প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
আজ ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। গণতন্ত্র সম্পর্কে এবং এর অন্তর্নিহিত শক্তি উপলব্ধি করতে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য ২০০৭ খ্রি. থেকে শুরু করে প্রতি বছর ১৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর প্রচলিত একটি বিশেষ দিন ‘আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস’। এদিবসের মূল লক্ষ্য হলো গণতন্ত্রের নীতিগুলো প্রচার ও সমুন্নত রাখা, যা স্বাধীনতা, আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার, জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান ও মানবাধিকারকে সমর্থন করে। চলতি বছরের আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসের মূল প্রতিপাদ্য: ‘গভরনেন্স ও সিটিজেন এনগেজমেন্টের জন্য এআই নেভিগেট করা’, তথা সুশাসন ও নাগরিক অংশগ্রহণের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করা।
আইনের প্রতি আনুগত্য নিশ্চিত করতে হলে প্রযুক্তির উৎকর্ষতাকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। এই প্রতিপাদ্যটি প্রভূত কালোপযোগী, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সুশাসন ও নাগরিক সম্পৃক্ততার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সর্বজনীন মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে প্রাণোৎসর্গকারী-দের প্রতি আজকের এই গণতন্ত্র দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। আত্মদানকারী নিরপরাধ ব্যক্তিদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।
বাংলা ‘গণতন্ত্র’ পরিভাষাটি ইংরেজি ডেমোক্রেসি থেকে এসেছে। এই ইংরেজি শব্দটি আবার এসেছে গ্রিক শব্দ (দেমোক্রাতিয়া) থেকে, যার অর্থ ‘জনগণের শাসন’ শব্দটির দুইটি মূল হচ্ছে (দেমোস) ‘জনগণ’ ও (ক্রাতোস) ‘ক্ষমতা’ থেকে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকে অ্যাথেন্স ও অন্যান্য গ্রিক নগররাষ্ট্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝাতে শব্দটির প্রথম ব্যবহার হয়। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ক্লিসথেনিসের নতুন ধরনের সরকার চালু হয় এবং সেই সঙ্গে বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্র সৃষ্টি হয় গ্রিসের ছোট একটি শহর-রাষ্ট্র এথেন্সে। তার বদলে তিনি মানুষের নতুন জোট তৈরি করেন এবং প্রতিটি জোটকে ডিময় (Demoi) অথবা প্যারিশ (Parish)- এ বিভক্ত করেন। প্রতিটি মুক্ত নাগরিককে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে শহর-রাষ্ট্রের সরকার পরিচালনায় সরাসরি অংশগ্রহণের অধিকার দেওয়া হয়। সাধারণভাবে এই ঘটনাকেই গণতন্ত্রের প্রথম উন্মেষরূপে গণ্য করা হয়, যার পরে নাম হয় ডেমক্রেশিয়া (Democratia) যার অর্থ হচ্ছে জনগণের (demos) শক্তি (Kratos)। পরে ১৯শ ও ২০শ শতকের ভোটাধিকার আন্দোলনের মাধ্যমে সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের জন্য প্রসারিত হয়।
নানা সময়ে নানা উপায়ে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪২২ সালে ক্লিয়ান ডেমোক্রেসিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে- ‘That shall be the democratic which shall be the people, for the people.’ যার অর্থ হলো এটাই হবে গণতান্ত্রিক, যা হবে জনগণ, জনগণের জন্য। অনেক পরে আব্রাহাম লিঙ্কন November ১৯, ১৮৬৩ তারিখে জনপ্রিয় সংজ্ঞা প্রদান করেন, তিনি Pennsylvania state এর গেটিসবার্গ বক্তৃতাতে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন এভাবে ‘Government of the people, by the people, for the people.’ যার অর্থ হলো-গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের অংশগ্রহণ, জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য। অধ্যাপক গেটেলের মতে,’ যে শাসন ব্যবস্থায় জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগে অংশ নেওয়ার অধিকারী তাই গণতন্ত্র।
এরিস্টটল গণতন্ত্র সম্পর্কে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছেন। তিনি গণতন্ত্রকে সরকারব্যবস্থার একটি রূপ হিসেবে দেখেছেন, যেখানে জনগণের ইচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা সর্বদা সেরা বা ন্যায়সংগত সিদ্ধান্তে পৌঁছায় না। তার বিখ্যাত উক্তি হলো-গণতন্ত্র তখনই হয় যখন দরিদ্ররা শাসন করে, সম্পদশালী ব্যক্তিরা নয়। প্লেটো গণতন্ত্র সম্পর্কে বেশ সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। তিনি মনে করতেন যে গণতন্ত্র জনসাধারণের আবেগনির্ভর সিদ্ধান্তের কারণে বিশৃঙ্খলায় পরিণত হতে পারে এবং শেষ পর্য্যন্ত স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দিতে পারে। তার উল্লেখযোগ্য উক্তি-গণতন্ত্র এক মনোমুগ্ধকর সরকার ব্যবস্থা, যা বৈচিত্র্য ও বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ; এবং এটি সমান ও অসম ব্যক্তিদের জন্য একধরনের সমতা প্রদান করে। অতিরিক্ত স্বাধীনতা, তা রাষ্ট্রে হোক বা ব্যক্তির মধ্যে, একসময় কেবলমাত্র অতিরিক্ত দাসত্বের দিকে নিয়ে যায়। স্বৈরতন্ত্র সাধারণত গণতন্ত্র থেকে জন্ম নেয়, এবং চরম স্বাধীনতা থেকে সবচেয়ে কঠোর স্বৈরাচার ও দাসত্বের সৃষ্টি হয়।
দ্য রিপাবলিক-এ গণতন্ত্রকে এমন একটি শাসনব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করেন, যেখানে সাধারণ জনগণ প্রায়শই আবেগপ্রবণ ও অনভিজ্ঞ নেতাদের নির্বাচন করে, যা শেষ পর্য্যন্ত রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে গণতন্ত্র হচ্ছে ‘আলোচনাভিত্তিক শাসন’-এই দর্শনটি বর্তমানে প্রাশ্চাত্যে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং গণতন্ত্রকামী উন্নত দেশগুলোতে এ ধারণাটি আজকাল বেশ ভালোভাবেই অনুসৃত হচ্ছে। শুধু অমর্ত্য সেনই নন, আরেক বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন যেমন বলেছেন-‘অবাধ, মুক্ত এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গণতন্ত্রের ধারণার একজন শক্তিশালী প্রবক্তা ছিলেন, তিনি মনে করতেন গণতন্ত্র কেবল রাজনৈতিক ব্যবস্থা নয়, বরং মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক মুক্তি এবং আত্মবিকাশের একটি পথ। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, সর্বজনীন শিক্ষা, এবং সামাজিক ন্যায়বিচার ছাড়া প্রকৃত গণতন্ত্র সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথের লেখনী, যেমন ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে গণতন্ত্রের বিভিন্ন দিক, জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা, এবং রাজনৈতিক আন্দোলনকে তুলে ধরা হয়েছে, যা তার গণতান্ত্রিক চিন্তাধারাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার মাধ্যমে স্বাধীনতার দাবি তুলে ধরেন এবং ভারতবাসীকে তাদের অধিকারের জন্য সোচ্চার হতে অনুপ্রাণিত করেন। তার শক্তিশালী লেখাগুলো মানুষকে নিজেদের অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস জোগাতো, যা মত প্রকাশের স্বাধীনতারই এক প্রকার রূপ। তার বেশ কিছু লেখা এবং কাজ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, যা ব্রিটিশ শাসনামলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের সীমাবদ্ধতার প্রমাণ দেয়। নজরুল নিজে এই সীমাবদ্ধতা ভাঙতে চেয়েছিলেন। তার বিখ্যাত কবিতাগুলোতে, যেমন ‘বিদ্রোহী’-তে, তিনি সব প্রকার শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেন। তার লেখায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কোনো মানুষ বা সমাজ যেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত না হয়।
কিন্তু গণতন্ত্রের সঠিক সংজ্ঞা নিয়ে সবাই একমত নয়। দার্শনিক কার্ল পপার বলেছেন, গণতন্ত্র মানে জনগণের শাসন, আর জনগণের শাসন করার অধিকার আছে। গণতন্ত্র হলো এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে ক্ষমতা থাকে জনগণের হাতে। সহজভাবে বললে, গণতন্ত্রে নেতারা নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। আরেকটু বিস্তারিতভাবে বললে, গণতন্ত্র শুধু নির্বাচনই নয়, এতে নাগরিকদের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তাও থাকে। গণতন্ত্র এমন শাসনব্যবস্থার বিপরীত, যেখানে ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে না, যেমন স্বৈরাচারী ব্যবস্থা। এমনকি স্বৈরাচারী দেশগুলোও নিজেদের গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে। তবে, ভি-ডেম এবং ইকোনমিস্টের গণতন্ত্র সূচক অনুযায়ী, ২০২২ সাল পর্য্যন্ত বিশ্বের অর্ধেকেরও কম মানুষ গণতন্ত্রে বাস করে।
প্রজাতন্ত্র প্রায়ই গণতন্ত্রের সঙ্গে মিলে যায়, কারণ দুটোতেই জনগণের সম্মতিতে শাসন চলে। তবে প্রজাতন্ত্র মানেই গণতন্ত্র নয়, কারণ প্রজাতন্ত্রে জনগণ কীভাবে শাসন করবে তা বলা থাকে না। এ সময় গণতন্ত্র শব্দটা সাধারণত রাষ্ট্রের জন্য ব্যবহৃত হলেও, এর নীতি ক্লাব, সংগঠন বা কোম্পানির মতো জায়গাতেও ব্যবহার করা যায়।
গণতন্ত্র মারা যাচ্ছে না, কিন্তু এখন এটি একটি অনিশ্চিত মধ্যবয়সের সংকটে পড়েছে। এটাই মনে করছেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের প্রধান ডেভিড রাঞ্চিম্যান। গণতন্ত্রের অনেক দুর্বলতা রয়েছে। গণতন্ত্র মানুষের তৈরি গতানুগতিক একটি পদ্ধতি, এবং এটি আদৌ নিখুঁত নয়। বহুদলীয় ব্যবস্থায় গণতন্ত্র কখনও পুরোপুরি সফল নয়। যখন দুটি দল একে অন্যের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তখন যে কোনো একটি জিততে পারে, আর কেবলমাত্র তখনোই একটি শক্তিশালী সরকার গঠন সম্ভব হয়। মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হলো অধিকাংশ ব্যক্তি নিজে নেতা হতে চায়, ফলে মানুষ অসংখ্য দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এতে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই কারণে অনেক ক্ষেত্রেই গণতন্ত্র ব্যর্থতায় বৃত্তে আটকে থাকে। গণতন্ত্রের আরো অনেক দুর্বলতা রয়েছে, যেমন এখানে অন্ধকার এবং আলোর মূল্য সমান। অর্থাৎ মূর্খ এবং জ্ঞানীর ভোটের মূল্য সমান। সবারই জানা আছে, আলো এবং অন্ধকার একই সময়ে, একই স্থানে থাকতে পারে না। তারা দুটি ভিন্ন অবস্থা, একটি অন্যটির অনুপস্থিতির কারণে ঘটে থাকে। ‘অন্ধ’ ও ‘চক্ষুষ্মান’ কি সমান হতে পারে? ঠিক যেমন সমান হতে পারেনা মূর্খ ও বিদ্বান। পারেনা কেন? ইল্মে বা জ্ঞানের কারনে। আল্লাহ তাআলাও পবিত্র কোরআনে স্পষ্টভাবে বলেছেন, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কিছুতেই বরাবর হতে পারে না। তাদের মধ্যে আলো ও অন্ধকার এবং জীবন ও মরণের মতোই পার্থক্য। কিন্তু গণতন্ত্রের দৃষ্টিতে সবাই সমান।
পশ্চিমা বিশ্ব পুরো পৃথিবীকে গণতন্ত্রের সবক দিলেও আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। এ যেন বাতির নিচে অন্ধকার। ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের ফলাফলকে ‘কারচুপি’ বলে অভিযোগ করেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেন। এর রেশ ধরে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ট্রাম্পের সমর্থকরা মার্কিন ক্যাপিটল হিলে হামলা চালায়। এই হামলার ঘটনাকে গণতন্ত্রের ওপর একটি বড় আঘাত হিসেবে দেখা হয়, যেখানে ট্রাম্প নিজেই বক্তব্যের মাধ্যমে এই দাঙ্গায় উসকানি দিয়েছেন।
বিগত বছরগুলিতে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দেয়া হয়নি। বিশ্বব্যাপী কয়েক প্রজন্ম গণতান্ত্রিক অধিকারের চর্চা ও প্রয়োগ ছাড়াই একটি ভীতিকর ও কতৃত্ববাদী পরিবেশে বেড়ে উঠেছে। বিশেষ করে, তরুণদের উজ্জল ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতকে নস্যাৎ করা হয়েছে। সবল ও শক্তিশালী গণতন্ত্র গড়ে তোলার জন্য বিশ্ব-কে এখনও অনেক দুর এগোতে হবে। কারণ এখনও বিশ্বের অধিকাংশ দেশে গণতন্ত্রের দুর্বলতা বিদ্যমান। এজন্যই তরুণ সমাজ এবং বিশেষ করে জেনজিদের হাত ধরেই দেশে দেশে বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হচ্ছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক এবং প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল।