ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইন্দো-প্যাসিফিক রাজনীতি ও বাংলাদেশের সমুদ্রকৌশল

মারিয়া হক শৈলী
ইন্দো-প্যাসিফিক রাজনীতি ও বাংলাদেশের সমুদ্রকৌশল

ভূখণ্ডের প্রাচীন যুদ্ধ পেছনে ফেলেছে মানবসভ্যতা; ভবিষ্যতের প্রতিযোগিতা এখন নেমে এসেছে সমুদ্রের নীল গভীরে। সীমান্তের দেয়াল টপকে যে দেশ সমুদ্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, ভবিষ্যৎ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্যও গঠিত হবে তার হাতেই। পৃথিবীর প্রায় সত্তর শতাংশ জুড়ে বিস্তৃত এই সমুদ্র আজ আর শুধু পরিবেশ বা পরিবহন নয়- এটি অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। আর এই সমুদ্রকেন্দ্রিক শক্তি-রাজনীতির নতুন নামই হলো ‘ইন্দো-প্যাসিফিক রাজনীতি’- যেখানে ঢেউয়ের সঙ্গে লড়ছে স্বার্থ, আর প্রতিটি স্রোত বয়ে আনছে নতুন কৌশল ও প্রতিযোগিতা।

প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই বিশাল অঞ্চল এখন কেবল বাণিজ্যের কেন্দ্র নয়, শক্তি ভারসাম্যেরও পরীক্ষাগার। এ অঞ্চলটি পৃথিবীর সবচেয়ে গতিশীল অর্থনৈতিক এলাকা, যেখানে বিশ্বের প্রায় ৬০ শতাংশ জিডিপি উৎপাদিত হয় এবং ৫০ শতাংশ বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিচালিত হয়। দুই মহাসাগরের এই সংযোগই এখন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার নতুন ক্ষেত্র। চীন তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে সামুদ্রিক প্রভাব বাড়াতে চায়, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন কোয়াড ও জোট ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব রোধে বদ্ধপরিকর। আর এই ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রেই আলোচনায় এসেছে ব্লু ইকোনমি ধারণা- অর্থাৎ, সমুদ্রসম্পদকে টেকসইভাবে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণ।

জাতিসংঘের ভাষায়, ব্লু ইকোনমি হলো ‘সমুদ্র ও উপকূলের সম্পদকে এমনভাবে ব্যবহার করা যাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান এবং পরিবেশের ভারসাম্য একসঙ্গে বজায় থাকে।’ বাংলাদেশের জন্য এই ধারণা ভবিষ্যত সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। ২০১২ ও ২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা বিরোধ মীমাংসার পর আমরা পেয়েছি প্রায় ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার সামুদ্রিক এলাকা যা ব্লু ইকোনমির বিশাল সুযোগ তৈরি করেছে। অর্থ্যাৎ, জলের এক নতুন ভূখণ্ড- যেখানে নিজস্ব সমুদ্রসীমার বাইরে মহীসোপানের এক বিরাট এলাকার উপর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই এলাকার মৎস্য ও সমুদ্রের তল দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই নীল ভূখণ্ডকে আমরা কতটা জানি? কতটা পারি একে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে? বঙ্গোপসাগর একসময় ছিল নিছক বাণিজ্যপথ; কিন্তু ইন্দো-প্যাসিফিক রাজনীতির স্রোতে এই সাগর এখন এক কৌশলগত গেটওয়ে। একদিকে চীন সমুদ্রপথে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব দিচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটিজিতে। আবার ভারত চাইছে, নিজেদের এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে।

ফলত, এই ত্রিমুখী প্রতিযোগিতার মাঝখানে বাংলাদেশকে পথ খুঁজতে হবে সতর্ক কুটনৈতিক কৌশলের মধ্য দিয়ে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ নিজেদের প্রকাশিত ‘ইন্দো প্যাসিফিক আউটলুক’ নীতিতে স্পষ্ট ভাবে বলেছে, আমাদের লক্ষ্য কোন জোট নয়। বরং উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ইন্দো প্যাসিফিক গঠন। এটিকে বাস্তববাদী অবস্থানই বলা যায়; কারণ সমুদ্র যেমন অর্থনীতির উৎস, তেমনি সংঘাতের ক্ষেত্রও। সমুদ্র জয় করার পর ব্লু ইকোনমি সেল গঠন করা হয়েছে। গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণের জন্য জাহাজ কেনার নীতিমালা সহজ করা হয়েছে এবং নতুন জাহাজ কেনা হচ্ছে। ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’-এও সমুদ্র অর্থনীতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ কর্তৃক প্রস্তাবিত বাজেটে ব্লু ইকোনমি ও গবেষণার জন্য ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে নীল অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে নানান উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও দুর্বল সামুদ্রিক অবকাঠামো, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং নীতিগত সমন্বয়ের অভাবে ব্লু ইকোনমি যৌক্তিক বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বেগ পেতে হচ্ছে।

মূলত, ব্লু ইকোনমির মূল দর্শনই হলো টেকসই উন্নয়ন অর্থ্যাৎ সমুদ্রকে ব্যবহার করতে হবে, কিন্তু শোষণ নয় পাশাপাশি উন্নয়নের বিনিময়ে ধ্বংস নয়। সেক্ষেত্রে এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন একটি সমন্বিত সামুদ্রিক নীতি (গধৎরহব চড়ষরপু), যেখানে স্পষ্টভাবে নির্ধারিত থাকবে- গবেষণার অগ্রাধিকার, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, পরিবেশ সুরক্ষার কৌশল এবং বেসরকারি বিনিয়োগের সুযোগ। একই সঙ্গে মেরিন বিশ্ববিদ্যালয়, কোস্ট গার্ড এবং সমুদ্র গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুধুমাত্র প্রশাসনিক সংস্থা হিসেবে নয়, বরং জাতীয় কৌশল নির্ধারণের অংশীদারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা জরুরি। কারণ, সমুদ্র অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শুধু সম্পদ আহরণের ওপর নয়, বরং আমরা কতটা জ্ঞাননির্ভর ও টেকসইভাবে সেই সম্পদ পরিচালনা করতে পারছি তার ওপর।

সর্বোপরি, সমুদ্র এখন শুধু নৌবাহিনীর বিষয় নয়- এটি অর্থনীতি, নিরাপত্তা, জলবায়ু ও কূটনীতির সংযোগস্থল। যে দেশ নীলের অর্থ বোঝে, ঢেউয়ের নীচের মানচিত্র বুঝে, সেই দেশই ভবিষ্যতের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে থাকে। বাংলাদেশও যদি বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর মতো জ্ঞান, কৌশল ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে ব্লু ইকোনমির সুযোগ নিতে পারে, তবে এই সাগর শুধু সম্পদের নয়, প্রতীক হয়ে উঠবে আত্মবিশ্বাসেরও।

মারিয়া হক শৈলী

শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত