প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৬ নভেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশের ঋতুচক্রের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ শীতকাল। ঋতুটি কারও ভীষণ পছন্দের ও কারও জন্য অভিশাপের। আবহাওয়ার পালাবদলে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশের তাপমাত্রা কমতে শুরু করে। বিশেষ করে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে, যেমন- পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, রাজশাহী-এই জেলাগুলোতে শীতের তীব্রতা অনুভূত হয় সর্বাধিক। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসজুড়ে এই তীব্রতা দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই বিরাজ করে। এই সময়ে, প্রকৃতির এমন রুক্ষতা যখন বিত্তশালীদের জন্য আনন্দের উপলক্ষ, তখন দেশের বিশাল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনে তা নেমে আসে এক কঠিন অভিশাপ হয়ে। শহরকেন্দ্রিক উন্নয়নের চাকচিক্যের আড়ালে চাপা পড়ে থাকা এই জীবনগুলো শীতের প্রতিটি পরতে অসহায়ত্বের এক করুণ চিত্র ফুটিয়ে তোলে। শীতকাল মানেই ঠান্ডাজনিত রোগের ব্যাপক বিস্তার। প্রান্তিক জনজীবনে এর প্রকোপ বহু গুণ বেশি। এই সময়ে সর্দি-কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কিওলাইটিস, সাইনোসাইটিস, অ্যাজমা, চর্মরোগ, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট এবং ডায়রিয়াসহ নানা জটিলতা বৃদ্ধি পায়। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে শিশুরা, এরপরই আসে বৃদ্ধ ও নারীরা।
চিকিৎসা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষজনের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়। সামান্য চিকিৎসা খরচ মেটানোর সামর্থ্য যাদের নেই, দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন জোগাড় করতেই যাদের দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, তাদের পক্ষে শীত থেকে বাঁচতে উন্নতমানের গরম পোশাক পরিধান করা কিংবা রোগের সঠিক চিকিৎসা করানো প্রায় অসম্ভব। অভাবের তাড়নায় বহু বাবা-মা তাদের শিশুদের জন্য ন্যূনতম শীতবস্ত্রের যোগান দিতে পারেন না।
ফলে শিশুরা সহজেই ঠান্ডার শিকার হয় এবং মারাত্মক রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে সামান্য চিকিৎসা জুটলেও, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে এখনও উন্নত চিকিৎসা সেবার ঘাটতি প্রকট। স্বাস্থ্যকর্মীর স্বল্পতা, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব এবং মানসম্পন্ন ওষুধের অপ্রতুলতা গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার প্রধান অন্তরায়। সরকারি হাসপাতালগুলোর বাইরে গিয়ে বেসরকারি বা মানসম্মত চিকিৎসা নেওয়া তাদের সাধ্যের বাইরে। ফলে, অনেক অভিভাবক বাধ্য হয়ে মানহীন বা হাতুড়ে চিকিৎসার দ্বারস্থ হন, যা পরিস্থিতিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। শিশুদের পাশাপাশি বৃদ্ধদের অবস্থাও শোচনীয়। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত বয়োজ্যেষ্ঠরা ঠান্ডাজনিত নানান জটিলতায় ভুগতে থাকেন। যে সমাজে নবপ্রস্ফুটিত শিশুরাই ভালো চিকিৎসা পায় না, সেখানে বয়স্করা পর্যাপ্ত সে কিভাবে পাবেন? দুঃখজনক হলেও সত্য, শীতকালে প্রান্তিক জনপদে বৃদ্ধদের মৃত্যুর হারও বেড়ে যায়, যা রাষ্ট্রের দুর্বল স্বাস্থ্য কাঠামোর একটি মর্মান্তিক প্রতিফলন।
শীতের তীব্রতা প্রান্তিক জনজীবনের দৈনন্দিন সংগ্রামকে আরও কঠিন করে তোলে এবং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে আরও নড়বড়ে করে দেয়। কুয়াশার চাদরে যখন চারিদিক ঢাকা, তখনও জীবিকার টানে মানুষগুলো বেরিয়ে পড়ে। খেটে খাওয়া শ্রমিকেরা খুব ভোরে হালকা আগুনের উষ্ণতা শরীরে মেখে রওনা হন কাজের উদ্দেশ্যে। কৃষক ভোর না হতেই চলে যান জমিতে, হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় কাজ করেন ফসলের মাঠে। শীতকালে কুয়াশা ও ঠান্ডার কারণে অনেক কাজের গতি কমে আসে। বিশেষ করে নির্মাণ কাজ, পরিবহন, কিংবা দিনমজুরের কাজ ব্যাহত হয়। আবার কৃষিকাজেও আসে কিছুটা স্থবিরতা। ফলে, এই সময়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আয়ে দেখা দেয় বড় ধরনের ঘাটতি। দৈনিক আয়ের উপর নির্ভরশীল এই মানুষগুলোর জন্য আয় কমে যাওয়া মানে খাদ্য এবং চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণে আরও বেশি সংগ্রাম করা। পল্লী অঞ্চলের নারীদের জীবন আরও কঠিন। কনকনে ঠান্ডায় ভোরবেলা উঠে তাদের রান্নার কাজ সারতে হয়। সবচেয়ে করুণ চিত্র হলো খাদ্যাভ্যাসে। খুব সকালে রান্না করা খাবার রাতে খাওয়া হয়। কিন্তু দুপুরে রান্না করা খাবার রাতে ঠান্ডা জমে ‘ক্ষীর’ হয়ে থাকে। এই ঠান্ডা খাবার খেয়েই তাদের দিন কাটাতে হয়। ন্যূনতম তাপমাত্রার খাবার খাওয়ার কারণেও তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। শ্রমিক, কৃষক, এবং খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষরা শীতের তীব্রতাকে উপেক্ষা করে জীবন-জীবিকার সংগ্রামে লিপ্ত থাকে। যেটি তাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। শীতকালে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কষ্ট লাঘবের জন্য সরকারি উদ্যোগে শীতবস্ত্র (কম্বল) এবং ক্ষেত্রবিশেষে নগদ অর্থ বা খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই কার্যক্রম পরিচালিত হলেও, বাস্তবে এর সফলতা নিয়ে নানান প্রশ্ন ওঠে।
প্রথমত, ত্রাণের অপ্রতুলতা ও বিতরণে সমন্বয়হীনতা একটি বড় সমস্যা। শীতের প্রকোপ শুরু হলেও অনেক সময় কম্বল কেনার প্রক্রিয়া শুরু হতে দেরি হয়, বা নিম্নমানের কম্বল বিতরণের অভিযোগ ওঠে। ফলে সরকারি কম্বল পেয়েও অনেকের শীত নিবারণ হয় না।
দ্বিতীয়ত, বিতরণের ক্ষেত্রে প্রকৃত দুস্থদের তালিকা তৈরি এবং তা বিতরণের প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই স্বচ্ছল বা অপেক্ষাকৃত প্রভাবশালীরা সুবিধা পেয়ে যান, আর সত্যিকারের শীতার্তরা বঞ্চিত হন। অনেক সময় ত্রাণকে একটি ‘দাতব্য’ কাজ হিসেবে দেখা হয়, যা মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার চেয়ে বেশি কিছু নয়। সরকারি উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু এটি যেন দায়সারা কার্যক্রমে পরিণত না হয়, সেদিকে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। ত্রাণকে অবশ্যই সমাজের শেষ প্রান্তে থাকা মানুষটির কাছে দ্রুত এবং মানসম্পন্নভাবে পৌঁছানোর ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে করতে হবে। শীতকাল যেন প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রের বৈষম্যের চিত্রকে আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরে। সব উন্নয়ন যখন শহরকেন্দ্রিক, তখন এমন ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার হওয়া প্রান্তিক মানুষজন ভাগ্য নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হয়। নগরায়ণের এই তীব্র স্রোতে অবহেলিতদের পাঁচটি মৌলিক অধিকার (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা) প্রায়শই চাপা পড়ে যায়। ধনীরা তাদের ষোলো আনা বুঝে নিলেও গরিবরা প্রায়শই চার আনাও পায় না। আজ আমাদের এই চিরাচরিত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে যে, শহরে দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো নির্মাণ করাই একমাত্র উন্নয়ন।
উন্নয়নের মাপকাঠি হতে হবে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ ও তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন। শহর ও গ্রামের মাঝে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণ অত্যন্ত জরুরি। রাষ্ট্রকে এখনই এই অবহেলিত মানুষের মৌলিক অধিকার নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক, সরঞ্জাম এবং ওষুধের জোগান নিশ্চিত করা। শীতজনিত রোগ মোকাবিলায় বিশেষ স্বাস্থ্য ক্যাম্পেইন পরিচালনা করতে হবে। প্রয়োজনীয় অপেক্ষাকৃত বেশি দরের ঔষুধ সরবরাহ করতে হবে শিশুদের জন্য। ত্রাণ বিতরণে স্বচ্ছতা প্রয়োজন। কম্বল ক্রয়ের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা এবং বিতরণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। সমাজের বিত্তশালীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রান্তিক মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে কাজ করতো হবে।
যদি দ্রুত এই বৈষম্য নিরসন করা না যায়, তবে প্রতি বছরই আমরা শীতকালে এমন করুণ দৃশ্য দেখতে পাব, যা কেবল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের চিত্র নয়, বরং রাষ্ট্রের পরিকল্পনার অভাব ও বৈষম্যমূলক নীতির ফল। টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের জন্য পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সুনির্দিষ্ট সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি। শুধুমাত্র তখনই উন্নয়নের আলো দেশের প্রতিটি কোণে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়বে যখন প্রান্তিক মানুষের দুঃখ কমে আসতে শুরু করবে। রাষ্ট্র ও সমাজের বৃহত্তর অংশের উচিত এই প্রান্তিক মানুষের প্রতি আরও সংবেদনশীল হওয়া। শুধু মানবিক আবেদন নয়, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেই রাষ্ট্রের উচিত এই বৈষম্য দ্রুত দূর করা।
সুমাইয়া সিরাজ সিমি
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়