ঢাকা শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পূর্বাহ্নেই কেন রচিত হচ্ছে জীবন সায়াহ্নের গল্প

মো. তাহমিদ রহমান
পূর্বাহ্নেই কেন রচিত হচ্ছে জীবন সায়াহ্নের গল্প

বহমান জীবনধারায় চারপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতি নিত্য অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে। উদীয়মান কৈশোর থেকে উদ্দীপ্ত যৌবনের স্বপ্নময় জগতে পা দেওয়ার সময় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যথাযথ নিয়ামকের ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হলে অসময়ে জীবনে নেমে আসে ধূসর প্রৌঢ়ত্ব। জীবন জগতের উদ্দীপ্ত যৌবন সূর্য যখন উজ্জ্বল বিকিরণের দ্যুতিময় আভা ছড়ানোর কথা ঠিক সেই সময় সায়াহ্নের ম্লান আলোয় জীবনচক্র নিমজ্জিত হয় বিভীষিকার গ্লানিতে। চলমান সময়ে অনেকটা নিভৃতেই দেশে স্বাস্থ্যঝুঁকির ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে এইডস। সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় ভীতির কারণে এইডস সংক্রমণের বিস্তৃতি আমাদের দেশে অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় দৈনিক গুলোতে প্রকাশিত খবর অনুয়ায়ী বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইডস বা এইচআইভি সংক্রমণের হার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এইচআইভি (Human Immunodeficiency Virus) একটি ভাইরাস যা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধাপে ধাপে ধ্বংস করে এবং চিকিৎসা না করা হলে এটি এইডস (Acquired Immunodeficiency Syndrome)-এ রূপ নিতে পারে। একটি তরুণ-নির্ভর উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এ বৃদ্ধি অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। কারণ, আমাদের দেশের ভবিষ্যত অগ্রগতি, উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তির প্রধান ভরকেন্দ্র হলো এই তরুণ সমাজ। পত্রিকার রিপোর্ট, গবেষণা এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে ১৫-৩৫ বছর বয়সি তরুণ ও যুবক সমাজ উদ্বেগজনক ভাবে এইডসে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষত সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে এইডস রোগীর সংখ্যা। একাধিক জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সমকামী আচরণ বৃদ্ধির কারণে এইডস সংক্রমণের হার তীব্র হচ্ছে। সীমান্তবর্তী জেলা যশোরে স্কুলগামী তরুণদের মধ্যে এইডস সংক্রমণের হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। শুধুমাত্র যশোর সদর হাসপাতালেই চলতি বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৪০ জন এইচআইভিতে সংক্রমিত রোগী সনাক্ত করা হয়েছে। উদ্বেগজনক বিষয় হলো- আক্রান্তদের মধ্যে ২৫ জনই শিক্ষার্থী। যেখানে ২০২৪ সালে মোট ২৫ জনের মধ্যে শিক্ষার্থী ছিল ১২ জন, সেখানে এ বছর মাত্র ১০ মাসেই সেই সংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়েছে। সংক্রমিতদের মধ্যে অনেকে এইডসে আক্রান্ত। সংক্রমিত ও আক্রান্ত এসব শিক্ষার্থীদের বয়স ১৭ থেকে ২৩ বছরের মধ্যে। এই পরিসংখ্যান সুস্থ সমাজ ব্যবস্থার জন্য গভীর উদ্বেগের। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে ২৩ জন সমকামী। বর্তমানে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের এআরটি (অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি) সেন্টারে মোট ২২০ জন এইচআইভি ও এইডস আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। যশোরের মতো সিরাজগঞ্জেও বাড়ছে এইচআইভি পজিটিভ রোগীর সংখ্যা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা শতাধিক। বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে খুলনাঞ্চল। গত মে মাস পর্যন্ত খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যান্টি রেক্ট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) সেন্টারে ৪২ জনের নমুনায় এইচআইভির জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত হয়েছে খুলনা জেলায়। একই সময়ে এ রোগে মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, গত তিন বছরে (২০২২-২৫) দেশে নতুন করে এইচআইভি আক্রান্ত হয়েছে ৩ হাজার ৬০০ জনের বেশি এবং মারা গেছে অন্তত ৬০০ জন। শুধু ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই শনাক্ত হয়েছে ৮৮২ জন। জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল মূলত চারটি বয়স স্তরে ভাগ করে এইডস আক্রান্তদের পরিসংখ্যান তৈরি করে। সেগুলো হলো ০-১৪, ১৫-২৪, ২৫-৪৯ ও ৫০-ঊর্ধ্ব। গত পাঁচ বছরে ২৫-৪৯ বছর বয়সীদের মধ্যে এইডস সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। এ বয়সিদের মধ্যে ৪ হাজার ৪৪৮ জনের এইডসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। তাছাড়া ১৫-২৪ বছর বয়সী ১ হাজার ৫৬ জন, ৫০-ঊর্ধ্বদের মধ্যে ৬০৬ জন এবং ০-১৪ বছর বয়সি ২৫৩ জনের মধ্যে এইডস সংক্রমণ ধরা পড়েছে। দেশে বর্তমানে ১৪ থেকে ১৭ হাজার মানুষ এইচআইভি নিয়ে বেঁচে আছে। যদিও সামগ্রিক প্রাদুর্ভাব (১৫–৪৯ বছর বয়সি জনগোষ্ঠীর মধ্যে) ০.১ শতাংশের কম। তবু কিছু ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীতে সংক্রমণ হার তুলনামূলকভাবে বেশি। এতো গেল পরিসংখ্যান কিন্তু ভাবনার বিষয় হচ্ছে কেন আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে এতো বেশি এইচআইভি সংক্রমণ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে? এইচআইভি বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ যৌন অসচেতনতা , সামাজিক ট্যাবু ও স্টিগমা। এর বাইরে রয়েছে মাদক। মাদকাসক্তি বড় একটি সমস্যা এবং এটি বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। মাদকাসক্তি একটি রোগ। একজন মাদকসেবি যখন এইচআইভি ভাইরাসে সংক্রমিত হন তখন তা সমাজের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। মাদকদ্রব্য ও এইডস মানুষের অকালমৃত্যু এবং স্বাস্থ্যহানির অন্যতম প্রধান কারণ। মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মের বিপথগামিতাও সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা মাদক গ্রহণকালে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করে। যেমন- অনিরাপদ ও একাধিক যৌন সম্পর্ক, সুঁই/সিরিঞ্জের শেয়ার করে মাদক গ্রহণ ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন রোগের মতো মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তিরা এইডসের ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত এইচআইভি এইডসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর বড় অংশ হচ্ছে যারা সুঁই ও সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ করে। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে অবৈধভাবে আসা নেশাজাতীয় ইনজেকশনের মাধ্যমে এই রোগ বেশি ছড়াচ্ছে। ইন্টারনেটের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, কৌতূহল এবং যৌনশিক্ষার অভাবে অনেকে অনিরাপদ সম্পর্কে জড়াচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত যৌন সম্পর্ক এবং পতিতাবৃত্তি এইচআইভি/এইডস সংক্রমণ বৃদ্ধির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী কারণ। পতিতাদের মধ্যে অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি কাভারেজ তুলনামূলক কম এবং অনেকেই লজ্জা, অজ্ঞতার ও অপ্রতুল স্বাস্থ্যসেবার কারণে প্রয়োজনীয় সেবা পান না। অনেকে অর্থগত দরিদ্রতার কারণে নিরাপত্তার সঙ্গে মিলন করার চেয়ে খদ্দেরের চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। যা পতিতাদের মাধ্যমে অন্যদের মাঝে এইডস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। ভয়াবহ উদ্বেগের বিষয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে জানতে পারি যে এইডস আক্রান্ত রোগী হতাশা থেকে আক্রমণাত্মক মানসিকতার দ্বারা নিজের সংক্রমণের কথা গোপন রেখে ইচ্ছে করে অন্যদের মাঝে রক্তদান, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে এইডস সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী প্রতিটি দেশে সংক্রমণ অনেক বেশি। এসব দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের অবাধ যাতায়াত রয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দেশে ফেরত আসা লোকদের একটি অংশ এইচআইভি-এইডসে আক্রান্ত। আবার আমাদের দেশের অনেক এইচআইভি-এইডসে আক্রান্ত মানুষ শনাক্তের বাইরে রয়ে গেছে। এ সংখ্যাও কম নয়। আক্রান্ত যেসকল মানুষ জানেন না যে তাদের এইচআইভি-এইডসের জীবাণু শরীরে রয়েছে। তারা পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনসহ সকলের সঙ্গে অন্য সবার মতো চলাফেরা করে। এইচআইভির সংক্রমণ যেসব মাধ্যম দ্বারা ছড়ায় তারা সেগুলোর দ্বারা অন্যদের সংক্রমিত করছে। প্রয়োজনে অন্যদেরকে রক্তদান করলে রক্ত গ্রহীতা নিজের অজান্তেই এইডস সংক্রমিত হচ্ছেন। তাই রাষ্ট্রীয় ভাবে রক্ত গ্রহণ ও প্রদানের সময় এইডস এর জীবাণু আছে কি না তা পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক করা দরকার। ব্লাডব্যাংক গুলোর এ বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। মরণ ব্যাধি এইডস থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে এবং জাতিকে মুক্ত রাখতে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার বিকল্প নেই। পৃথিবীতে কোনো ধর্মই অবাধ যৌনাচারসহ অযাচিত জীবন-যাপনকে সমর্থন করে না। ধর্মীয় অনুশাসন ও শৃংখলিত জীবন-যাপনই প্রত্যেক ধর্মের মূলমন্ত্র। এইচআইভি তথা এইডস মুক্ত থাকতে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা অত্যন্ত জুরুরি। সেইসঙ্গে, এইডস কি? কেন এবং কিভাবে এ রোগের সৃষ্টি হয়? কিভাবে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে? এর পরিণাম কি? এ বিষয়গুলো মানুষকে অবহিত করে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলেই এইডস-এর মতো মরণ ব্যাধি থেকে সমগ্র জাতি মুক্তি লাভ করতে পারবে।

মো. তাহমিদ রহমান

শিক্ষক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত