ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতাই এখন বড় সমস্যা

মো. সাখাওয়াত হোসেন
জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতাই এখন বড় সমস্যা

দেশের বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। অনিরাপদ বোধ করছে অনেকেই। পত্রিকার পাতা খুললেই কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সামনে বসলেই অন্যায়, অনিয়ম ও অপরাধের খবর চোখে আসে। অনেকেই বলে থাকে, পুলিশ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না কিংবা পুলিশের হারানো মনোবল এখনও পুনরুদ্ধার না হওয়ায় পুলিশ কার্যকর সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিষয়গুলোকে গভীরভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। কেননা, দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। দেশের জনসংখ্যার তুলনায় পুলিশের সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল। এছাড়া পুলিশ অধিক মাত্রায় সিকিউরিটি ওরিয়েন্টেড, আদতে যেটি সার্ভিস ওরিয়েন্টেড হওয়া জরুরি। এই অপ্রতুল পুলিশ বাহিনী (সংখ্যানুপাতে) দিয়ে বিশাল জনগোষ্ঠীর সেবা ও সম্পদের সুরক্ষা প্রদান কি আদৌ সম্ভব? এ কারণে বিকল্প ব্যবস্থার খোঁজ করা উচিত এবং এর পাশাপাশি পুলিশকে ঢেলে সাজাতে ব্যাপকভাবে সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত। বাংলাদেশে প্রতিটি থানায় ৫০ থেকে ৬০ জনের একটি টিম থাকে এবং সংশ্লিষ্ট থানায় জনসংখ্যা থাকে প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ। তাহলে ৫০ থেকে ৬০ জনের টিম দিয়ে অধিক সংখ্যাবেষ্টিত কোনো থানার নিরাপত্তা প্রদান করা মোটেই সম্ভব নয়। আবার মামলার দীর্ঘসূত্রতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, তদন্তে গাফিলতি কিংবা ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত প্রভৃতি কারণে ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের ওপর জনগণের নির্ভরশীলতা ক্রমান্বয়ে নেতিবাচক পর্যায়ে চলে এসেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। পৃথিবীর বেশ কিছু শিল্পোন্নত দেশে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে অপরাধীকে প্রতিহত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে; কিন্তু অপরাধ কোনোভাবেই কমছে না, ক্ষেত্রবিশেষে বেড়েছে। এ ধরনের উদাহরণ থেকে ব্যতিক্রমও রয়েছে, যেখানে দেখা যায় পৃথিবীর অসংখ্য দেশ ফরমাল বিচারব্যবস্থার চেয়ে ইনফরমাল অর্থাৎ সামাজিক ন্যায়বিচারের ওপর ভরসা করছে এবং ইতিবাচক ফলাফলও পাচ্ছে। পৃথিবীতে শতাধিক দেশে সামাজিক ন্যায়বিচার পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশেও ফরমাল জাস্টিস সিস্টেমের পাশাপাশি ইনফরমাল জাস্টিস সিস্টেমকে জনপ্রিয় করে তোলা যায় কি না, ভেবে দেখা যেতে পারে।

সামাজিক ন্যায়বিচারে বাদী-বিবাদী ও সমাজের প্রতিনিধির সমন্বিত অংশগ্রহণ থাকে। অর্থাৎ তিন পক্ষকে একত্র করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিচারসম্পন্ন করা হয়, যেখানে বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করা হয়। কিন্তু ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের বিচারপ্রক্রিয়ায় একজন লাভবান হন, ভিন্নজন ক্ষতিগ্রস্ত হন। সামাজিক ন্যায়বিচারে বাদী কোনোভাবে অপরাধ সংঘটনে বিবাদীকে প্ররোচনা প্রদান করেছেন বা উদ্বুদ্ধ করেছেন। এ ব্যাপারেও আলোচনা করা হয়। আলোচনায় যিনি বাদী প্রকৃত অর্থে ভুক্তভোগী, তার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা হয় এবং অপরাধের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করা হয়। অন্যদিকে বিবাদী অপরাধ সংঘটনের জন্য তার দায় স্বীকার করে নেন এবং অপরাধ ঘটায় বাদীর কোনো ভূমিকা রয়েছে কি না, সে বিষয়েও জানা হয়। এ ছাড়া অপরাধ ঘটার পেছনে প্রকৃত অর্থে কী কারণ রয়েছে, সেসব উন্মোচন করা হয়। অর্থাৎ ঘটনার পেছনের ঘটনা উদ্ঘাটন করা হয়, অপরাধের প্রকৃত কারণ নির্ণয় করা হয়। শুধু তা-ই নয়, অপরাধের ক্ষয়ক্ষতি লাঘবে ভুক্তভোগী কী প্রত্যাশা করেন, সেটিও জানা যায়, সামাজিক বিচারব্যবস্থাপনায়।

অন্যদিকে বিবাদী কীভাবে এবং কোনো প্রক্রিয়ায় ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে পারবেন, সে ব্যাপারটিও জানা হয়। ভুক্তভোগী ও বিবাদী উভয়কে সমাজের পক্ষ থেকে যে ধরনের সহায়তা প্রদান করা হবে, সে ব্যাপারেও তাদের জানানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ একটি সমন্বিত ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতার জায়গা থেকে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে একত্র করে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বিচার নিষ্পত্তি করা হয়, যেখানে বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষই উপকৃত হয় এবং বিচারপ্রক্রিয়া শেষে উভয় পক্ষই যাতে সমাজে সামাজিক পরিবেশে সৌহার্দ্যপূর্ণ উপায়ে বসবাস করতে পারে, সে ব্যাপারে সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে থাকেন। ন্যায়বিচার নিশ্চিতের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করা এবং সমাজের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বশীলতার জায়গাকে সুদৃঢ় করতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করা। সমাজে নাগরিকদের সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে হয়। কিন্তু আদতে আমরা কি সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করছি? দেখা যাচ্ছে, পাশের ফ্ল্যাটে একজন মানুষ খুন হয়ে যাচ্ছে কিংবা অন্য অপরাধে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অথচ আমরা কোনো রকমের খোঁজখবর রাখছি না।

কাজেই চলমান বাস্তবতা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে, সবার নিরাপত্তার স্বার্থে সম্মিলিতভাবে পরস্পরের পাশে দাঁড়াতে হবে। কিশোর অপরাধের কথাই ধরুন। দেখা যাচ্ছে, যেসব পরিবারের মা-বাবার মধ্যে সমস্যা পরিলক্ষিত হয়, মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ হয় কিংবা মা-বাবা আলাদা থাকছেন, ওই সব পরিবারের সন্তানই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে কিংবা মা-বাবা থেকে দূরে থাকার কারণে কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কিশোর অপরাধের ভয়াবহতায় সারা দেশ তটস্থ, অথচ সংশ্লিষ্ট এলাকায় যদি সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রিয়াশীল হতো, তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায় কিশোররা অপরাধীর খাতায় নাম লেখাত না। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বলা যায়, সামাজিক ন্যায়বিচারের বহুবিধ গুরুত্ব রয়েছে। সমাজে যে ছোট অপরাধগুলো সংঘটিত হয়, প্রতিটি অপরাধের নিষ্পত্তি সমাজেই হওয়া উচিত। তা না হলে সমাজ প্রতিষ্ঠার সার্থকতা বিনষ্ট হয়ে যায়।

রাষ্ট্রের প্রচলিত বিচারব্যবস্থায় যদি কোনো অপরাধের নিষ্পত্তি হয়, তাহলে দেখা যায় বাদী-বিবাদীর মধ্যে আজীবনের জন্য একটি বৈরী সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। এ ধরনের সম্পর্ক একটি সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। সংগত কারণেই সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সমাজকে ঢেলে সাজাতে হবে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি শিশুর বেড়ে ওঠা, বড় হওয়া, কর্মসংস্থানে প্রবেশের মিথস্ক্রিয়ায় একজন নাগরিক সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে ওঠেন। দায়িত্বশীল মানুষ মাত্রই সমাজের সমস্যাকে সামাজিকভাবে নিষ্পত্তি করার তাড়নায় প্রাগ্রসর হন। ফলে দেখা যায়, সমাজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলোই একটি সমাজকে নিরাপদ ও সবার জন্য বাসযোগ্য হিসেবে তৈরি করে থাকে। জমিসংক্রান্ত বিরোধ, কিশোর অপরাধ, ইভটিজিং, পারিবারিক বিরোধ, চুরি, ছিনতাই, ঘুষ লেনদেন, চাঁদাবাজিসহ অসংখ্য অপরাধের বিচারকাজ সামাজিকভাবেই করা সম্ভবপর। নপারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও টেকসই সমাজ গঠনে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সামাজিক ন্যায়বিচার পৃথিবীব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশেও প্রচলিত ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের ওপর চাপ কমানো, বিচারিক প্রক্রিয়াকে সহজীকরণ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতে সামাজিক বিচার-ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করা উচিত।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত