প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৭ নভেম্বর, ২০২৫
শুক্কুর চাচার ছোট্ট গ্রামখানি শীত এলেই ঝলমল করে উঠত। কারণ ওই সময়েই তাদের গ্রামের প্রশস্ত বিলে ভিড় জমাতো হাজার হাজার অতিথি পাখি। এই পাখিরা আসত সুদূর সাইবেরিয়া থেকে, তীব্র ঠান্ডা থেকে বাঁচতে। শুক্কুর চাচার কাছে এই পাখিরা শুধু পাখি ছিল না, তারা ছিল শীতের বন্ধু, তার একাকিত্বের সঙ্গী। প্রতি বছর শীতের প্রথম কুয়াশা নামলেই শুক্কুর চাচা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। পাখিদের কলকাকলিতে বিলপাড় যেন প্রাণ ফিরে পেত। চাচা প্রতিদিন ভোরে তার পুরনো চাদর গায়ে জড়িয়ে বিলের ধারে গিয়ে বসতেন। তিনি পাখিদের দেখতেন, তাদের খুনসুটি উপভোগ করতেন, আর আপন মনে তাদের সাথে কথা বলতেন। তিনি তাদের নাম দিয়েছিলেন- লালমাথা, নীললেজ, ঝুমুর, টুনটুনি আরও কত কি! কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম বড়ই কঠিন। শীত ফুরোলেই পাখিরা আবার নিজেদের দেশে ফিরে যেত। এই বিদায়বেলাটা শুক্কুর চাচার জন্য খুব কষ্টের ছিল। তার মনে হত, তার নিজের সন্তানরা বুঝি তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। একবার পাখিরা ফিরে যাওয়ার পর শুক্কুর চাচার শরীর খুব খারাপ হল। ডাক্তার বললেন, বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা। চাচা বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু বিলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন আর ফিসফিস করে বলতেন, ‘তারা কি আর আসবে না?’ পরের শীতে, যখন গ্রামবাসী আবার পাখিদের কলরব শুনল, তখন তারা দেখল শুক্কুর চাচা আর নেই। কিন্তু গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করত, পাখিরা ঠিকই তাদের বন্ধু শুক্কুর চাচার কাছে ফিরে এসেছিল। তাদের কিচিরমিচির শব্দে মিশে ছিল যেন এক গভীর বিষাদ। অতিথি পাখিদের এই আসা-যাওয়া প্রকৃতির এক চক্র, যা মানুষের জীবনেও গভীর ছাপ ফেলে যায়- ভালোবাসা এবং বিচ্ছেদের এক চিরন্তন গল্প।
অতিথি পাখি বা পরিযায়ী পাখি (Migratory bird) হলো- সেইসব পাখি, যারা বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে খাদ্যের সন্ধানে বা প্রতিকূল আবহাওয়া এড়াতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে অনেক দূর ভ্রমণ করে। সাধারণত শীতকালে যখন শীতপ্রধান দেশগুলোতে তীব্র ঠান্ডা পড়ে এবং খাদ্যের অভাব দেখা দেয়, তখন এই পাখিরা উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে, যেমন বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে চলে আসে। শীতের শেষে অনুকূল পরিবেশ ফিরে এলে তারা আবার নিজ দেশে ফিরে যায়।
অতিথি পাখিরা মূলত নিম্নলিখিত অঞ্চল এবং দেশগুলো ও অঞ্চলগুলো হতে বাংলাদেশে আসে : রাশিয়া (বিশেষ করে সাইবেরিয়া অঞ্চল)। উত্তর মেরু অঞ্চল- ইউরোপ, মঙ্গোলিয়া, হিমালয় পর্বত ও তিব্বত অঞ্চল (হিমালয়ের পাদদেশসহ), চীন, নেপাল, ভারত (আসাম ও অরুণাচল প্রদেশ)।
পৃথিবীতে পাখির প্রজাতির সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় সামান্য ভিন্নমত থাকলেও, সাধারণভাবে ১১,০০০-এরও বেশি প্রজাতির পাখি রয়েছে বলে মনে করা হয়। বেশিরভাগ সংস্থা, যেমন বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল এবং ইন্টারন্যাশনাল অর্নিথোলজিস্টস ইউনিয়ন, প্রায় ১১,০০০ বা তার বেশি প্রজাতির সংখ্যা উল্লেখ করে। কিছু পুরোনো হিসাবে এই সংখ্যাটি প্রায় ৯,৭০০ থেকে ১০,০০০-এর মধ্যে বলা হতো। প্রজাতি শনাক্তকরণের পদ্ধতি এবং নতুন প্রজাতির আবিষ্কারের কারণে এই সংখ্যাটি প্রতিনিয়ত সামান্য পরিবর্তিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি গবেষণায় পাখির শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে এই সংখ্যা প্রায় ২০,০০০ হতে পারে বলেও অনুমান করা হয়েছে। সুতরাং, সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে বর্তমানে ১১,০০০-এর বেশি স্বতন্ত্র প্রজাতির পাখি বিদ্যমান। কেবল অতিথি পাখি নয়, সকল পাখির প্রতি মানুষের আবেগ মানব সৃষ্টির সুচনা লগ্ন হতে অদ্যাবধি চলমান রয়েছে। পাখির প্রতি মানুষের ভালোবাসা প্রকাশের ধরন ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কেউ হয়তো খাঁচায় পুষে ভালোবাসেন, আবার কেউ পাখির ছবি তুলে, বা কেউ কেবল প্রকৃতির মাঝে উড়ে বেড়ানো পাখিদের দেখে শান্তি খুঁজে পান। এ পর্যায়ে পাখিদের সৌন্দর্যে ঘেরা আবেগপূর্ণ গল্পটি পড়া যাক-
রায়হান ছোটবেলা থেকেই পাখির প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভব করত। তার ঘরের জানালা দিয়ে তাকালেই দেখা যেত একটা বিশাল আম গাছ, যেখানে প্রতিদিন নানা রঙের পাখির মেলা বসত। টিয়া, শালিক, বুলবুলি, দোয়েল- সবার কলকাকলিতে তার সকাল শুরু হতো। রায়হানের কাছে এই পাখিরা শুধু জীবন্ত প্রাণী ছিল না, তারা ছিল স্বাধীনতার প্রতীক, সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি।
রায়হানের বাবা একজন সাধারণ কৃষক ছিলেন, সংসারের অভাব অনটন লেগেই থাকত। তাই চাইলেও ছেলেকে দামি খেলনা বা অন্য কিছু কিনে দিতে পারতেন না। কিন্তু রায়হান তাতে দুঃখ পেত না, তার সব আনন্দ ছিল ওই পাখিদের নিয়েই। সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জানালার কাছে বসে পাখিদের উড়ে বেড়ানো দেখত, আর মনে মনে তাদের সঙ্গে কথা বলত।
একদিন বিকেলে হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া শুরু হলো। গাছের ডালপালা ভেঙে পড়তে লাগল। ঝড় থামার পর শাওন ছুটে আম গাছের নিচে গেল। সেখানে সে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। একটা ছোট টিয়া পাখি ডাল থেকে পড়ে মাটিতে ছটফট করছে। তার একটা পা ভেঙে গিয়েছিল। রায়হানের মনটা কেঁদে উঠল। সে পরম মমতায় পাখিটিকে কুড়িয়ে ঘরে নিয়ে এল।
রায়হানের মা প্রথমে আপত্তি করলেন, ‘বাবা, আমাদের নিজেদেরই দু’বেলা ঠিকমতো জোটে না, তার ওপর এই পাখির ঝামেলা!’ কিন্তু রায়হানের মুখের আকুতি দেখে তিনি আর কিছু বললেন না। রায়হান তার নিজের ছোট্ট মাটির ব্যাংক ভেঙে কিছু টাকা বের করল এবং তা দিয়ে পাখিটির জন্য খাবার আর ওষুধ কিনে আনল।
দিনরাত রায়হানের সেবাযত্নে পাখিটি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল। রায়হান তার নাম রাখল জুলিয়া। জুলিয়া এখন আর উড়তে পারত না; কিন্তু সে রায়হানের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। রায়হান যখন পড়তে বসত, জুলিয়া তার কাঁধে এসে বসত। যখন খেলতে যেত, জুলিয়া তার পিছু পিছু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটত। তাদের বন্ধুত্ব দেখে সবাই অবাক হয়ে যেত।
রায়হানের জীবনে জুলিয়া এক নতুন রঙের ছোঁয়া এনেছিল। অভাবের তাড়নায় যখন তার মন খারাপ হতো, জুলিয়ার খুনসুটি আর পাশে থাকা তার মুখে হাসি ফোটাত। জুলিয়া যেন তাকে জীবনের কঠিন সময়েও সুন্দর কিছু খুঁজে বের করার প্রেরণা জোগাত।
কয়েক বছর কেটে গেল। রায়হান অনেক বড় হয়েছে। সংসারের দায়িত্ব এখন তার কাঁধে। সে শহরে গিয়ে ছোটখাটো একটা কাজ জুটিয়ে নিয়েছে। বাড়িতে ফেরার ফুরসত কম। একদিন বাড়ি ফিরে সে দেখল জুলিয়া খুব অসুস্থ। বয়সের ভারে জুলিয়ার শরীর ভেঙে পড়েছে। রায়হান বুঝতে পারল তার বন্ধু তাকে ছেড়ে চলে যাবে। সেই রাতে সে জুলিয়াকে নিজের বুকের কাছে আগলে রাখল। ভোরের আলো ফুটতেই জুলিয়া চিরদিনের জন্য চোখ বুজল। রায়হান অনেক কাঁদলো। জুলিয়া চলে গেলেও তার স্মৃতি রায়হানের মনে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গেল।
রায়হানের কাছে জুলিয়া ছিল সৌন্দর্যের প্রতীক, ভালোবাসার প্রতীক। রায়হান তাকে শিখিয়েছিল যে সত্যিকারের সৌন্দর্য শুধু বাহ্যিক রূপে নয়, বরং হৃদয়ের বন্ধনে, নিঃশর্ত ভালোবাসায় নিহিত। প্রতিবার যখন সে কোনো মুক্ত বিহঙ্গকে নীল আকাশে উড়তে দেখে, তার জুলিয়ার কথা মনে পড়ে যায়। আর তখনই তার মনে এক আবেগঘন অনুভূতি জেগে ওঠে, যা তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে জীবন যতই কঠিন হোক না কেন, সৌন্দর্য আর ভালোবাসা সবসময় আমাদের পাশে থাকে।
পাখি নিধনের অনেক কুফল রয়েছে, কয়েকটি কুফল নিম্নে আলোকপাত করা হলো : পাখি পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের সংখ্যা কমে গেলে প্রকৃতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পাখিরা ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফসলের সুরক্ষা দেয়। পাখি নিধনের ফলে পোকার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, যা কৃষিকাজের জন্য ক্ষতিকর। অতিথি পাখিরা আমাদের পরিবেশের সৌন্দর্য বাড়ায়। তাদের অনুপস্থিতিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়।
সৌন্দরে্য্র এক অনন্য প্রতীক পাখির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত- পাখি শিকার, পরিবহন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করার বিদ্যমান আইনগুলো কঠোরভাবে প্রয়োগ করা এবং আইন ভঙ্গকারীদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। অতিথি পাখিদের প্রধান বিচরণস্থল, যেমন হাওর-বাঁওড় ও অন্যান্য জলাশয়, দখল ও দূষণ থেকে রক্ষা করা এবং তাদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল তৈরি করা। শিকারি, পাখি বিক্রেতা এবং অবৈধভাবে পাখি আটকে রাখার বিরুদ্ধে প্রশাসনের মাধ্যমে নজরদারি জোরদার করতে হবে। স্কুল, গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিথি পাখির গুরুত্ব ও তাদের সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার চালানো। এয়ারগানসহ পাখি শিকারের অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা এবং পরিবেশ ও পাখি সুরক্ষায় কঠোর নীতি গ্রহণ করা। পাখির আবাসের জন্য গাছ কাটা বন্ধ করা এবং নতুন গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করা। বিষটোপ ও ফাঁদ পেতে শিকার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
এ নিবন্ধের ২টি গল্পের শুক্কুর চাচা এবং রায়হানের আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, বিশ্বস্ত, সৌন্দর্যের এবং আমার গল্পের পাখিকে দেশজুড়ে নিধনযজ্ঞ কেন? অতিথি পাখিরা শুধু খাবার ও আশ্রয়ের সন্ধানে আসে, তাই তাদের জীবনহানি করা অমানবিক। কোন সজ্জন ব্যক্তি অতিথির সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে পারে না। বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থেও অহেতুক পাখি হত্যাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। অতিথির সঙ্গে খারাপ আচরণ করা ছোটলোকি মানসিকতার পরিচায়ক হলে, অতিথি পাখিকে নিধন করা ব্যক্তি কেমন মন-মানসিকতা সম্পন্ন হতে পারে? এ প্রশ্নটি রেখে এ নিবন্ধের সমাপ্তি টানছি।
ড. মো. আনোয়ার হোসেন
প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক