প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ৩১ আগস্ট, ২০২৫
যুক্তরাষ্ট্রে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমাতেই পারছে না প্রশাসন। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির অবতারণা হয় যখন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্দুকধারী আচমকা প্রবেশ করে বিনা বাধায় ক্লাসরুমে ঢুকে নিষ্পাপ শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ২৭ আগস্ট এমনই এক ঘটনা ঘটেছে মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিশ শহরের ক্যাথলিক চার্চ পরিচালিত এক মিডল স্কুলে। তেইশ বছর বয়সি বন্দুকধারী স্কুলে প্রবেশ করে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করলে দুই শিক্ষার্থী নিহত এবং ১১ শিক্ষার্থীসহ ২০ জন আহত হন। নিহতদের একজনের বয়স ৮ বছর, অপরজনের ১০ বছর। বন্দুকধারী রবিন ওয়েস্টম্যান ওই স্কুলেরই সাবেক শিক্ষার্থী। তার কাছে একটি সেমি-অটোমেটিক রাইফেল, একটি শটগান ও পিস্তল ছিল। পুলিশ স্কুলে পৌঁছার আগেই ঘাতক তরুণ মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করে। তদন্তকারীরা রবিনের বাসস্থান থেকে যেসব আলামত সংগ্রহ করেছে, সেগুলোর মধ্যে ছিল তার ডায়রিতে কৃষ্ণাঙ্গ, মেক্সিকান, খ্রিষ্টান ও ইহুদি জনগোষ্ঠীর প্রতি চরম বিদ্বেষমূলক অনেক লেখা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা সহিংস ধরনের ভিডিও।
আমি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনবহুল সিটি নিউইয়র্কে বসবাস শুরু করার দুই বছর পর ২০১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাশের অঙ্গরাজ্য কানেকটিকাটের এক এলিমেন্টারি বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্দুকধারীর গুলিতে ২০ শিশুসহ ২৮ জন নিহত ও দুজন আহত হওয়ার ঘটনা জেনে হতচকিত হয়ে পড়েছিলাম। নিউইয়র্ক সিটি থেকে ৬০ মাইল দূরে নিউটাউন শহরের স্যান্ডি হুক এলিমেন্টারি স্কুলে এ ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটে। বন্দুকধারী অ্যাডাম ল্যানজা (২৩) স্কুলের কাছেই তার বাড়িতে প্রথমে তার মাকে গুলি করে হত্যা করে এবং সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে স্কুলের দুটি ফার্স্ট গ্রেডের ক্লাসে প্রবেশ করে সেমি-অটোমেটিক রাইফেলের গুলিতে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছয় ও সাত বছর বয়সি ১২টি ছেলে ও ৮টি মেয়ে এবং স্কুলের প্রিন্সিপালসহ চার শিক্ষক ও দুই কর্মচারীকে হত্যা করে। গুলিবিদ্ধ অন্য চারজনের মধ্যে দুজন হাসপাতালে মারা যান। এটি ছিল ১৯৭০ সালের পর স্কুলে গুলিবর্ষণে হতাহতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যা। ল্যানজার গুলিবর্ষণে হতাহতের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেতে পারত, যদি তার রাইফেলের ব্যারেল জ্যাম না হয়ে পড়ত। ৯১১-এ কল পেয়ে স্কুলে পুলিশ এসে পৌঁছলে ষষ্ঠ মিনিটে ল্যানজা তার অন্য আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে আত্মহত্যা করে।
এর সাড়ে পাঁচ বছর আগে, ২০০৭ সালের ১৬ এপ্রিল ভার্জিনিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট অ্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সেয়াং হুই চো নামে তেইশ বছর বয়স্ক এক আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছাত্র দুটি সেমি-অটোমেটিক পিস্তলের গুলিতে ৩২ ছাত্র ও শিক্ষককে হত্যা ও ১৭ জনকে আহত করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চসংখ্যক হতাহতের ঘটনা। ঘটনা ঘটানোর পর ঘাতক চো নিজেও আত্মহত্যা করে। ঘটনার বিবরণ অনুযায়ী, হুই চো ঘটনার দিন সকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ডরমিটরিতে দুজনকে হত্যা করে। এরপর সে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে মূল ফটক তালাবদ্ধ করে একে একে চারটি ক্লাসরুমে গিয়ে নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে এবং ২৫ ছাত্র ও পাঁচজন শিক্ষককে গুলি করে হত্যা ও ১৭ জনকে আহত করে। গুলি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জানালা দিয়ে লাফিয়ে আরও ছয়জন আহত হন। পুলিশ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করার পর হুই চো নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এ হত্যাকাণ্ডের পর হুই চো’র মানসিক স্বাস্থ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার আইন, সাংবাদিকতার নীতিসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় নিয়ে তুমুল বিতর্কের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনা যা ঘটার তা ঘটে গিয়েছিল।
তদন্তকারীরা জানতে পারেন, ঘাতক চো তার মিডল স্কুল ও হাইস্কুলের বছরগুলোর অধিকাংশ সময়জুড়ে অবসাদে ভুগেছে। হাইস্কুল থেকে ভার্জিনিয়া টেক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সময় ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষাসংক্রান্ত ফেডারেল আইন অনুযায়ী ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ চো’র মানসিক অবস্থা ও থেরাপি গ্রহণের বিষয়ে কিছু জানতে পারেনি। ২০০৫ সালে দুজন ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার ঘটনা তদন্তের পর ভার্জিনিয়ার স্পেশাল জাস্টিস চো’কে মানসিকভাবে অসুস্থ ঘোষণা করেন এবং তাকে চিকিৎসা গ্রহণের আদেশ দেন। কিন্তু সে হাসপাতালে চিকিৎসা না নেওয়ায় তার মানসিক ব্যাধিকে আড়াল করে সে দুটি সেমি-অটোমেটিক পিস্তল ক্রয় করার সুযোগ গ্রহণ করে এবং দুই বছর পর তার নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭০ সাল থেকে গত ৫৫ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে আনুমানিক ১৩০০ শিক্ষার্থীকে হত্যা করার ঘটনা ঘটেছে। মাত্র চার বছর আগে ২০২২ সালের মে মাসে ১৮ বছর বয়সি যুবক স্যালভেদর রামোস টেক্সাসের উভালদে শহরের এক এলিমেন্টারি স্কুলে প্রবেশ করে একটি ক্লাসরুমে গুলি চালিয়ে ৯ থেকে ১১ বছর বয়সি ১৯ ছাত্র এবং দুজন শিক্ষককে হত্যা করে। রামোস ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশের সঙ্গেও গুলিবর্ষণ শুরু করে। দুজন পুলিশ গুলিবিদ্ধ হলেও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, জরুরি বার্তা পেয়ে পুলিশ ঘটনার অন্তত এক ঘণ্টা আগে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেও অজ্ঞাত কারণে স্কুল ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেনি। পরে ইউএস বর্ডার পেট্রোল সদস্য ও উভালদে স্কুল ডিস্ট্রিক্টের নিরাপত্তা রক্ষীদের গুলিতে ঘাতক রামোস নিহত হয়। ১৯৯৯ সালের এপ্রিলে কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের কলাম্বাইন হাইস্কুলের লাইব্রেরিতে গুলিবর্ষণে ১৬ জন নিহত ও ১৭ জন আহত, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের পার্কল্যান্ড হাইস্কুলে গুলিতে ১৭ জন নিহত ও ১৮ জন আহত হয়। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটির পর একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে চলেছে। এর যেন কোনো অবসান নেই। যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্দুকধারীদের হামলার ঘটনা বার্ষিক গড়ে প্রায় ৯০টি, যা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। সব ঘটনায় হতাহত না হলেও কোনো কোনো সময় তা ভয়াবহ হয়ে ওঠে। তবে ঘটনার পরিসংখ্যান থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং সার্বিকভাবে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ওপর চলমান আলোচনা ফলপ্রসূ প্রমাণিত হচ্ছে না।
সিএনএন ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুলিবর্ষণের ঘটনার ওপর এক জরিপ চালিয়ে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল তাতে দেখা যায়, ওই দশকে যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২৮৮টি গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সেক্ষেত্রে একই সময়ে মেক্সিকোতে ঘটেছে আটটি, দক্ষিণ আফ্রিকায় ছয়টি, নাইজেরিয়ায় চারটি, পাকিস্তানে চারটি, আফগানিস্তানে তিনটি, কানাডা, ব্রাজিল ও ফ্রান্সে দুটি করে ঘটনা, আরও ১২টি দেশে একটি করে ঘটনা ঘটেছে। এ পরিসংখ্যানে এটা স্পষ্ট যে, ইউরোপের দেশগুলো এবং অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্দুকধারীর হামলার কোনো ঘটনা নেই। মধ্যম আয়ের, স্বল্পোন্নত এবং তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে না। সেক্ষেত্রে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ, মানবাধিকার রক্ষার মহান ও সবচেয়ে নিরাপদ দেশ হিসাবে খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা ও নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুদের হত্যা করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?
গবেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুলিবর্ষণ ও শিক্ষার্থীদের হত্যাকাণ্ড জটিল এক ইস্যু এবং বহু কার্যকারণ দ্বারা প্রভাবিত; যারমধ্যে প্রধান হলো আগ্নেয়াস্ত্রের সহজপ্রাপ্যতা। এছাড়া সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সমস্যা এবং সাংস্কৃতিক কারণেরও প্রভাব রয়েছে। তবে বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বেসামরিক নাগরিকদের সহজে আগ্নেয়াস্ত্রের মালিকানা লাভের কারণে বর্তমানে প্রতি ১০০ জন আমেরিকানের কাছে ১২০টি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেসামরিক নাগরিকদের কাছে থাকা আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা বেশি। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে গুলিবর্ষণ করতে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রের সবই সেমি-অটোমেটিক এবং যেসব তরুণ হত্যা করতে এসব আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে, তাদের কাছে ও বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধারকৃত বুলেটের সংখ্যাও পর্যাপ্ত। প্রায় প্রত্যেকের মালিকানায় বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে ষোলো বছর বয়সি যে কোনো আমেরিকান নাগরিক ও প্রাপ্তবয়স্ক গ্রিনকার্ডধারী বা স্থায়ী বাসিন্দার ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অধিকার রয়েছে। কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে আগ্নেয়াস্ত্রের মালিকানা লাভের জন্য ক্রেতার ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই করার বিধান পর্যন্ত নেই। ফলে অপরাধপ্রবণ মানসিকতার ব্যক্তিকেও বৈধভাবে আগ্নেয়াস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে কার্যত কোনো বাধার মুখে পড়তে হয় না।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলাকারীদের প্রত্যেকে তরুণ এবং কোনো না কোনো ধরনের মানসিক জটিলতা ও অবসাদে আক্রান্ত। কেউ কেউ আত্মহত্যাপ্রবণ, কারও বা প্রতিশোধ গ্রহণের মানসিকতা ছিল। কারণ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘাতক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে আত্মহত্যা করেছে। গবেষকদের বিশ্বাস, আত্মহত্যা করার আগে প্রত্যেক ঘাতক হত্যাকাণ্ডকে তার প্রতি সবার মনোযোগ আকর্ষণের উপায় হিসাবে বেছে নেয়। সহিংস চলচ্চিত্র, ভিডিও গেম এবং কমিক বইয়ের প্রতি আসক্তির মতো বিনোদনও অনেককে প্রভাবিত করে বলে তারা মনে করেন। তবে সবাই দুটি বিষয়ে মোটামুটি একমত যে, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনকে কঠোর করতে হবে, যাতে তরুণদের হাতে সহজে আগ্নেয়াস্ত্র না পড়ে এবং আগ্নেয়াস্ত্রের মালিকানা লাভের আগে প্রত্যেকের ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাইসহ মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক