প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২১ নভেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক দেশ, যেখানে দেশের বড় একটি অংশ সরাসরি কৃষির ওপর নির্ভরশীল। দেশের অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা, গ্রামীণ জীবন, কর্মসংস্থান- সব ক্ষেত্রেই কৃষি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ধান, গম, ডাল, সবজি, পাট, আখ, ফলসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষি শুধু মানুষের খাদ্যচাহিদাই পূরণ করে না, বরং শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাসে বড় ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে, আর সেই গ্রামের অর্থনীতি, জীবিকা ও সামাজিক কাঠামোর মূলভিত্তি হলো কৃষিকাজ। উর্বর মাটি, পানি, খোলা পরিবেশ এবং তুলনামূলক ভালো উৎপাদন সম্ভাবনার কারণে কৃষি মূলত গ্রামকেন্দ্রিকভাবেই বিকশিত হয়েছে।
ইতিহাস বলছে, আদিম যুগে নারীর হাত ধরেই কৃষিকাজের সূচনা হয়েছিল। সেই সময় পুরুষরা শিকার করতে চলে গেলে নারীরা গৃহস্থালীর কাজের পাশাপাশি ফলমূলের বীজ ঘরের সামনে ফেলতেন, আর সেখান থেকে চারা গজানো দেখে আনন্দিত হতেন। এভাবেই নারীর হাতে বীজ বপন ও কৃষি উৎপাদনের চর্চা শুরু হয়। সেই আদিমকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত নারীরা কৃষির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত রয়েছে। বরং এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ আরও বেড়েছে। নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ, কিশোর- সকল বয়সের মানুষ কৃষিতে যুক্ত থাকলেও নারীর শ্রমই সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত এবং ধারাবাহিক।
তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের কৃষি খাতে নারী ও পুরুষ উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে; তবে তাদের অংশগ্রহণের ধরন ও স্বীকৃতির মধ্যে রয়েছে বড় বৈষম্য। ধান রোপণ, আগাছা পরিষ্কার, সবজি উৎপাদন, গবাদিপশু পালন, বীজ সংরক্ষণ, ফসল সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ- প্রতিটি ধাপে নারীর উপস্থিতি অত্যন্ত সক্রিয়। অপরদিকে পুরুষরা সাধারণত জমিচাষ, সেচ, পরিবহন বা বাজারজাতকরণের মতো তুলনামূলক ভারী কাজে যুক্ত থাকে। অর্থাৎ কৃষি উৎপাদনে নারী-পুরুষের শ্রম সমানভাবে প্রয়োজন হলেও নারীর শ্রম অনেকটাই অদৃশ্য থাকে, আর স্বীকৃতি পায় পুরুষের কাজই।
কৃষক শব্দটি উচ্চারণ করলে এখনও সবার চোখে পুরুষের চিত্র ভেসে ওঠে। অথচ গ্রামবাংলার মাঠে মাঠে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নারী শ্রমিকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। ঘরের ভেতরের কাজের পাশাপাশি মাঠের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপেও তারা ভূমিকা রাখছে, তবুও সামাজিকভাবে তাদের পরিচয় ‘গৃহিণী’ ‘কৃষক’ নয়। শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, কৃষিতে মোট নিয়োজিত ৪৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে নারীর হার ২৬ শতাংশ, যা পুরুষের ১৯ শতাংশের চেয়ে বেশি। সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪-এ দেখা যায়, ১৮.৪ মিলিয়ন নারী এখন কৃষি খাতে নিয়োজিত, যা কৃষিতে পুরুষের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। তারপরও তারা কৃষক হিসেবে পরিচয় বা কৃষি খাতের সুবিধা- যেমন কৃষক কার্ড, সার সাবসিডি, কৃষি ঋণ- এসবের বেশিরভাগই পায় না।
নারীর শ্রমকে ‘স্বাভাবিক দায়িত্ব’ বা ‘ঘরের কাজ’ হিসেবে দেখা হয়, ফলে তাদের মজুরি বৈষম্যও স্পষ্ট। অনেক ক্ষেত্রে নারীদের সমান পরিশ্রমের পরেও পুরুষের তুলনায় কম মজুরি দেওয়া হয়। আবার ভূমির মালিকানা বেশিরভাগই পুরুষের নামে থাকার কারণে নারীরা কৃষির সিদ্ধান্ত, সম্পদ বা সুবিধায় অংশ নিতে পারে না। তাদের শ্রম যতই অপরিহার্য হোক, মালিকানা না থাকার কারণে ক্ষমতায়নের একটি বড় অংশ তারা হারিয়ে ফেলে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নারী কৃষকদের জন্য ঋণ, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, উপকরণ সহায়তা, বাজার সংযোগ- এসব সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে, যা ধীরে ধীরে তাদের ক্ষমতায়ন ও স্বীকৃতি বৃদ্ধি করছে।
বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষিভিত্তিক উপ-খাতগুলোর মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে নারী। তারা বীজ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তোলা এবং বাজারে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়েই সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। তাই কৃষিতে নারীর শ্রম, দক্ষতা ও অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া শুধু সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন নয়, এটি দেশের কৃষি উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারী কৃষকের অধিকার, সুবিধা এবং পরিচয় নিশ্চিত করা গেলে কৃষি উৎপাদন আরও বাড়বে, কৃষি হবে আরও শক্তিশালী, টেকসই ও ভবিষ্যৎমুখী।
সুমাইয়া ইসরাত ইভা
শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বিভাগ