ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

উত্তরবঙ্গের বৈষম্য নিরসন রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার হোক সমতা

মো: শামীম মিয়া
উত্তরবঙ্গের বৈষম্য নিরসন রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার হোক সমতা

বাংলাদেশের উন্নয়ন আজ বিশ্বজুড়ে আলোচিত বিষয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে শুরু করে বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসিত হচ্ছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, অবকাঠামো উন্নত হয়েছে, সামাজিক সূচকে সাফল্য এসেছে। কিন্তু উন্নয়নের এই আলো কি দেশের প্রতিটি কোণ সমানভাবে ছুঁয়ে গেছে? যদি সত্যিই তাই হতো, তাহলে উত্তরবঙ্গ- বিশেষ করে রংপুর বিভাগ- এখনও কেন দারিদ্রে?্যর প্রতীক হয়ে আছে? প্রশ্নটা শুধু আঞ্চলিক নয়, জাতীয় উন্নয়ন ও ন্যায্যতার প্রশ্ন। কারণ, রাষ্ট্র শুধু রাজধানী ঢাকা বা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য নয়, বরং সমগ্র দেশের মানুষের জন্য। উত্তরবঙ্গের বঞ্চনার ইতিহাস দীর্ঘ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও এই অঞ্চল এখনও উন্নয়নের মূলধারার বাইরে পড়ে আছে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কর্মসংস্থানের অভাব ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা মিলিয়ে এখানে দারিদ্রে?্যর শেকড় এতটাই গভীর যে, মানুষকে আজও ‘মঙ্গাপীড়িত’ অঞ্চলের তকমা বয়ে বেড়াতে হয়। অথচ এ অঞ্চলেই দেশের খাদ্যশস্যের বড় অংশ উৎপাদিত হয়। তাহলে কেন এমন বৈষম্য? উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ইতিহাস, সরকারি বাজেট বণ্টন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবের দিকে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : উত্তরবঙ্গের দীর্ঘ বঞ্চনা উত্তরবঙ্গের বৈষম্য নতুন নয়। পাকিস্তান আমল থেকেই এই অঞ্চলকে অবহেলা করা হয়েছে। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশকে যেমন বঞ্চিত করত, তেমনি অভ্যন্তরীণভাবে উত্তরবঙ্গও ঢাকাকেন্দ্রিক শাসন ও বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়। স্বাধীনতার পর আশা ছিল যে এই বৈষম্য ঘুচে যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, কেন্দ্রীয়করণের সংস্কৃতি আরও শক্ত হলো। ঢাকা হলো প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু। সব বড় শিল্পকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, অবকাঠামো বিনিয়োগ ঢাকাকে ঘিরেই হতে থাকে। উত্তরবঙ্গের মানুষ বারবার বঞ্চিত হয়েছে, আর এই বঞ্চনার ফলেই এখানে দারিদ্র্যের হার জাতীয় গড়ের তুলনায় সর্বদা বেশি থেকেছে।

বাজেট বণ্টনের নির্মম বৈষম্য : দেশের প্রায় আট ভাগের এক ভাগ মানুষ বাস করেন রংপুর বিভাগে। দীর্ঘকাল ধরে সরকারি বরাদ্দ কম থাকার কারণে দেশের সবচেয়ে অনুন্নত এলাকা বলে পরিচিতি পেয়েছে এই বিভাগ। দেশে যখন গড় উন্নয়ন লক্ষ্যে কোটি কোটি টাকা দিয়ে উপরে উঠছে, তখনও নিচে নামছে রংপুরের গড় উন্নয়ন। সরকারি কোনো বরাদ্দ থাকলেও স্বাভাবিকভাবে আট ভাগের এক ভাগ পাওয়ার কথা রংপুরের; সেজন্য ১০০ ভাগের মধ্যে এক ভাগও পাচ্ছে না রংপুর বিভাগ। বিশেষ সুবিধা দূরে থাক, স্বাভাবিক প্রাপ্যতাও চলতি অর্থবছরে পর্যাপ্তভাবে পায়নি রংপুর। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকারি বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে রংপুর বিভাগের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ১ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা রংপুর বিভাগের জন্য শতাংশ হিসেবে বরাদ্দ মাত্র ০.৯৮ শতাংশ- অর্থাৎ মোট বাজেটের ১০০ টাকা ধরা হলে রংপুরের ভাগে পড়ে ১ টাকাও কম। এটা একটি উদাহরণ বিগত সরকারের আমলে গৃহীত বরাদ্দের। চলতি বা পূর্ববর্তী বছরে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দও অত্যন্ত নগণ্য। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রাপ্তিযোগ্য বাজেটের তুলনায় রংপুর বিভাগের বরাদ্দ ছিল খুবই অপ্রতুল। ওই বছর রংপুর সিটি কর্পোরেশন পেয়েছিল মাত্র ৪০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা; ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রাপ্ত বরাদ্দ ছিল মাত্র প্রায় ২০ কোটি টাকা। একারণেই একাদশ বছরব্যাপী ১২টি সিটি কর্পোরেশনের জন্য নির্ধারিত টাকার মধ্যে রংপুরের অংশ খুবই নগণ্য রয়ে গেছে।

অবকাঠামো ও শিল্পায়নের অভাব : উন্নয়নের আরেকটি বড় সূচক হলো অবকাঠামো ও শিল্পায়ন। উত্তরবঙ্গ এই ক্ষেত্রে ভয়াবহভাবে পিছিয়ে। এখানে এখনও কার্যকর কোনো শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠেনি। বড় কোনো কলকারখানা নেই। ফলে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বাইরে কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই বললেই চলে। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও অবস্থা একই। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল একমাত্র ভরসা হলেও সেটি পুরো অঞ্চলের চাহিদা মেটাতে পারে না। রোগীদের ঢাকায় ছুটে আসতে হয়, যেখানে অনেকে পথে প্রাণ হারান। অন্যদিকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনায় একের পর এক বিশেষায়িত হাসপাতাল ও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠছে। যোগাযোগব্যবস্থায় কিছু উন্নয়ন হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। রেললাইন আধুনিক হয়নি, অভ্যন্তরীণ সড়কব্যবস্থা নাজুক, শিল্পপণ্যের বাজারজাতকরণে সমস্যা রয়ে গেছে। ফলে কৃষিপণ্য উৎপাদন করেও কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পান না।

মানবিক দৃষ্টিকোণ: এক অদৃশ্য ট্র?্যাজেডি : উত্তরবঙ্গের বৈষম্যের পরিসংখ্যানের পেছনে আছে হাজারো মানুষের অদৃশ্য কষ্ট। শীতকালে ‘মঙ্গা’ নামের দুর্ভিক্ষসদৃশ পরিস্থিতি আজও পুরোপুরি দূর হয়নি। কর্মসংস্থানের অভাবে অনেকে মৌসুমি শ্রমিক হয়ে দক্ষিণাঞ্চল বা ঢাকায় কাজ করতে যায়। একজন কৃষকের গল্প ধরা যাক। তিনি জমিতে আলু চাষ করেন; কিন্তু বাজারে আলুর দাম এত কম যে উৎপাদন খরচও উঠে আসে না। প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প না থাকায় পণ্য নষ্ট হয়ে যায়। আবার, এক দরিদ্র পরিবার তাদের অসুস্থ শিশুকে রংপুর থেকে ঢাকায় নিয়ে আসতে গিয়ে পথেই শিশুটিকে হারায়- কারণ, চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত হাসপাতাল নেই। এই বাস্তব গল্পগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং রাষ্ট্রীয় অবহেলার মর্মান্তিক চিত্র।

বৈষম্যের অর্থনৈতিক প্রভাব : অর্থনীতিবিদদের মতে, একটি অঞ্চল অবহেলিত থাকলে তা গোটা দেশের প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। উত্তরবঙ্গ কৃষিনির্ভর হলেও কৃষিভিত্তিক শিল্প না থাকায় এর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অপূর্ণ থেকে যায়। বাংলাদেশ যদি সত্যিই মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশে রূপান্তরিত হতে চায়, তবে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করাই প্রথম শর্ত। কারণ, উত্তরবঙ্গের প্রায় দুই কোটি মানুষ যদি দারিদ্রে?্যর ফাঁদে আটকা থাকে, তাহলে জাতীয় প্রবৃদ্ধি কখনও টেকসই হবে না।

সমাধানের রূপরেখা : কী করা প্রয়োজন? উত্তরবঙ্গের বৈষম্য নিরসনে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি- ন্যায্য বাজেট বরাদ্দ: বাজেট বণ্টনে জনসংখ্যার অনুপাত ও উন্নয়ন সূচককে ভিত্তি করতে হবে। শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক অঞ্চল: রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও ঠাকুরগাঁওয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পাঞ্চল স্থাপন করতে হবে। চিকিৎসা ও শিক্ষা অবকাঠামো: রংপুরে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিটি জেলায় আধুনিক হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা প্রয়োজন। কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ: আলু, ধান, ভুট্টা ও সবজি প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তুলতে হবে। যোগাযোগ ও রেল উন্নয়ন: উত্তরবঙ্গের রেললাইন আধুনিকীকরণ, সড়ক উন্নয়ন ও পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্পের সঙ্গে কার্যকরভাবে যুক্ত করা জরুরি। রাজনৈতিক সদিচ্ছা: সবচেয়ে বড় বিষয় হলো রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

উত্তরবঙ্গকে উন্নয়নের অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাংলাদেশ শুধু রাজধানী ঢাকা বা দক্ষিণাঞ্চলকে কেন্দ্র করে টিকে থাকতে পারবে না। প্রকৃত উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন দেশের প্রতিটি অঞ্চল সমান সুযোগ পাবে। উত্তরবঙ্গের মানুষ বারবার অবহেলার শিকার হয়েছে, এখন সময় এসেছে সেই বঞ্চনা দূর করার। উত্তরবঙ্গের বৈষম্য নিরসন শুধু মানবিক দায় নয়, এটি জাতীয় উন্নয়নের শর্ত। যদি আমরা সমতাভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে না পারি, তবে আমাদের প্রবৃদ্ধি কখনও টেকসই হবে না। রাষ্ট্রের কাছে আজকের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত- উত্তরবঙ্গের সমতা প্রতিষ্ঠা। কারণ, উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন মানে শুধু এক অঞ্চলের উন্নয়ন নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি বহুগুণে বাড়ানো।

লেখক : কলামিস্ট, আমদিরপাড়া, জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত