ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পারিবারিক সম্পর্কগুলো আজ বিলুপ্তির পথে

এসএম রায়হান মিয়া
পারিবারিক সম্পর্কগুলো আজ বিলুপ্তির পথে

মানুষ সামাজিক প্রাণী- এই সত্যটি মানবসভ্যতার শুরু থেকে অটুট। পরিবার ছিল সেই সমাজের প্রথম ভিত্তি, যেখানে মানুষ জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে, ভালোবাসা শেখে, সহানুভূতি অর্জন করে এবং দায়িত্ববোধের শিক্ষা পায়। কিন্তু আধুনিক যুগের অগ্রগতি, প্রযুক্তির আসক্তি, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও নৈতিক অবক্ষয়ের সম্মিলিত প্রভাবে পরিবার নামক এই প্রাচীন প্রতিষ্ঠানটি আজ গভীর সংকটে। পারিবারিক সম্পর্কগুলো একসময়ে ছিল সমাজের শক্তি, আজ তা ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে। এই বিলুপ্তি শুধু একটি সামাজিক পরিবর্তন নয়, বরং এক ধরনের সভ্যতার সঙ্কেত- যেখানে মানুষ যত উন্নত হচ্ছে, তত একা হয়ে পড়ছে। আগে পরিবার মানেই ছিল এক প্রকার নিরাপত্তা ও মমতার দুর্গ। দিনের শেষে ক্লান্ত মানুষ জানত- বাড়ি ফিরে সে একটুখানি শান্তি পাবে, পাবে ভালোবাসার আশ্রয়। এখন সেই বাড়ি আছে, কিন্তু নেই তার প্রাণ। একই ছাদের নিচে বাবা-মা, সন্তান, ভাই-বোন- সবাই থাকলেও প্রত্যেকে যেন নিজ নিজ দুনিয়ায় বন্দি। একদিকে প্রযুক্তির দখল, অন্যদিকে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার প্রসার- মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে মানুষ থেকেই। আজ আমাদের যোগাযোগ আছে, কিন্তু সংযোগ নেই; কথাবার্তা আছে, কিন্তু বোঝাপড়া নেই; একত্রে থাকা আছে, কিন্তু একতার অনুভব নেই। পরিবারের ভাঙন শুরু হয়েছে যখন মানুষ ‘আমি’-কে ‘আমরা’-এর ওপর প্রাধান্য দিতে শুরু করল। ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে এক ধরনের স্বার্থপরতা ঢুকে গেছে সামাজিক জীবনে। আগের দিনে আত্মীয়তার বন্ধন ছিল অকৃত্রিম- কেউ অসুস্থ হলে সবাই ছুটে যেত, কেউ বিপদে পড়লে সাহায্যের হাত বাড়াত। এখন খবরটি জানা হয় হয়তো; কিন্তু সেই উদ্বেগ নেই, সেই মানবিকতা নেই। সম্পর্ক এখন আবেগের নয়, প্রয়োজনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও পারিবারিক অবক্ষয়ের গভীর প্রভাব দেখা যায়। জীবন এখন এক প্রতিযোগিতার দৌড়, যেখানে সবাই ব্যস্ত নিজের টিকে থাকার লড়াইয়ে। বাবা-মা দুজনেই কর্মজীবী- দিনের বড় অংশ কাটে অফিসে, সন্তান থাকে স্কুল-টিউশন-ইন্টারনেটে। পারিবারিক সময় এখন বিলাসিতা। একসময় পরিবারে একত্রে খাওয়া, গল্প করা, একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া- এগুলো ছিল প্রতিদিনের অভ্যাস। এখন সবাই এক ছাদের নিচে থেকেও মানসিকভাবে আলাদা জগতে বাস করে। এই মানসিক দূরত্বই ধীরে ধীরে সম্পর্কগুলোকে শুষে নিচ্ছে। মনোবিজ্ঞান বলে, পারিবারিক সম্পর্ক টিকে থাকে পারস্পরিক সময়, মনোযোগ ও আবেগীয় সংযোগের ওপর। এগুলো অনুপস্থিত হলে সম্পর্কের উষ্ণতা হারায়। আধুনিক প্রযুক্তি মানুষকে সময় বাঁচিয়েছে, কিন্তু সম্পর্ক থেকে কেড়ে নিয়েছে মনোযোগ। স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া, নেটফ্লিক্স- সবকিছু মিলে মানুষ এখন ভার্চুয়াল জগতে হারিয়ে গেছে। আগে সন্তানরা বাবা-মায়ের কাছে গল্প শুনে ঘুমাত, এখন তারা ইউটিউবে কার্টুন দেখে ঘুমায়। পরিবারে কথাবার্তা এখন হয়ে গেছে সীমিত, অনুভূতি প্রকাশও কমে গেছে।

বয়স্কদের অবস্থাও আজ করুণ। একসময় বৃদ্ধ বাবা-মা ছিলেন পরিবারের মর্যাদার কেন্দ্রবিন্দু, এখন তারা হয়ে গেছেন বোঝা। সন্তানরা ব্যস্ত নিজেদের জীবনে, কেউ সময় দেয় না, কেউ যত্ন নেয় না। অনেকে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হয়- মনে করে, অর্থ পাঠালেই দায়িত্ব শেষ। অথচ ভালোবাসা ও উপস্থিতির বিকল্প কোনো কিছুই নেই। এই মানসিক অবহেলাই পরিবারকে ধীরে ধীরে ভেঙে দিচ্ছে। সমাজে এখন বৃদ্ধাশ্রম বাড়ছে, কিন্তু মমতা কমছে। নারীর ভূমিকা পরিবর্তনও পারিবারিক কাঠামোয় নতুন রূপ এনেছে। আগে নারী পরিবারকেন্দ্রিক ছিল, এখন সে কর্মজীবী, স্বাধীন। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক পরিবর্তন, কিন্তু পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাবে তা কখনও কখনও পরিবারে সংঘাতের জন্ম দেয়।

স্বামী-স্ত্রী উভয়ই যখন ব্যস্ত থাকে, তখন পারিবারিক যোগাযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে। সন্তানরা বেড়ে ওঠে একাকিত্বে, যা তাদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারা শেখে না সম্পর্কের মূল্য, শেখে না সহমর্মিতা। ফলে পরবর্তী প্রজন্ম হয়ে উঠছে আবেগহীন ও স্বার্থকেন্দ্রিক- যা ভবিষ্যতের সমাজের জন্য ভয়াবহ সংকেত। পরিবারের অবক্ষয়ের পেছনে একটি বড় কারণ হলো নৈতিক মূল্যবোধের পতন। আগে পরিবার মানে ছিল সম্মান, দায়িত্ব, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা। এখন সেখানে জায়গা নিয়েছে ক্ষমতার লড়াই, অহংকার ও আত্মকেন্দ্রিকতা। ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের, স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর, সন্তানদের সঙ্গে পিতামাতার দূরত্ব- সবই বেড়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একদিকে মানুষকে প্রকাশের সুযোগ দিয়েছে, অন্যদিকে তুলনামূলক হীনমন্যতা ও প্রতিযোগিতা বাড়িয়েছে। মানুষ এখন সম্পর্ক নয়, স্ট্যাটাস ধরে রাখতে ব্যস্ত। বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলো তাই ভার্চুয়াল পরিচয়ের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সমাজতাত্ত্বিকভাবে পরিবার একটি সংকটময় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। সমাজবিজ্ঞানী এমিল দুর্খাইম বলেছিলেন, ‘মানুষ যখন সামাজিক বন্ধন হারায়, তখন সে নৈতিক দিক থেকেও পতনের পথে যায়।’ আজকের সমাজে সেই কথাই সত্য হচ্ছে। পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে আত্মহত্যা, মানসিক অবসাদ, মাদকাসক্তি, বিচ্ছিন্নতা ও সহিংসতা। পরিবার ছিল সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক কাঠামো- যেখানে নৈতিকতা শেখানো হতো। এখন সেই নিয়ন্ত্রণ দুর্বল, ফলে সমাজও হারাচ্ছে তার মানবিক রূপ। মনোবৈজ্ঞানিকভাবে দেখলে, সম্পর্ক টিকে থাকে তিনটি উপাদানে- সময়, অনুভূতি ও সংলাপ।

এগুলো অনুপস্থিত হলে সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। এখন মানুষ সময় দিতে চায় না, অনুভূতি প্রকাশে অস্বস্তি বোধ করে, আর সংলাপের জায়গা নিয়েছে নীরবতা। ফলে পারিবারিক সংকট থেকে জন্ম নিচ্ছে মানসিক অসুস্থতা। কেউ একা, কেউ বিষণ্ণ, কেউ শুধু ‘বেঁচে থাকা’র জন্য বেঁচে আছে। তবে সবকিছুই অন্ধকার নয়। পরিবারকে রক্ষা করা এখনও সম্ভব- যদি আমরা সচেতন হই, সময় দিই এবং একে অপরের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিই। প্রথমত, পারিবারিক সময়কে পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রতিদিন অন্তত একবার পরিবারের সবাইকে একসঙ্গে বসে খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তির সীমা নির্ধারণ করা দরকার। সন্তানের সঙ্গে মোবাইল নয়, চোখে চোখে কথা বলা প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, বয়স্কদের যত্ন নেওয়া শুধু দায়িত্ব নয়, এটি মানবিক কর্তব্য। তারা আমাদের অতীত, তাদের অভিজ্ঞতাই ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা।

চতুর্থত, শিক্ষাব্যবস্থায় পারিবারিক মূল্যবোধ শেখানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। শিশুদের শেখাতে হবে সহমর্মিতা, শ্রদ্ধা, দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসার শক্তি। পরিবারকে শুধু সামাজিক প্রতিষ্ঠান নয়, এক ধরনের নৈতিক বিদ্যালয় হিসেবে দেখতে হবে।

পঞ্চমত, গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকের নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনগুলো পরিবার ভাঙনের চিত্র তুলে ধরে; কিন্তু পরিবার টিকিয়ে রাখার গল্প তুলে ধরার মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। একই সঙ্গে, রাষ্ট্রীয় নীতিতেও পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব থাকতে হবে। উন্নয়ন মানে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়- মানুষের মানসিক ও সামাজিক সুস্থতাও উন্নয়নের অংশ। তাই পরিবারবান্ধব নীতি, কর্মজীবী নারী ও পুরুষের জন্য নমনীয় সময়, শিশু যত্নকেন্দ্রের উন্নয়ন- এসবই পারিবারিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় ভূমিকা রাখবে। সবশেষে, আমাদের প্রত্যেককেই মনে রাখতে হবে- পরিবার হারালে সমাজ টিকবে না। সমাজ হারালে সভ্যতাও টিকবে না। পরিবার শুধু রক্তের বন্ধন নয়, এটি হলো ভালোবাসার চুক্তি, সহানুভূতির অঙ্গীকার এবং একে অপরের জীবনে উপস্থিত থাকার প্রতিশ্রুতি। আজ আমরা যেভাবে সম্পর্কগুলোকে অবহেলা করছি, তাতে একদিন হয়তো দেখা যাবে- আমরা উন্নত প্রযুক্তির মানুষ হয়েছি; কিন্তু আবেগের দিক থেকে আদিম যুগে ফিরে গেয়েছি।

পরিবার হলো- সেই শিকড়, যেখান থেকে মানবিকতার বৃক্ষ জন্ম নেয়। শিকড় কেটে গাছ টেকে না। তাই যত আধুনিকই হই না কেন, পরিবারকে ফিরিয়ে আনতেই হবে জীবনের কেন্দ্রে।

ভালোবাসা, সময় ও শ্রদ্ধাই পারে পরিবারকে রক্ষা করতে। যখন আমরা আবার একে অপরের চোখে চোখ রেখে হাসতে শিখব, বাবা-মায়ের হাতে হাত রাখব, ভাই-বোনের পাশে দাঁড়াব, তখনই সমাজে ফিরে আসবে, সেই হারানো উষ্ণতা।

পারিবারিক সম্পর্ক বিলুপ্তির পথে- এটা এক ভয়াবহ সংকেত। কিন্তু এখনও সময় আছে। যদি এখনই আমরা পরিবারকে প্রাধান্য দিই, ভালোবাসাকে মূল্য দিই, সম্পর্ককে সময় দিই- তাহলে হয়তো একদিন আমাদের সন্তানরা বলবে, ‘আমার পরিবারই আমার শক্তি।’ আর সেই দিনই হবে মানবসভ্যতার প্রকৃত পুনর্জন্মের দিন।

এসএম রায়হান মিয়া

সিনিয়র শিক্ষক ও কলামিস্ট, গাইবান্ধা সদও, গাইবান্ধা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত