প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৮ আগস্ট, ২০২৫
বাংলাদেশের মানুষের জীবনে খেলাধুলা একটি অনন্য আবেগের নাম। ক্রিকেট মাঠে বাংলাদেশের জয়ের উল্লাসে পুরো জাতি একসঙ্গে আনন্দে ভাসে, ফুটবল মাঠে গ্যালারি কাঁপানো চিৎকারে এক মুহূর্তেই মুছে যায় হাজারো দুঃখ। ক্রীড়া শুধু একটি বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি আমাদের জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক, রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তির প্রতিফলন। একেকটি আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়ামে যখন ম্যাচ শুরু হয়, লাখো দর্শক টেলিভিশন কিংবা সরাসরি মাঠে বসে উল্লাস করে। চারপাশে সাজানো সবুজ ঘাস, নিখুঁত আউটফিল্ড, সমান করা উইকেট বা পিচ, আরামদায়ক পরিবেশ- সবকিছু মিলেই তৈরি হয় একটি উৎসবমুখর আবহ।
কিন্তু কখনও কি আমরা ভেবেছি, এই সৌন্দর্যের নেপথ্যে কারা কাজ করেন? খেলোয়াড়দের ঝলমলে পারফরম্যান্স, দর্শকদের উল্লাস, সম্প্রচারের আলো ঝলমলে আয়োজনের আড়ালে থাকে একদল নীরব সৈনিক- মাঠকর্মী বা গ্রাউন্ডসম্যানরা। তাদের শ্রমেই মাঠ হয়ে ওঠে খেলার উপযোগী। দিনের পর দিন ঘাস কাটা, পানি দেওয়া, মাটি রোলিং করা, বৃষ্টির পানি সরানো কিংবা হঠাৎ খেলার সময় মাঠ ঢেকে দেওয়া- এসব কাজের মাধ্যমেই তারা নিশ্চিত করেন খেলাধুলার ধারাবাহিকতা।
তবুও দুঃখজনক বিষয় হলো, তাদের নাম দর্শকের করতালিতে উচ্চারিত হয় না, সংবাদপত্রের শিরোনামে তারা স্থান পান না। তারা থেকে যান অদৃশ্য, অথচ অপরিহার্য। আমাদের আনন্দের মাঠ গড়ে ওঠে তাদের ঘামে ভিজে; কিন্তু তাদের জীবন ও ভবিষ্যৎ রয়ে যায় অনিশ্চয়তায় ঝুলে। স্থায়ী চাকরি নেই, পর্যাপ্ত বেতন নেই, সামাজিক নিরাপত্তা নেই, এমনকি স্বীকৃতিও নেই। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, ফুটবল ফেডারেশন কিংবা জেলা পর্যায়ের ক্রীড়া সংস্থাগুলো কোটি কোটি টাকা আয় করে খেলাধুলা থেকে। স্পনসরশিপ, টিভি সম্প্রচার অধিকার, টিকিট বিক্রি, বিজ্ঞাপন- সব মিলিয়ে ক্রীড়া এখন একটি বিশাল অর্থনৈতিক খাত। কিন্তু এই আয় ভাগাভাগির তালিকায় নেই মাঠ কর্মীরা। অথচ তাদের ছাড়া খেলাধুলার কাঠামো একদিনও টিকত না। আজ যখন আমরা খেলাধুলার উন্নয়ন নিয়ে বড় বড় স্বপ্ন দেখি- অলিম্পিকে পদক জেতার স্বপ্ন দেখি, বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার আশা করি- তখন আমাদের ভাবতে হবে মাঠকর্মীদের নিয়েও। তারা শুধু শ্রমিক নন, তারা আমাদের ক্রীড়ার ভীত নির্মাতা। কিন্তু তাদের ভরসাহীন ভবিষ্যৎ যদি আমাদের চোখে না পড়ে, তবে ক্রীড়া উন্নয়নের এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়া কঠিন হবে।
তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়- যে মাঠ আমাদের আনন্দ দেয়, সেই মাঠের কর্মীদের ভবিষ্যৎ কোথায়?
অদৃশ্য শ্রমিকদের জীবন : গ্রাউন্ডসম্যানরা ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করেন। গ্রীষ্মের তপ্ত রোদে ঘাস কেটে মাঠকে খেলার উপযোগী রাখেন, শীতের কুয়াশায় পিচ ঢেকে রাখেন, বর্ষার বৃষ্টিতে কাদামাটি সরিয়ে ফেলেন। খেলার সময় হঠাৎ বৃষ্টি নেমে এলে মুহূর্তের মধ্যে মাঠ ঢাকার জন্য তাদের দৌড়ঝাঁপ দেখা যায়। দর্শকরা তখন করতালি দেন খেলোয়াড়দের জন্য, কিন্তু এই শ্রমিকদের জন্য নয়। তাদের অনেকেই মৌসুমভিত্তিক কাজ পান। অর্থাৎ, খেলা থাকলে তাদের কাজ আছে, খেলা শেষ হলে তারা বেকার হয়ে পড়েন। পরিবার চালানোর অনিশ্চয়তা তাদের নিত্যসঙ্গী।
সীমিত বেতন ও দারিদ্র্যের শৃঙ্খল : বাংলাদেশে একজন মাঠ কর্মীর মাসিক বেতন অনেক সময় একজন দিনমজুরের সমান কিংবা তারও কম। অথচ একই মাঠ থেকে কোটি কোটি টাকা আয় হয়। এই আয় ভোগ করেন ক্রীড়া সংগঠন, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, স্পনসর- কিন্তু মাঠ কর্মীরা পান শুধু সামান্য মজুরি। চাকরি হারালে তারা অন্য কোনো কাজ করতে পারেন না, কারণ বিশেষ দক্ষতা তাদের থাকে না। ফলে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম দারিদ্র্যে পড়ে যান।
প্রযুক্তির যুগে পিছিয়ে থাকা কর্মীরা : আধুনিক স্টেডিয়ামে উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার হলেও বেশিরভাগ কর্মী এর ব্যবহার জানেন না। প্রশিক্ষণ নেই, ফলে তারা পুরোনো ধাঁচে শারীরিক কষ্টের মাধ্যমে কাজ চালিয়ে যান। আবার যথাযথ সুরক্ষা সরঞ্জাম না থাকায় তারা নানা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন- হিটস্ট্রোক, ত্বকের রোগ, দুর্ঘটনা ইত্যাদি। সম্মান ও স্বীকৃতির অভাব : খেলা শেষে সংবাদমাধ্যমে আলোচনায় থাকে খেলোয়াড়দের নাম। কিন্তু গ্রাউন্ডসম্যানদের নাম কোথাও থাকে না। অথচ খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স সরাসরি নির্ভর করে মাঠের মানের ওপর। বাস্তবে তারা অদৃশ্য নায়ক, কিন্তু সমাজ তাদের স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ। অন্যদিকে, অনেক সময় প্রভাবশালী ব্যক্তি বা কর্মকতারা মাঠ কর্মীদের সাথে ভালো আচরণ করেন না। মিডিয়াতেও প্রায়ই উঠে আসে তাদের অভিযোগ- অপমানজনক ভাষা ব্যবহার, অবহেলা কিংবা অপ্রত্যাশিত রুক্ষ আচরণ। ফলে তাদের মানসিক কষ্টও যোগ হয় শারীরিক পরিশ্রমের সাথে। এটি শুধু অন্যায় নয়, মানবিক মর্যাদারও অবমাননা। কেন ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত? স্থায়ী চাকরির অভাব- মৌসুম শেষ হলে আয় বন্ধ। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাণ্ড পেনশন, স্বাস্থ্যবিমা বা দুর্ঘটনা বিমা নেই। দারিদ্রে?্যর চক্র- প্রজন্মের পর প্রজন্ম দারিদ্র?্য থেকে মুক্তি নেই। প্রশিক্ষণের ঘাটতি- আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে পড়া। অবহেলা ও অস্বীকৃতি- রাষ্ট্র ও সমাজ তাদের অবদান মূল্যায়ন করে না।
তাদের গুরুত্ব কেন অপরিসীম : বাংলাদেশ আজ ক্রিকেটে বিশ্বমঞ্চে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। ফুটবল, হকি বা অন্যান্য খেলাও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু এসব খেলার টেকসই উন্নয়ননির্ভর করছে আন্তর্জাতিক মানের মাঠের ওপর। মাঠ কর্মীরা আসলে এই খেলার ভীত নির্মাতা। তাদের অবহেলা মানে খেলাধুলার ভিত্তিকে দুর্বল করা।
করণীয় কী? ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা- পরিবার চালানোর মতো বেতন দিতে হবে। স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা- মৌসুমভিত্তিক নয়, দীর্ঘমেয়াদি নিয়োগ। সামাজিক নিরাপত্তা- স্বাস্থ্যবিমা, দুর্ঘটনা বিমা ও পেনশন চালু করা। প্রশিক্ষণ- আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া। সামাজিক স্বীকৃতি- গণমাধ্যম ও ক্রীড়া সংস্থাগুলোর উচিত তাদের সম্মাননা দেওয়া। রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন- ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উচিত মাঠ কর্মীদের জন্য আলাদা নীতি তৈরি করা। অতএব, খেলাধুলা শুধু একটি বিনোদন নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের পরিচয়, সংস্কৃতির বাহক এবং জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। বাংলাদেশের ক্রিকেট দল যখন বিশ্বমঞ্চে জয় ছিনিয়ে আনে, পুরো জাতি আনন্দে মেতে ওঠে। কিন্তু সেই জয়ের ভিত্তি তৈরি হয় একটি সুসজ্জিত মাঠে, যার পেছনে কাজ করেন নীরব শ্রমিকরা।
লেখক : আমদির পাড়া, জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা