ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী তালগাছ

হেনা শিকদার
কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী তালগাছ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কালজয়ী কবিতা, ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে’- এই লাইনটি শোনামাত্রই আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে গ্রামীণ বাংলার এক চিরচেনা দৃশ্য। তালগাছ কেবল একটি উদ্ভিদ নয়, এটি আবহমান বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু কালের বিবর্তনে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় আর আমাদের উদাসীনতায় আজ সেই ঐতিহ্যবাহী তালগাছ শ্যামল বাংলা থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।

একসময় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে, বিশেষ করে মেঠো পথের ধারে, পুকুরপাড়ে বা ফসলের জমির আইলে সারি সারি তালগাছ দেখা যেত। এই গাছ শুধু গ্রামের সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করতো না, বরং এটি ছিল গ্রামীণ জীবনের এক নির্ভরযোগ্য বন্ধু।

তালগাছ আমাদের লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় তালগাছ এসেছে নানা উপমায়। তালের পাতার পাখা (হাতপাখা) গরমে প্রশান্তি এনে দিত, যা আমাদের লোকশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। তালের পাতায় লেখা হতো প্রাচীন পুঁথি। ভাদ্র মাসের ‘তাল পিঠা’ ছাড়া বাঙালির উৎসব অসম্পূর্ণ থেকে যেত। পাকা তালের মো মো গন্ধ, তালের রস, তালমিছরি, তালের গুড় এ সবকিছুই আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্যের অংশ।

তালগাছ একসময় গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একটি পূর্ণবয়স্ক তালগাছ থেকে যে কাঠ পাওয়া যায়, তা অত্যন্ত শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী। ঘরের খুঁটি, আড়া বা নৌকা তৈরিতে তালকাঠের জুড়ি মেলা ভার। এর পাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি, পাটি ও বিভিন্ন হস্তশিল্প তৈরি হয়। তালগাছকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ পর্যায়ে ‘গাছি’ নামক এক বিশেষ পেশাজীবী সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছিল, যারা গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় ও মিছরি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আজ তালগাছ কমে যাওয়ায় সেই পেশাও বিলুপ্তির পথে।

তালগাছের পরিবেশগত গুরুত্ব অপরিসীম। তালগাছের শিকড় মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত প্রবেশ করে মাটির ক্ষয় রোধ করে, যা নদীভাঙন ও ভূমিধস প্রবণ এলাকায় অত্যন্ত কার্যকর। এর সবচেয়ে বড় পরিবেশগত অবদান হলো এটি ‘প্রাকৃতিক বজ্রপাত নিরোধক’ (Natural Lightning Conductor) হিসেবে কাজ করে। তালগাছের উচ্চতা এবং এর গঠনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি বজ্রপাতকে আকর্ষণ করে মাটিতে নামিয়ে দেয়, ফলে আশপাশের মানুষ ও গবাদিপশুর জীবন রক্ষা পায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম একটি কারণ হিসেবে তালগাছের সংখ্যা কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এছাড়া, তালগাছ ঝড়ের সময় বাতাসের গতিবেগ কমিয়ে প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে। এটি বাবুই পাখির মতো অনেক পাখির নিরাপদ আশ্রয়স্থল।

এই বহুমুখী উপকারী গাছটি আজ বিপন্ন কেন? এর পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ :

ধীর বর্ধনশীলতা : তালগাছ অত্যন্ত ধীর গতিতে বাড়ে। একটি গাছে ফল আসতে বা পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে ৩০-৪০ বছর সময় লাগে। এই দীর্ঘসূত্রিতার কারণে মানুষ নতুন করে তালগাছ রোপণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

ইটভাটার আগ্রাসন : তালগাছের কাণ্ড অত্যন্ত শক্ত হওয়ায় এবং পোড়ালে উচ্চ তাপ উৎপন্ন হওয়ায় ইটভাটাগুলোতে জ্বালানি হিসেবে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা অর্থের লোভে নির্বিচারে বয়স্ক তালগাছ কেটে ইটভাটায় বিক্রি করে দিচ্ছে।

দ্রুত লাভজনক গাছের চাষ : মানুষ এখন দ্রুত বর্ধনশীল এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক যেমন- ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি বা মেহগনি গাছের দিকে ঝুঁকছে।

নতুন প্রজন্মের অনাগ্রহ : তালগাছ থেকে রস সংগ্রহ বা তাল পিঠা তৈরির মতো ঐতিহ্যবাহী কাজে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ কম। ‘গাছি’ পেশা এখন আর কেউ বেছে নিতে চায় না।

জনসচেতনতার অভাব : তালগাছের পরিবেশগত গুরুত্ব, বিশেষ করে বজ্রপাত নিরোধক হিসেবে এর ভূমিকার কথা অনেকেই জানেন না বা জানলেও গুরুত্ব দেন না।

তালগাছ হারিয়ে যাওয়ার ফলে আমরা শুধু আমাদের ঐতিহ্যকেই হারাচ্ছি না, পরিবেশকেও ঠেলে দিচ্ছি মারাত্মক ঝুঁকির মুখে। বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি, মাটির ক্ষয়, পাখির আশ্রয়স্থল ধ্বংস হওয়া এবং গ্রামীণ জীববৈচিত্র্য নষ্ট হওয়া এ সবই তালগাছ বিলুপ্তির প্রত্যক্ষ কুফল।

সময় এসেছে এই ঐতিহ্যবাহী গাছটিকে রক্ষা করার। সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায় থেকেই সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। কার্যকরী পদক্ষেপগুলো হতে পারে-

সামাজিক বনায়ন : সরকারি উদ্যোগে রাস্তার ধারে, খাসজমিতে, বাঁধের ওপর এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে পরিকল্পিতভাবে তালগাছ রোপণ করতে হবে।

আইনগত পদক্ষেপ : বিনা অনুমতিতে, বিশেষ করে ইটভাটার জ্বালানির জন্য তালগাছ কাটা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে এবং আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

জনসচেতনতা : গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে তালগাছের পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব, বিশেষ করে বজ্রপাত রোধে এর ভূমিকা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।

প্রণোদনা : যারা তালগাছ রোপণ ও পরিচর্যা করবেন, তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তালগাছ শুধু একটি গাছ নয়, এটি আমাদের শেকড়ের গল্প, আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক। একে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। আজ যদি আমরা একটি তালের আঁটি রোপণ করি, তা হয়তো আমাদের জীবদ্দশায় ফল দেবে না, কিন্তু এটি আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ এবং একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রেখে যাবে। তা না হলে, রবি ঠাকুরের কবিতার সেই তালগাছ একদিন শুধু কবিতার পাতাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে, বাস্তবে তার দেখা মেলা ভার হবে।

হেনা শিকদার

দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত