ঢাকা মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গ্রিন ফাইন্যান্স : আশার আলো নাকি ঋণের জাল

মুহম্মদ গোলাম রাব্বি
গ্রিন ফাইন্যান্স : আশার আলো নাকি ঋণের জাল

জলবায়ু সংক্রান্ত সংকট যখন প্রতি বছর বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে আরও গভীরে ঠেলে দিচ্ছে। তখন ‘গ্রিন ফাইন্যান্স’ শুনলে মনে হয় এটা একটা রক্ষাকবচ। কিন্তু বাস্তবে? এটা কি সত্যিই আমাদের মুক্তির পথ, নাকি আরেকটা ফাঁদ যেখানে ঋণের চক্রে আটকে যাব আমরা? সাম্প্রতিক রিপোর্টগুলো দেখলে মনে হয়, এই ‘সবুজ’ নামের পিছনে লুকিয়ে আছে একটা বড় বাস্তবতাণ্ড যা আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য আরও কঠিন করে তুলছে।

২০১১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রিন ব্যাংকিং নীতিমালা চালু করার পরপরই ব্যাংকগুলো সোলার প্যানেল লাগাতে শুরু করে, কাগজ কম ব্যবহারের কথা বলে, এমনকি এসি কম চালানোরও প্রচার করে। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এসব তো শুধু সারফেস লেভেলের। আসল কাজ হচ্ছে পরিবেশ-বান্ধব প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার নামে। এই ঋণ যা অনেক সময় শুধু ব্যবসার মোড়ক। চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশ এখন হাই রিস্ক ক্যাটাগরিতে, আর ২০৩১ নাগাদ এটা ভেরি হাই রিস্ক হয়ে যাবে যদি এভাবে চলে। আর আমরা? বিশ্বের মোট কার্বন নির্গমনে আমাদের অবদান মাত্র ০.৫৬%। মানে, আমরা বিষ ছড়াইনি, কিন্তু তার ফল ভোগ করছি। এখন সেই মৃত্যু থেকে বাঁচতে হলে? ঋণ নিতে হচ্ছে।

২০০২ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত বাংলাদেশ জলবায়ু-সম্পর্কিত প্রকল্পে ঋণ নিয়েছে প্রায় ১২.৮ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু অনুদান পেয়েছে মাত্র ১.৪১ বিলিয়ন। ফলে, প্রতি এক ডলার অনুদানের জন্য আমরা তিন ডলারেরও বেশি ঋণ নিয়েছি। এটা যেন আপনার বাড়িতে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস এসে বলে, ‘নেভাতে পারি, কিন্তু পানির দাম সুদসহ দিতে হবে।’ আর আগুনটা? আপনার প্রতিবেশী ধরিয়েছে। এখন প্রতি বাঙালির মাথায় জলবায়ু-সম্পর্কিত ঋণের বোঝা প্রায় ৮০ ডলার যা প্রায় ৯,৫০০ টাকা। একটা চার সদস্যের পরিবারে হিসাবটা হয়ে যায় ৩৮,০০০ টাকা। এই টাকায় একজন গ্রামের কৃষক কতটা সার কিনতে পারতেন? একজন জেলে কয়টা জাল? কিন্তু না, এটা চলে যাচ্ছে ঋণ শোধে যা তারা নেননি, যে দূষণ তারা করেননি।

গ্রিন ফাইন্যান্সের আসল ফাঁদটা নামেই লুকিয়ে আছে। ‘সবুজ’ শুনলেই ভাবি ভালো কিছু, কিন্তু ভিতরে? বিশ্বব্যাপী জলবায়ু অর্থায়নের ৭২% আসে ঋণ হিসেবে। যেসব দেশ এরইমধ্যে দরিদ্র আর জলবায়ু-আক্রান্ত, তাদের উপর আরও বোঝা চাপানো হচ্ছে। ২০২৩ সালে ৫৫টা জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ ৪৭.১৭ বিলিয়ন ডলার শোধ করেছে ঋণের কিস্তিতে, কিন্তু সাহায্য পেয়েছে মাত্র ৩৩.৭৪ বিলিয়ন। আমাদের জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় ১১৩টা অগ্রাধিকার প্রকল্প আছে, যার জন্য ২০২৩-২০৫০ পর্যন্ত মোট ২৩০ বিলিয়ন ডলার লাগবে যা প্রতি বছর গড়ে ৮ বিলিয়ন। কিন্তু এ পর্যন্ত যা জোগাড় হয়েছে তা এর একটা অংশও না। আর একটা মাঝারি ঘূর্ণিঝড়েই আমাদের ক্ষতি হয় প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।

আরও খারাপ দিক হলো অস্বচ্ছতা। জাপান বাংলাদেশে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যেমন মাতারবাড়ি প্রকল্পকে ক্লাইমেট ফাইন্যান্স বলে গণ্য করেছে, কারণ এতে কম দূষণকারী প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছে। হ্যাঁ, কয়লা! যা পরিবেশ নষ্ট করে, সেটাকে পরিবেশ রক্ষার টাকা বলা হচ্ছে। আমেরিকা হাইতিতে ম্যারিয়ট হোটেলকে ২৬.৫ মিলিয়ন ডলার ফান্ডিং দিয়ে জলবায়ু প্রকল্প বলে অর্থায়ন করেছে। বিশ্বব্যাংক নিজেই স্বীকার করেছে, ২০১৭-২০২৩ অর্থবছরে তাদের ১০৪ বিলিয়ন ডলার ক্লাইমেট স্পেন্ডিং এর মধ্যে প্রায় ৪১ বিলিয়নের হিসাব তারা ঠিকমতো ট্র্যাক করতে পারেনি।

মুহম্মদ গোলাম রাব্বি

শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত