ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি

মো. তাহমিদ রহমান
দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি

বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগজনক দুটি শব্দ হলো- ‘দারিদ্র্য’ ও ‘দ্রব্যমূল্য’। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবন যখন ওষ্ঠাগত তখন রাষ্ট্রের কর্তাবাবুগণ ব্যস্ত হয়ে গেছে নির্বাচন নিয়ে। কিন্তু যাদের জন্য নির্বাচন সেই গণজনতা ভালো নেই ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যের এই বাজারে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনে অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছে। এই সমস্যা নতুন নয়, তবে সম্প্রতি তা ভয়াবহ রূপধারণ করেছে। দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী সর্বদাই অর্থনৈতিক চাপের চক্রে আবদ্ধ। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। আমরা আমজনতা চাই দেশটা ভালো চলুক সেই সঙ্গে ভালো চলুক আমাদের সংসার জীবন। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের উত্তাপে দেশের সব নিম্ন ও মধ্যবিত্তের সংসারের টালমাটাল অবস্থা। অস্থির বাজার ব্যবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি পণ্যের মূল্য বেড়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণ বা পণ্যমূল্য যৌক্তিক রাখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর ভূমিকা তেমন একটা নেই বললেই চলে। একাধিক জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) চালের দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। সপ্তাহের ব্যবধানে মুরগির দাম কেজিতে বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। ব্রয়লার মুরগির কেজিপ্রতি ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সোনালি মুরগি মানভেদে ২৭০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সপ্তাহখানেক আগেও কেজিপ্রতি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা এবং সোনালি মুরগি ছিল ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা। ডিমের দামও বেড়েছে। খুচরায় প্রতি ডজন ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়। বেড়েছে সবজির দামও। প্রতি কেজি গোল বেগুন ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লম্বা বেগুনের কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা, লাউ ১০০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। বেড়েছে অন্যান্য সবজির দামও। পেঁয়াজের দাম বাড়ছে অব্যাহতভাবে। ভারত, পাকিস্তান, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করার পরও ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে কমছে না পেঁয়াজের দাম। এখন খুচরায় প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত মজুদদারির মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। বাজারে দাম বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীদের হাজারো অজুহাত। এ জন্য বাজারসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কার্যক্রম বাড়াতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি রোধ করতে হবে। অতীতে রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজির কারণে দাম বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ ছিল।

এখনও অনেক ব্যবসায়ী চাঁদাবাজির অভিযোগ করছেন। বিষয়টি ভালোভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। অভিযোগ সত্য হলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পেঁয়াজ ও আলুর দাম সহনীয় রাখতে সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। দৈনিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে নাগরিকদের জীবনমান নিম্নগামী হচ্ছে। অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন একবেলা খাবার কমাতে, সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ করে দিচ্ছেন কিংবা স্বাস্থ্যসেবা থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখছেন। ক্রমে কঠিন হয়ে উঠছে দৈনন্দিন জীবন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পারছেন না দেশের মানুষ। পণ্যের অত্যাধিক মূল্যের কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ক্যাব। বেড়েছে শিক্ষা উপকরণের দামও। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও ওষুধপত্র, চিকিৎসা সরঞ্জামসহ সবকিছুরই মূল্য সাধারণ মানুষের আওতার বাইরে বলা যায়। এসব কারণে নগরজীবনে টিকে থাকাই এখন বড় লড়াই। প্রতিবছর আগস্ট মাসে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয় তাঁর তুলনায় এবার বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম ছিল। ফলে বন্যায় ফল ও ফসল নষ্ট হয়নি। সে হিসেবে সবজির ফলন ভালো হয়েছে। যেহেতু প্রাকৃতিক দূর্যোগ ছিলোনা তাই সবজি ভালো ফলনের কারণে দাম তুলনামূলক কম হওয়ার কথা। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য, যথাযথ তথ্যের অভাব, চাঁদাবাজি ও পণ্য পরিবহনে বাড়তি খরচের কারণে খুচরা বাজারে সবজির দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে। সরকারের তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বহীনতায় সবজির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মাছ ও মাংসের গড় দামও। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, পাঁচ ধরনের মাছের দাম বেড়েছে গড়ে ১৮ শতাংশ। মাংস ও ডিমের গড় মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ৭ শতাংশ। চাল, ডাল, তেলের পাশাপাশি সবজি, মাছ ও মাংসের দাম বাড়াতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের সংসারের আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সম্মানের সঙ্গে জীবনযাপন করতে চায়; কিন্তু বর্তমান বাজার দামে তাদের জন্যে সেই সম্মান টিকিয়ে রাখা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। একদিকে ঘরভাড়া, স্কুল-কলেজের বেতন, পরিবহন খরচ, আরেকদিকে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, সব মিলিয়ে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ চরমভাবে কোণঠাসা। বাজার তদারকি ও দ্রব্যমূল্য রোধে সরকার তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দেশে দারিদ্র্যের হার পুনরায় বাড়বে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে অনেক পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। বিশেষ করে প্রান্তিক এলাকা, চরাঞ্চল, উপকূলীয় এলাকা ও পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে এর প্রভাব বেশি দৃশ্যমান।

এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে নিম্নবিত্ত শ্রেণি, যারা দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে জীবনযাপন করে। শহরের বস্তিগুলোতেও একই চিত্র, একজন রিকশাচালক বা গার্মেন্টস কর্মী সারাদিন পরিশ্রম করেও তার পরিবারকে দুবেলা খাবার দিতে হিমশিম খাচ্ছে। আগে যে পরিবার মাসে ১০-১২ হাজার টাকায় কোনোরকমে চলতে পারত, এখন সেই খরচ দাঁড়িয়েছে ১৫-২০ হাজার টাকার ওপরে। অথচ আয় বৃদ্ধি পায়নি। ফলে দৈনিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে তাদের জীবনমান হয়েছে নিম্নগামী। বিগত দিনগুলোতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানা উদ্যোগ থাকলেও বাস্তবে এর সুফল সাধারণ মানুষের ঘরে পৌঁছাতে পারেনি। টিসিবির ট্রাকসেল, রেশন কার্ড, ভর্তুকি মূল্যে পণ্য সরবরাহ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং দলীয়করণের অভিযোগ বহুদিন ধরেই। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) একটি সেবামূলক ব্যবসা। নিকট অতীতে সেবামূলক এ ব্যবসাকে পুঁজি করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দুর্নীতি নিয়ে বিস্তর অভিযোগ আছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে দৈনিকভিত্তিক স্বল্প আয়ের মানুষের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী অনেকেই আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য বজায় রাখতে বাধ্য হচ্ছেন টিসিবির পণ্য কিনতে। টিসিবির পণ্য বিতরণে দেখা যাচ্ছে, যাদের প্রকৃতপক্ষে এই সহায়তা প্রয়োজন, তারা প্রায়শই বঞ্চিত হচ্ছেন।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত