প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৪ আগস্ট, ২০২৫
বিভুরঞ্জন সরকারের ‘খোলা চিঠি’ পড়ে স্তব্ধ হয়েছি আমি। হয়তো আমার মতো হাজারো গণমাধ্যমকর্মী স্তব্ধ হয়েছেন। সাংবাদিকতার অর্ধশতকের দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া এক মানুষ যখন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে লিখে যান নিজের বেদনার কাহিনি, তখন সেটি শুধু ব্যক্তিগত কোনো ট্র্যাজেডি হয়ে থাকে না, বরং পুরো পেশার অবস্থা, সমাজের নির্দয় চেহারা আর রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতার নির্মম দলিল হয়ে ওঠে। তার শেষ চিঠিটি একেবারেই ব্যক্তিগত আখ্যান মনে হলেও, এর ভেতর লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের হাজারো সাংবাদিকের নীরব আর্তনাদ, না পাওয়া, বঞ্চনা আর দীর্ঘদিনের অবহেলার ইতিহাস।
সাংবাদিকতার সঙ্গে বিভুরঞ্জনের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল স্কুলজীবনেই। খুব অল্প বয়সে তিনি কলম ধরেছিলেন সত্য বলার জন্য, মানুষের জন্য। সেই কলম ধরে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক শাসন, গণআন্দোলন আর রাজনৈতিক উত্থান-পতনের নানা অধ্যায়। কিন্তু দীর্ঘ পথচলায় তিনি উপলব্ধি করেছেন, সত্য লিখে বাঁচা কখনওই সহজ নয়। সাংবাদিকতা তার কাছে ছিল দায়িত্ব, ছিল নৈতিকতার পরীক্ষা। এই দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি কখনোই সুবিধা, স্বার্থ বা ব্যক্তিগত সুখের জন্য লেখেননি। অথচ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাকে লিখতে হয়েছে- ‘সারা জীবন লিখলাম মানুষের জন্য, কিন্তু মানুষের কাছে ফিরতি উষ্ণতা পেলাম কতটুকু?’ এই প্রশ্নের উত্তর শুধু তিনি নন, প্রতিদিন সংবাদ কক্ষে বসে অনিশ্চয়তার মধ্যে কাজ করা অসংখ্য সাংবাদিকও খুঁজে ফেরেন। তার চিঠিতে ভেসে উঠেছে নিখাদ আর্থিক কষ্টের ছবি। পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় সাংবাদিকতা করার পরও সম্মানজনক বেতন পাননি তিনি। বিভাগের অন্য কারও বেতন তার দ্বিগুণ হলেও নিজের ভাগ্যে জোটেনি ন্যায্য সম্মান। অথচ মাসে কেবল নিজের চিকিৎসার খরচই ছিল বিশ থেকে বাইশ হাজার টাকা। আর্থ্রাইটিস, লিভার সিরোসিস, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ অসংখ্য রোগে ভুগতে ভুগতে প্রতিদিন ঋণের বোঝা বয়ে নিয়ে চলতে হয়েছে তাকে। সন্তানদের চিকিৎসা আর পড়াশোনার খরচও তার ওপর বাড়তি চাপ হয়ে এসেছিল। একজন প্রবীণ সাংবাদিক, যিনি একসময় দেশের শীর্ষ দৈনিকের প্রথম পাতায় লেখেন, যার কলমের প্রশংসা করেছেন দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা, তিনি জীবনের শেষভাগে এসে কেবল ঋণ আর অনিশ্চয়তার হিসাব কষে গেছেন।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার যে করুণ চিত্র, সেটি তার অভিজ্ঞতায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি লিখেছেন কিভাবে সত্য প্রকাশের কারণে কতবার নাম গোপন করে লিখতে হয়েছে, কিভাবে এরশাদের দমননীতির মুখে দাঁড়াতে হয়েছে। কিন্তু সাহসী কলমের এই পুরুষ যখন বেতনের বৈষম্য, চাকরির অনিশ্চয়তা আর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন, তখন তা শুধু একজনের নয়, পুরো সমাজের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়ায়। তার আক্ষেপে বারবার উঠে এসেছে যে তিনি প্লট পাননি, শেখ হাসিনার দরবারে সাহায্য চাইতেও সফল হননি, এমনকি বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনাকে নিয়ে বই লিখেও কোনো রয়্যালটি পাননি। অথচ তার অনেক সমসাময়িক রাষ্ট্রীয় সুবিধা পেয়েছেন, রাজনৈতিক আনুকূল্য নিয়ে জীবন বদলে ফেলেছেন। এই বঞ্চনা ব্যক্তিগত মনে হলেও আসলে এটি প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের প্রতীক।
বিভুরঞ্জন সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েও অবশ্য বিতর্ক থাকতে পারে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে আজীবন অবিচল ছিলেন, আর এ কারণেই অনেকে তাকে সবসময় আওয়ামী ট্যাগ দিয়ে সমালোচনা করেছেন। অথচ তার চিঠিতেই স্পষ্ট আওয়ামী লীগ সরকার আমলেও তিনি কোনো সুবিধা পাননি, বরং চাকরিহীনতা, ঋণের বোঝা ও চিকিৎসা সংকটে দিন কাটিয়েছেন। গণতান্ত্রিক পরিবেশে এ ধরনের অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই আলোচনার জন্ম দিতে পারে, কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন তার লেখার ভঙ্গি বা আদর্শিক ঝোঁক নিয়ে। কিন্তু এই বিতর্ক যেমন গণতন্ত্রেরই অংশ, তেমনি এটাও মনে রাখা জরুরি যে বিভুরঞ্জন নিজের আদর্শের প্রতি অনুগত থেকেছেন এবং সেই পথেই সত্য প্রকাশের চেষ্টা করেছেন। তার রাজনৈতিক পরিচয় তাই বিতর্কের বিষয় হতে পারে, কিন্তু তার সততা ও দায়বদ্ধতার প্রশ্নে সংশয় থাকার কথা নয়।
তার ‘খোলা চিঠির আরেকটি দিক অত্যন্ত হৃদয়বিদারক একজন বাবার নিঃশব্দ কান্না। কন্যা চিকিৎসক, পরীক্ষায় কখনো ফেল করেনি, কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে প্রশাসনিক রোষানলে পড়ে থিসিস পরীক্ষায় ব্যর্থ হলো। ছেলে বুয়েট থেকে পড়াশোনা শেষ করেও স্থায়ী চাকরির নিশ্চয়তা পাচ্ছে না, বিদেশে বৃত্তি পেয়েও শারীরিক অসুস্থতায় সুযোগ হারাল। একজন বাবার ব্যর্থতার দায় নিজের কাঁধে নিয়ে তিনি লিখেছেন— ‘অপরাধ কি ওর নাম, নাকি বাবা হিসেবে আমি, বুঝতে পারছি না।’ এই অভিমান নিছক পারিবারিক নয়, বরং আজকের সমাজের বাস্তব চিত্র। যেখানে যোগ্যতা থাকলেও রাজনৈতিক আশীর্বাদ ছাড়া সফলতা পাওয়া কঠিন।
তার লেখায় উঠে এসেছে মিডিয়া জগতের ভয়ঙ্কর বাস্তবতাও। একটি লেখার জন্য কিভাবে সম্পাদককে চাপের মুখে পড়তে হয়, কিভাবে সংবাদ তুলে নিতে বাধ্য হতে হয়, কিভাবে রাষ্ট্রের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে শ্বাসরুদ্ধ করে তোলে এসব তিনি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, দীর্ঘ চার বছর একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও কোনো পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি হয়নি। অথচ প্রতিদিন দ্রব্যমূল্য বাড়ছে, সংসারের ব্যয় বাড়ছে। সংবাদপত্র যেখানে নিজ ঘরে অনিয়ম দূর করতে পারে না, সেখানে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর প্রশ্নই বা কতটা বাস্তব? এই প্রশ্ন শুধু তার নয়, প্রতিটি সংবাদকর্মীর। বিভুরঞ্জনের চিঠি তাই নিছক আত্মহত্যাপূর্বক হতাশা নয়, বরং একটি সময়ের দলিল। এটি প্রমাণ করে, বাংলাদেশে সাংবাদিকতা এখনও একটি ঝুঁকিপূর্ণ, অনিশ্চিত এবং অপ্রতুল পেশা। এখানে সত্য বলার মূল্য কেবল চাকরি হারানো নয়, বরং সারাজীবনের প্রাপ্য সম্মান থেকেও বঞ্চিত হওয়া। তিনি লিখেছেন, ‘সত্য প্রকাশ মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়ার নাম।’ কিন্তু এই ঝুঁকি নেওয়া মানুষগুলো যখন শেষ পর্যন্ত চিকিৎসার টাকাটুকুও জোগাড় করতে পারেন না, তখন তা পুরো সমাজের জন্য লজ্জার। এই চিঠি আমাদের আরেকটি নির্মম সত্যও মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশে সাংবাদিকতা কোনো সোনার হরিণ নয়। হাজারো মানুষ দিনের পর দিন সংবাদ কক্ষে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন, কিন্তু মাস শেষে প্রাপ্য বেতনও পান না নিয়মিতভাবে। কারও কারও বেতন বছরের পর বছর এক জায়গায় থেমে থাকে, কারও সম্মানী পাওনা থেকে যায়। অথচ সাংবাদিকতাই সেই পেশা, যা গণতন্ত্রের মূলভিত্তি রক্ষা করে, রাষ্ট্রের অন্যায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে। অথচ সেই পেশার যোদ্ধারাই বঞ্চিত, নিপীড়িত এবং অবহেলিত। বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু তাই একটি নিঃসঙ্গ ব্যক্তির মৃত্যুই নয়, বরং পুরো সাংবাদিক সমাজের দীর্ঘদিনের না-পাওয়া আর্তনাদের প্রতীক হয়ে থাকবে।
এই কলমসৈনিক চলে গেছেন, কিন্তু রেখে গেছেন এক অমূল্য দলিল। তার শেষ চিঠি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সাংবাদিকতার জন্য শুধু রাজনৈতিক আনুকূল্য বা সুবিধাভোগীদের নয়, সৎ ও নিষ্ঠাবানদের ন্যায্যতা নিশ্চিত করা জরুরি। রাষ্ট্র, সমাজ এবং সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভাবতে হবে, আর কতজন বিভুরঞ্জন সরকারের মতো মানুষ শেষ বয়সে হতাশা ও বঞ্চনা নিয়ে নিঃশব্দে হারিয়ে যাবেন।
বিভুরঞ্জন শেষ লিখেছিলেন, ‘দুঃখই হোক আমার জীবনের শেষ সঙ্গী, আর পৃথিবীর সব প্রাণী সুখী হোক।’ একজন ক্লান্ত মানুষের এই শেষ প্রার্থনা কেবল তার নয়, বরং আমাদের সবার জন্য এক সতর্কবার্তা। আমরা যদি সত্যিকারের গণতন্ত্র চাই, যদি মুক্ত সাংবাদিকতা চাই, তবে আমাদের সাংবাদিকদের ন্যায্য প্রাপ্য, নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত করতেই হবে। বিভুরঞ্জন সরকার যে কথা বলে গেছেন, তা আসলে হাজারো সাংবাদিকের না বলা বেদনা। এই বেদনা ভুলে গেলে আবারও আমরা হারাব আরও বিভুরঞ্জনদের, আরও কলমসৈনিকদের।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট, লন্ডন, যুক্তরাজ্য