প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ৩১ আগস্ট, ২০২৫
একবিংশ শতাব্দী তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। সংবাদ প্রচার, গণমাধ্যমের রূপ এবং মানুষের তথ্যগ্রহণের পদ্ধতি আমূল পরিবর্তিত হয়েছে। একসময় মানুষ খবর জানার জন্য অপেক্ষা করত রেডিও সংবাদ, টেলিভিশন বুলেটিন বা পরদিনের পত্রিকার উপর। এখন স্মার্টফোন হাতে নিয়েই খবর খোঁজে মানুষ, বিশেষ করে ফেসবুকে। দুর্ঘটনা, রাজনীতি, খেলাধুলা, বিনোদন- সব খবরই মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৬,৮১৪,৩৬০,০০০, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৮%। UNESCO -এর ২০২৩ সালের জরিপ : UNESCO এবং Ipsos -এর যৌথ জরিপে উঠে এসেছে যে, বিশ্বের ১৬টি দেশে ৬৮% ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মনে করেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া খবর সবচেয়ে বেশি ছড়ায়। এছাড়া, ৮৫% মানুষ অনলাইনে ভুয়া খবরের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন।
ফেসবুক সংবাদ জনপ্রিয়তার উত্থান : বাংলাদেশে ২০১০ সালের পর থেকে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রসারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খবর প্রচারের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে। প্রথমদিকে এটি নাগরিক সাংবাদিকতা ও সামাজিক আন্দোলনের এক ইতিবাচক শক্তি ছিল। দুর্ঘটনা বা দুর্যোগে প্রত্যক্ষদর্শীরা ছবি-ভিডিও শেয়ার করতেন, যা মূলধারার গণমাধ্যমের তথ্য যাচাইয়ের কাজে লাগত।
সংবাদমাধ্যমের রূপান্তর, দ্রুত, বহুমাত্রিক কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ : একবিংশ শতাব্দীকে তথ্যপ্রযুক্তির যুগ বলা হয়। এই যুগে সংবাদমাধ্যমের কাঠামো, প্রচারের ধরন এবং মানুষের সংবাদ গ্রহণের পদ্ধতি আমূল পরিবর্তিত হয়েছে। একসময় মানুষ সংবাদ জানার জন্য অপেক্ষা করত সকালে কাগজে ছাপা খবরের জন্য, কিংবা রাতের টেলিভিশন বুলেটিন বা রেডিও সম্প্রচারের জন্য। আজ সেই ধীরগতির প্রক্রিয়া অতীতের অংশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম- ফেসবুক, ইউটিউব, অ্যান্ড (পূর্বতন টুইটার), টিকটক- সংবাদকে করেছে ত্বরান্বিত, বহুমাত্রিক এবং সহজলভ্য। তবে এই পরিবর্তন যেমন সুযোগ তৈরি করেছে, তেমনি ভয়াবহ ঝুঁকিও ডেকে এনেছে। এক সময় সংবাদ ছিল একটি প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ব্যবস্থা, যেখানে তথ্য যাচাই, সম্পাদনা ও নৈতিকতার প্রক্রিয়া ছিল। প্রথাগত সাংবাদিকরা সংবাদ সংগ্রহ করতেন, সম্পাদকরা যাচাই করতেন, এবং সংবাদপত্র বা টেলিভিশন তা জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করত। ফলে ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম ছিল। আজ পরিস্থিতি বদলে গেছে। প্রতিটি মানুষ সংবাদ প্রযোজক ও প্রচারক হতে পারে। মোবাইল ফোনে ধারণকৃত ভিডিও, ছবি বা ব্যক্তিগত মতামত মুহূর্তের মধ্যে লাখো মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। এতে সংবাদ ও গুজব, তথ্য ও মতামত, সত্য ও মিথ্যার সীমারেখা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। সামাজিক মাধ্যমের অ্যালগরিদম উত্তেজনাপূর্ণ বা বিতর্কিত খবর দ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। ফলে যাচাই-বাছাইহীন তথ্য অনেক সময় সত্য সংবাদকে ঢেকে ফেলে। বাংলাদেশও এই বৈশ্বিক প্রবণতা থেকে ব্যতিক্রম নয়। দেশের জনগণের বড় অংশ এখন খবর জানতে ফেসবুক বা ইউটিউবের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এখানেই তৈরি হচ্ছে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। এসব প্ল্যাটফর্মে প্রচারিত তথ্যের অধিকাংশই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক যাচাইয়ের আওতায় আসে না। ফলস্বরূপ ভুয়া খবর, গুজব, উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে, রাজনীতিকে বিভক্ত করছে, ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করছে এবং কূটনৈতিক সম্পর্কেও চাপ সৃষ্টি করছে।
রুমর স্ক্যানারের প্রতিবেদন : উদ্বেগের ঘন কণা সম্প্রতি বাংলাদেশে ভুয়া খবরের বিস্তার নিয়ে দেশের শীর্ষ ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা রুমর স্ক্যানার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশে মোট ৮৩৭টি ভুয়া খবর শনাক্ত হয়েছে। ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে যেখানে ৬৫৪টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল, সেখানে মাত্র এক প্রান্তিকে ভুয়া খবরের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২১ শতাংশ। এই বৃদ্ধি কেবল সংখ্যাগত নয়। রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নানা ইস্যুকে ঘিরে ভয়ঙ্কর এক স্রোত তৈরি হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিভ্রান্তির শিকাররা : রাজনৈতিক অঙ্গন বরাবরই ভুয়া খবরে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। রুমর স্ক্যানারের তথ্য অনুযায়ী: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি মিথ্যা তথ্য প্রচারিত হয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে, এসব ভুয়া খবরে ৮০% ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মিথ্যা খবর ছড়িয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে ঘিরে। বিএনপিকে কেন্দ্র করে মোট ৫৪টি বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারিত হয়েছে, যারমধ্যে ৮টি সরাসরি দলকে নিয়ে এবং বাকি দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে নিয়ে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভুয়া খবরে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক টার্গেট ছিলেন (৭৮% নেতিবাচক)। অন্যদিকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ঘিরে প্রচারিত ছয়টি ভুয়া খবরে ৮৩% ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন হয়েছে। এতে বোঝা যায়, ভুয়া খবর কেবল কাউকে নস্যাৎ করতেই ব্যবহৃত হচ্ছে না, বরং নির্দিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা গোষ্ঠীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও ড. ইউনূস : নতুন লক্ষ্যবস্থ ২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এরপর থেকেই তাকে ঘিরে ভুয়া খবরে সয়লাব বাংলাদেশ। ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে ৪৪টি ভুয়া খবর অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারিত হয়, যার ৯৩% নেতিবাচক।
একই সময়ে ড. ইউনুসকে ঘিরে ৫১টি ভুয়া খবর ছড়ানো হয়, যার ৯০% নেতিবাচক। মোট ১৭৯টি বিভ্রান্তিকর তথ্য তার নেতৃত্বাধীন সরকার ও ব্যক্তিগতভাবে তাকে নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
ফেসবুক ভুয়া খবরে প্রধান প্ল্যাটফর্ম : ৮৩৭টি ঘটনার মধ্যে এককভাবে ৭৪৮টি ঘটনার উৎস ফেসবুক, অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৮টির বেশি ভুয়া খবর। অন্য প্ল্যাটফর্ম: অ্যান্ড (টুইটার): ১৬২ , ইউটিউব: ১২৪ , টিকটক: ৬৭, ইনস্টাগ্রাম: ৬৭ এছাড়া, দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যম থেকেও ৪২টি বিভ্রান্তিকর খবর প্রকাশিত হয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যম সরাসরি জড়িত ছিল ২০টি ঘটনায়।
ভুয়া খবরে ধর্মীয় বিভাজন ও সাম্প্রদায়িকতা : ধর্মীয় বিষয়কে কেন্দ্র করে ভুয়া খবরের বিস্তার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে ৭৮টি সাম্প্রদায়িক ভুয়া খবর শনাক্ত হয়েছে, যার ৬১% ভারতীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ছড়ানো। এই ধরনের প্রচারণা সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে এবং সীমান্তবর্তী দুই দেশের সম্পর্ককেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সেনাবাহিনীকে ঘিরে বিভ্রান্তি : নিরাপত্তা খাতও ভুয়া খবরের আওতায়। ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে ৬০টি ভুয়া খবর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সেনাবাহিনীকে নিয়ে ছড়ানো হয়। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে নিয়ে এককভাবে ১১টি বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা খাতের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে এবং জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
ভারতীয় মিডিয়ার সম্পৃক্ততা ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ : ২০২৫ সালের জানুয়ারি-মার্চে ভারতীয় মূলধারার মিডিয়া বাংলাদেশকে নিয়ে ৩৮টি বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশ করেছে। এরমধ্যে কেবল আজতক বাংলা প্রকাশ করেছে ৮টি। ভারতীয় সামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্ট থেকেও অতিরিক্ত ১৫টি বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হয়েছে। মোট ভারতীয় সম্পৃক্ত ঘটনা: ৮৩টি। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। সংবাদ যাচাইয়ের অপরিহার্যতা : ৮৩৭টি ভুয়া খবরের মধ্যে: ৫০৭টি সম্পূর্ণ মিথ্যা, ২২৬টি বিভ্রান্তিকর, ১০২টি বিকৃত, ২টি ব্যঙ্গাত্মক কনটেন্টকে সত্যি হিসেবে প্রচার করা রুমর স্ক্যানারের টিম ৩৩৩টি, ১৬৩টি ছবি ও ৩৪১টি ভিডিও বিশ্লেষণ করেছে। এতে স্পষ্ট হয়, ভুয়া খবর এখন কেবল গুজব নয়, বরং পেশাদার কৌশলে তৈরি ও প্রচারিত হচ্ছে। করণীয়: রাষ্ট্র ও সমাজের পথনির্দেশ : ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধি: জনগণকে শেখাতে হবে ভুয়া খবর চেনা, উৎস যাচাই ও বিভ্রান্তি এড়ানোর কৌশল। আইন প্রয়োগে ভারসাম্য: ভুয়া খবর নির্মূলের আইন থাকা প্রয়োজন, তবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করতে নয়। ফ্যাক্ট-চেকিং প্ল্যাটফর্মকে সহযোগিতা: রুমর স্ক্যানারের মতো সংস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দিতে হবে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে সীমান্তপারের বিভ্রান্তি ঠেকাতে হবে। গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা: সংবাদ প্রকাশের আগে বহুমাত্রিক যাচাই নিশ্চিত করা অপরিহার্য। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- ভুয়া খবরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে যৌথভাবে। সরকার, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া এটি সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ আজ এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। একদিকে অর্থনীতি, অবকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে অভূতপূর্ব সাফল্য; অন্যদিকে ডিজিটাল পরিসরে ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের ভয়ঙ্কর বিস্তার। ফেসবুককেন্দ্রিক সংবাদ ও সাংবাদিকতা সমাজে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, তা কেবল তথ্যপ্রবাহের সংকট নয়- এটি গণতন্ত্র, সামাজিক সম্প্রীতি, জাতীয় নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য এক নতুন হুমকি। তথ্যের যুগে সত্যই সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি। ভুয়া খবর যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, সত্যের আলো তাকে পরাজিত করতে পারে। বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রা কেবল অর্থনীতি নয়, এটি তথ্য-সত্য রক্ষার লড়াই। প্রতিটি নাগরিক সচেতন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দায়িত্বশীল এবং রাষ্ট্র কার্যকর নীতি গ্রহণ করলে এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব। অন্যথায় ভুয়া খবর সত্যের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেবে, গণতন্ত্র ভেঙে পড়বে, সামাজিক সম্প্রীতি ক্ষুণ্ণ হবে এবং রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা বিপন্ন হবে। সুতরাং, আজই অঙ্গীকার হোক- ভুয়া খবর নয়, সত্যই হবে আমাদের পথপ্রদর্শক।
লেখক : কলামিস্ট, জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা