প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৩ নভেম্বর, ২০২৫
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে শেষ কবে নিরেট ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখেছেন? নাকি আয়নায় তাকালেই সবার আগে চোখে পড়ে ত্বকের রংটা একটু ফ্যাকাশে, চোখের নিচে সামান্য কালি, কিংবা নাকের গড়নটা ঠিক যেমনটা হওয়া উচিত ছিল তেমন নয়?
বর্তমান যুগে ‘সৌন্দর্য’ আর কেবল নান্দনিকতার বিষয় নয়, এটি পরিণত হয়েছে এক বিশাল ও জটিল ‘কসমেটিক সংস্কৃতিতে’। এই সংস্কৃতি আমাদের প্রতিনিয়ত শেখাচ্ছে যে, আমরা যা আছি, তা যথেষ্ট নয়। আমাদের আরও ফর্সা, আরও স্লিম, আরও নিখুঁত হতে হবে। আর এই ‘আরও’-এর কোনো শেষ নেই। এই অন্তহীন দৌড় নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে, তা নিয়ে কথা বলার সময় এসেছে। আগে সৌন্দর্যের ধারণা ছিল অনেকটাই আপেক্ষিক এবং ব্যক্তিগত। কিন্তু আজকের ডিজিটাল যুগে সৌন্দর্যকে একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমে বন্দি করা হয়েছে। ইনস্টাগ্রাম, টিকটক বা ফেসবুকের ফিড স্ক্রল করলে আমরা কী দেখি? ফিল্টার করা নিখুঁত ত্বক, মেদহীন শরীর এবং সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ।
প্রযুক্তি আমাদের হাতে এমন সব ‘ফিল্টার’ তুলে দিয়েছে যা মুহূর্তেই আমাদের চেহারা বদলে দেয়। যখন একজন নারী ভার্চুয়াল জগতের এই কৃত্রিম সৌন্দর্যের সঙ্গে বাস্তব জীবনের তুলনা করেন, তখন জন্ম নেয় হীনম্মন্যতা। তিনি ভুলে যান যে স্ক্রিনে দেখা ওই ছবিটি আসলে আলো, মেকআপ এবং এডিটিং-এর কারসাজি। এই অবাস্তব মানদ- ছোঁয়ার তাড়না নারীকে ঠেলে দিচ্ছে এক চরম মানসিক অস্থিরতার দিকে।
সুন্দর হওয়ার এই চাপ নারীর মনের ওপর বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে-
বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার (Body Dysmorphic Disorder) : এটি এমন এক মানসিক অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি নিজের চেহারার কাল্পনিক বা অতি সামান্য ত্রুটি নিয়ে সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন থাকেন। কসমেটিক সংস্কৃতির চাপে এখন অনেক নারীই মনে করেন তাদের শরীরে ত্রুটি আছে, যা ঠিক করা প্রয়োজন।
আত্মবিশ্বাসের অভাব ও ডিপ্রেশন : যখন সমাজের বেঁধে দেওয়া সৌন্দর্যের ছাঁচে নিজেকে ফেলা যায় না, তখন নিজের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। ‘আমি সুন্দর নই মানে আমি যোগ্য নই’এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে জন্ম নেয় দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন।
সামাজিক ভীতি (Social Anxiety) : অনেকেই মেকআপ ছাড়া বা ‘পারফেক্ট’ লুক ছাড়া জনসমক্ষে যেতে ভয় পান। লোকলজ্জার ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া এই সংস্কৃতিরই একটি বিষাক্ত ফল।
ইটিং ডিসঅর্ডার : ‘জিরো ফিগার’ বা স্লিম হওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা থেকে অ্যানোরেক্সিয়া বা বুলিমিয়ার মতো মারাত্মক খাদ্যাভ্যাসজনিত রোগের শিকার হচ্ছেন হাজারো তরুণী।
আমাদের বুঝতে হবে, কসমেটিক সংস্কৃতি কেবল সৌন্দর্যের বিষয় নয়, এটি একটি বিশাল অর্থনীতি। বিউটি ইন্ডাস্ট্রি বা প্রসাধনী বাণিজ্যের মূল পুঁজি হলো ‘নারীর নিরাপত্তাহীনতা’। যদি কেউ নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে, তবে সে পণ্য কিনবে না। তাই সাধারণ মানুষকে অসন্তুষ্ট রাখাটাই এই বাণিজ্যের মূলমন্ত্র। অ্যান্টি-এজিং ক্রিম থেকে শুরু করে স্কিন হোয়াইটনিং প্রতিটি পণ্যের বিজ্ঞাপন নারীকে মনে করিয়ে দেয় যে, তার বয়স হওয়াটা পাপ, গায়ের রং চাপা হওয়াটা অপরাধ। এই নেতিবাচক বার্তাগুলো অবচেতন মনে গেঁথে যায়, যা নারীকে সারাজীবন এক অতৃপ্তির চক্রে বন্দি করে রাখে।
সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হলো, এই সংস্কৃতির প্রভাব এখন আর প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। টিনেজার বা তার চেয়েও কম বয়সি শিশুরা এখন ‘স্কিনকেয়ার রুটিন’ নিয়ে ব্যস্ত। খেলার বয়সে তারা চিন্তিত তাদের ত্বক কতটা গ্লো করছে তা নিয়ে। এটি তাদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং খুব ছোট থেকেই তাদের আত্মপরিচয়কে কেবল বাহ্যিক রূপের ওপর নির্ভরশীল করে তুলছে। এই বিষাক্ত চক্র থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়, তবে অসম্ভবও নয়। এর জন্য প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন। সৌন্দর্য মানে কেবল নিখুঁত ত্বক বা নির্দিষ্ট শারীরিক গঠন নয়। বুদ্ধিমত্তা, মানবিকতা, দক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাস এগুলোই একজন নারীর প্রকৃত সৌন্দর্যের মাপকাঠি হওয়া উচিত।
যে পেজ বা প্রোফাইলগুলো দেখলে নিজের মধ্যে হীনম্মন্যতা তৈরি হয়, সেগুলোকে আনফলো করা উচিত। মনে রাখা দরকার, সোশ্যাল মিডিয়া কখনওই জীবনের পূর্ণ চিত্র নয়। নিজের শরীর এবং চেহারাকে ধন্যবাদ জানানো দরকার করণ এই শরীরটিই আপনাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, কাজ করার শক্তি দিচ্ছে। একে ঘৃণা না করে যত্ন নেওয়া শিখতে হবে। এখনই উপযুক্ত সময় বিজ্ঞাপন এবং মিডিয়ার কারসাজি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার। তারা কী বিক্রি করছে এবং কেন বিক্রি করছে, সেই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য বুঝতে পারলে জনসাধারণ আর তাদের ফাঁদে পা দেবে না। সুন্দর হওয়ার আকাঙ্ক্ষা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা যখন আবেশ বা বাতিকে (Obsession) পরিণত হয় এবং মানসিক শান্তি কেড়ে নেয়, তখনই তা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের মনে রাখতে হবে, একজন নারীর পরিচয় তার প্রসাধনীর স্তরে বা ফিল্টার করা ছবিতে নয়, বরং তার ব্যক্তিত্বে, মেধা ও মননে। কসমেটিক সংস্কৃতির এই জৌলুসের নিচে চাপা পড়া আত্মবিশ্বাসকে আবার জাগিয়ে তোলাই হোক আজকের অঙ্গীকার।
হেনা শিকদার
দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়