহ তৈরি হওয়ায় প্রচারে নেমে বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে আপত্তিকর মন্তব্য আসছে।
নৈতিক অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশে কেই কেউ প্রসাব নিঃসরণে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। কেউ কেউ প্রকাশ্যভাবে অন্য দলের নিপিড়ীত প্রবীণ নেতাকে গডফাদার তকমা দিচ্ছে। আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের নেতাকে ইঙ্গিত করে অপ্রীতিকর নোংরা শব্দ ব্যবহার করে স্লোগান দেওয়াটাও অশুভ লক্ষণ। শুদ্ধাচার ও নৈতিকতার মানদণ্ডে অশালীন মন্তব্যের কারনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি জনআস্থা এবং গ্রহণযোগ্যতার নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। একইসঙ্গে ক্রমাগত অশালীন মন্তব্য বাড়তে থাকলে দেশেরে আগামী নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হবে।
সারা দেশে নির্বাচন বা উপনির্বাচন এলেই প্রচারে নেমে প্রার্থীরা তাদের বিরোধী প্রার্থীদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন; কিন্তু এবার মন্তব্য শুধু প্রার্থী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নেই, ভোটার পর্যন্ত চলে গেছে। যাদের ভোটে নির্বাচিত হবে তাদের প্রতি কূরুচিপূর্ণ মন্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। জাতীয় নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রদানে বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের নেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্যের মন্তব্য মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের প্রধান নির্বাচনি আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ২৭(১) ধারার মাধ্যমে বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশি ভোটারদের ডাকযোগে ব্যালটে ভোট দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে ওই আইনি অধিকার দেওয়ার বছরেও প্রবাসীদের জন্য কখনোই পোস্টাল ভোটিং ব্যবস্থায় ভোটগ্রহণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে ২০০৮-২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো প্রবাসী ভোটার ভোট দিতে পারেননি।
জাতীয় নির্বাচন কমিশনের উচিত এর প্রতিকারে যথাযথব্যবস্থা গ্রহণ করা। সংসদীয় গণতন্ত্রে শাসন কার্যপরিচালনা করার লক্ষ্য নিয়ে একাধিক দল নির্বাচনি লড়াই করবে। নির্বাচন এলে, তা যে কোনও নির্বাচন, নির্বাচনি প্রচারে প্রার্থীরা বিরোধীদের বিভিন্ন দিক নিয়ে সমালোচনা করবে, ত্রুটিবিচ্যুতি ধরবে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কথা মানুষের সামনে তুলে ধরবে এটাই স্বাভাবিক। সব পক্ষের সে সমালোচনা যেন রুটিবহির্ভূত না হয়, কুকথা, কুমন্তব্যের ঝড় যেন না উঠে। সেটাই এদেশের সাধারণ জনগণের কাম্য। গণতন্ত্রের নিয়মনীতি এবং বিধিও তাই বলে। কিন্তু আমরা নির্বাচন বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের মধ্যে সেই রুচিবোধ দেখছি না। দেখছি অশালীন মন্তব্যের ঝড়। যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কলুষিত করছে। নির্বাচনে জয়পরাজয় থাকবে। যারা জয়ী হবেন, তারা খুশি হবেন। বেশি সংখ্যায় যে দলের প্রার্থীরা জয়ী হবেন, সেই দলই মন্ত্রিসভা গঠন করবে।
এই পথেই সংসদীয় গণতন্ত্র চলে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই পথে অনেক রুচিবহির্ভূত বিষয় থেকে আসছে, যা গণতন্ত্রের সুন্দর পথকে রুদ্ধ করছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেকগুলো নির্বাচন হল। কিন্তু আগামী নির্বাচনে দেশের জনগণের আশা-আকাক্ষা অনেক। এবার বহু ত্যাগের বিনিময়ে একটা সুযোগ এসেছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনি প্রচারে প্রার্থীদের কী কী মানতে হবে, তার একটি নির্দেশমানা জারি করেছে। আগামী নির্বাচনি প্রচারণায় পোস্টারের ব্যবহার থাকছে না। পাশাপাশি দলীয় অঙ্গীকারনামা, এক প্লাটফর্মে সব প্রার্থীর ইশতেহার ঘোষণা, সোশ্যাল মিডিয়ায় কড়াকড়ি ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের জরিমানা তিনগুণ বাড়িয়ে দেড়লাখ টাকার বিধান করা হয়েছে।
এছাড়া নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা ও করণীয় নানা বিষয়েও পরিবর্তন এনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য সংশোধিত আচরণবিধির খসড়া অনুমোদন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রার্থীদের অবশ্যই নির্বাচনের আচরণবিধি মেনে চলতে হবে- যেমন কোনো প্রার্থীর সম্বন্ধে অশালীন কথা বলা চলবে না, করা যাবে না ব্যক্তিগত আক্রমণ। শালীনতার গণ্ডি পেরিয়ে প্রার্থীদের সম্বন্ধে নানা আপত্তিকর মন্তব্য গণতন্ত্রবহির্ভূত। সব রাজনৈতিক দলের কাছে প্রত্যাশা, অশালীন মন্তব্য দ্বারা রাজনৈতিক শিষ্টাচারের সীমা অতিক্রমের অসুস্থ প্রতিযোগিতা আগামী নির্বাচনে দেখতে হবে না। এদেশের সব শান্তিপ্রিয় নাগরিকের প্রত্যাশা অশালীন মন্তব্য মুক্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু, সৌহার্দ্যপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে- আগামীর বৈষম্যহীন আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে।
শিক্ষক ও কলামিস্ট