ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সড়ক দুর্ঘটনা যেন মহামারি

মো. রায়হান হোসাইন
সড়ক দুর্ঘটনা যেন মহামারি

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই কলেজ শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, পুলিশ কর্মকর্তা নিহত। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চলাচলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণমাধ্যম হলো- সড়ক পথ। স্বাভাবিক চলাফেরায় দ্রততম সময়ে নিজ গন্তব্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সড়ক পথই আমাদের একমাত্র ভরসা। কেননা, নদীপথ কিংবা ট্রেনব্যবস্থা সব স্থানে পর্যাপ্ত নেই। ফলে প্রতিটি মহাসড়ক কিংবা সড়কে যাত্রী চাপ অত্যাধিক। এতে প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে যানবাহনের সংখ্যা। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা। প্রতিদিনই মৃত্যু মিছিলে যোগ হচ্ছে হাজারো নাম। আহত কিংবা গুরুতর আহতের আর্তনাদে ভারী হচ্ছে হাসপাতালের পরিবেশ। বিশেষ করে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা যেন মহামারি আকার ধারণ করেছে। অসংখ্য রিপোর্টে উঠে এসেছে সড়ক দুর্ঘটনার একটা বড় অংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এছাড়া বাস, ট্র্যাক, লরি কিংবা ব্যাটারিচালিত ছোট ছোট যানবাহনেও দুর্ঘটনার সংখ্যা কম নয়। অদক্ষ চালক, ওভারস্পিড, সড়ক আইন না মানা কিংবা একই সড়কে রিকশা, ভ্যান, লরিসহ সকল যানবাহন চলাচলও সড়ক দুর্ঘটনার কারণ। ফলে বর্তমান বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাকে মহামারির সাথে তুলনা করলেও ভুল হবে না। কেননা, এমন কোনো দিন নেই যে, সারাদেশের কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা হয় না।

এরই ধারাবাহিকতায় সেপ্টেম্বর-২০২৫ এর প্রথম সপ্তাহেই ঘটে গেছে মর্মান্তিক কিছু সড়ক দুর্ঘটনা। গত ২ সেপ্টম্বর বাগেরহাট সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজের প্রভাষক অবনী কুমার মন্ডল (৪১) জেলার ফকিরহাট এলাকায় মোটরসাইকেল সড়ক দুর্ঘটনার স্বীকার হন। ঢাকাগামি মালবাহী একটি ট্র্যাক শিক্ষক অবনীকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলে তার একটি পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমতাবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পথিমধ্যে তার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ঠিক একদিন পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ইফতেখারুল ইসলাম ফামিন (২২) নগরীর বিনোদপুর এলাকায় মোটরসাইকেল সড়ক দুর্ঘটনার স্বীকার হন। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ৫ সেপ্টেম্বর গাজীপুর জেলার পুলিশ লাইন্স এলাকায় নওগাঁ ডিবি পুলিশের ওসি মোস্তাফিজ হাসানকে (৫২) বাস চাপা দিলে হাসপাতালে নিলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এই ঘটনায় তার স্ত্রীরও গুরুত্বর আহত হন। এছাড়া গত ৬ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুরে বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খালে পড়লে ঘটনাস্থলেই ৫ জন নিহত হয়। গত আগস্ট-২০২৫ মাসেই ৪৯৭টি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে। এতে ৫০২ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া ১ হাজার ২৩২ জন আহত হয়েছেন। রিপোর্টের তথ্য মতে, এর মধ্যে ১৬৫টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ঘটনা। এতে নিহত হয়েছেন ১৭৬ জন এবং আহত হয়েছেন ১৪৪ জন। অন্যদিকে জুলাই মাসে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের রিপোর্ট অনুযায়ী সারাদেশে গত জুলাই মাসে ৪২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৮০ জন নিহত এবং ৫৪২ জন আহত হয়েছেন। বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ঘটনা আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। ওভারটেকিং, ওভারস্পিড, আইন অমান্য করে বাইক চালানো কিংবা সো অফ করার প্রবণতায় সড়ক দুর্ঘটনার কারণ। বিশেষ করে কিশোর যুবকদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি বেশি লক্ষ্য করা যায়। যার প্রমাণও মিলে পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ১৩ মাসের হিসেব দেখলে। তথ্য বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের ৩২ দশমিক ১৪ শতাংশই মোটরসাইকেল আরোহী। এক্ষেত্রে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ৫ বছরের তথ্যও বলছে, দুর্ঘটনার প্রাণহানির ৩৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ মোটরসাইকেলের আরোহী। এদিকে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ৫ বছরে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে- ৩০ হাজার ৭৭৩টি। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৩৩ হাজার ২৪৬ জন। আহত হয়েছেন আরও প্রায় ৫১ হাজার মানুষ। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে দিনকে দিন মহামারির আকার ধারণ করছে।

এই বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ বলছে, আগস্ট মাসে সড়ক দুর্ঘটনার উল্লেখ্যযোগ কারণের মধ্যে আছে, বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দেশের সড়কের মাঝে ছোট বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। যে গর্তের কারণে দুর্ঘটনা বেড়েছে। সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা, সিএনসি অটোরিকশা, নসিমন-করিমনের অবাধে চলাচল। জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন বা রোড মার্কিং, সড়কবাতি না থাকায় হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা সড়ক দুর্ঘটনার কারণ। এছাড়াও অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অতিরিক্ত যাত্রীবহন ইত্যাদিও সড়ক দুর্ঘটনার কারণ।

মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে নিরাপত্তাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা এমন পর্যায়ে দাড়িয়েছে যে সাধারণ জনগণ রাস্তায় বের হতেই ভয় পাচ্ছে। সার্বিক নিরাপত্তা দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চিত করলেও রাস্তার সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দিবে কে? একজন মানুষ বাড়ি থেকে বের হয়ে নিরাপদে বাসায় ফিরবে এর নিশ্চয়তা দিবে কে? ফলে এখন সময় এসেছে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার। রাস্ট্রকে সড়কে আইন প্রণয়ন করে বসে থাকলেই হবে না বরং কঠোরভাবে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বিশেষ করে কিশোর-যুবকদের মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা সম্পর্কে সচেতন করার ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রচরণা চালাতে হবে। সময়ের চেয়ে যে জীবনের মূল্য বেশি এই বিষয়টিকে আমাদের ধারণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সচেতনতার শিক্ষাটা শুরু হোক পরিবার থেকেই।

লেখক : শিক্ষক, লেখক ও কলামিস্ট প্রভাষক সরকারি শারীরিক শিক্ষা

কলেজ, বরিশাল।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত