ঢাকা বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

উপমহাদেশে বড় ভূমিকম্পের ঘণ্টাধ্বনি : টেকটোনিক বাস্তবতা ইতিহাস ও বাংলাদেশের ঝুঁকি

সাদিয়া সুলতানা রিমি
উপমহাদেশে বড় ভূমিকম্পের ঘণ্টাধ্বনি : টেকটোনিক বাস্তবতা ইতিহাস ও বাংলাদেশের ঝুঁকি

দক্ষিণ এশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে সক্রিয় ও গতিশীল ভূমিকম্পীয় অঞ্চলের একটি। ভূতত্ত্ববিদরা বহু বছর ধরেই সতর্ক করে আসছেন এই উপমহাদেশে বড় ভূমিকম্প কেবল সম্ভাবনার বিষয় নয়; এটি সময়ের অপেক্ষা মাত্র। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও একটি ভুল ধারণা বিরাজমান এ অঞ্চলে নাকি বড় কোনো ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা কম। বাস্তবে বৈজ্ঞানিক তথ্য, প্লেট টেকটোনিকস, ভূমিকম্পের ইতিহাস এবং সাম্প্রতিক চাপ-পরিমাপ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় উপমহাদেশের ভূমিকম্পীয় ভবিষ্যৎ অত্যন্ত ভয়াবহ হতে পারে। বাংলাদেশও সেই ঝুঁকির বাইরে নয়; বরং ভৌগোলিক অবস্থান, জনঘনত্ব এবং দুর্বল অবকাঠামোর কারণে ঝুঁকি আমাদের জন্য আরও বেশি।

উপমহাদেশের ভূমিকম্পকে বুঝতে হলে প্রথমেই জানতে হবে ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষের কথা। প্রায় ১০ কোটি বছর আগে আফ্রিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইন্ডিয়ান প্লেট দ্রুতগতিতে উত্তরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। এই প্লেটটি আজও বছরে প্রায় ৪-৫ সেন্টিমিটার বেগে উত্তরের দিকে সরে যাচ্ছে, যেখানে সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল ইউরেশিয়ান প্লেট। দুই প্লেটের এই সংঘর্ষের ফলেই জন্ম হয়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতমালা হিমালয়। কিন্তু হিমালয় শুধু একটি পর্বত শ্রেণি নয়, এটি চলমান টেকটোনিক চাপের বাহক। যতক্ষণ ইন্ডিয়ান প্লেট উত্তরের দিকে ধাক্কা দেবে, ততক্ষণ এই চাপ জমতেই থাকবে, আর একসময় তা ভূমিকম্পের মাধ্যমে হঠাৎ মুক্ত হবে।

এই উপমহাদেশে তিনটি বড় ভূমিকম্প অঞ্চল রয়েছে। প্রথমটি হলো হিমালয়ান মেগা-থ্রাস্ট বেল্ট, যা পাকিস্তান থেকে শুরু করে কাশ্মীর, নেপাল, ভুটান, আসাম হয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক সিসমিক জোন, যেখানে নিয়মিত বড় মাত্রার ভূমিকম্প ঘটে থাকে। এই অঞ্চলে ৭.৫ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কারণ এখানে ইন্ডিয়ান প্লেট ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে স্লাইড করার চেষ্টা করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে সঞ্চিত চাপ একসময় ভয়াবহ শক্তিতে বিস্ফোরিত হয়।

দ্বিতীয় অঞ্চলটি হচ্ছে পেনিনসুলার ইন্ডিয়া বা ভারতীয় স্থিতিশীল শিল্ড এলাকা। যদিও এটিকে তুলনামূলক নিরাপদ বলা হয়, কিন্তু ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। ১৯৯৩ সালের লাতুর ভূমিকম্প, ১৯৯৭ সালের জবলপুর ভূমিকম্প এবং ২০০১ সালের গুজরাট-কচ্ছ ভূমিকম্প প্রমাণ করে এই অঞ্চলের পুরোনো ফল্টগুলোও মাঝেমধ্যে সক্রিয় হতে পারে এবং বড় ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে পারে। অর্থাৎ শুধু হিমালয় নয়, ভারতের দক্ষিণাঞ্চলও ভূমিকম্পের ঝুঁকি বহন করে।

তৃতীয় এবং বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হলো ইন্দো-বার্মা আর্ক বা মিয়ানমার-চট্টগ্রাম-সিলেট বেল্ট। এখানে তিনটি প্লেটের জটিল মিথস্ক্রিয়া ঘটে ইন্ডিয়ান প্লেট, বার্মা মাইক্রো-প্লেট এবং সুনদা প্লেট। এই বহুমুখী সংঘর্ষ বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকিকে এরইমধ্যে বহুবার রেড লাইন দিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট এবং ঢাকার ভূমিকম্প ঝুঁকি এই টেকটোনিক জটিলতার ফলেই সবচেয়ে বেশি।

বাংলাদেশকে সাধারণত ঘূর্ণিঝড়, বন্যা বা নদীভাঙনের দেশ হিসেবে ভাবা হয়, কিন্তু ভূমিকম্পের ঝুঁকি আরও বেশি প্রাণঘাতী। বাংলাদেশ তিনটি সক্রিয় ফল্ট লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে চট্টগ্রাম-মিয়ানমার সাবডাকশন জোন, সিলেট-ডাউকি ফল্ট এবং ঢাকা-মধুপুর ফল্ট। এর মধ্যে চট্টগ্রাম-মিয়ানমার সাবডাকশন জোনটি পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় এবং বিপজ্জনক ফল্ট, যেখানে ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা বৈজ্ঞানিকভাবে বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে। যদি এই অঞ্চলে বড় কোনো স্লিপ ঘটে, তবে চট্টগ্রাম বন্দর, কক্সবাজার উপকূল এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সিলেট অঞ্চলের ডাউকি ফল্ট তো আরও বিপজ্জনক। ১৮৯৭ সালের শিলং-আসামের ৮.১ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় ব্যাপক ধ্বংস দেখা গিয়েছিল। এই ফল্ট আজও সক্রিয় এবং প্রচুর চাপ সঞ্চিত অবস্থায় রয়েছে। শহরাঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দুর্বল অবকাঠামো এবং অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণের কারণে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ অঞ্চলে একটি মাঝারি থেকে বড় ভূমিকম্পও ব্যাপক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।

রাজধানী ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি শহরের অন্যতম। কারণ এখানে নরম অলুভিয়াল মাটি, অগণিত দুর্বল ভবন, অগোছালো নগরায়ণ, সংকীর্ণ রাস্তা এবং প্রাথমিক উদ্ধারব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বড় ভূমিকম্প হলে ঢাকার ভবনগুলো ডমিনো ইফেক্টের মতো ভেঙে পড়তে পারে একটির ওপর আরেকটি। ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধারকাজ কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহও স্থবির হয়ে পড়বে।

উপমহাদেশে বড় ভূমিকম্প আগেও হয়েছে এবং নিয়মিত বিরতিতে হয়েছে। ১৮৯৭ সালের আসামণ্ডশিলং ভূমিকম্প, ১৯৩৪ সালের নেপাল-বিহার ভূমিকম্প, ১৯৫০ সালের আসামণ্ডতিব্বত ভূমিকম্প, ২০০১ সালের গুজরাট ভূমিকম্প এবং ২০০৫ সালের পাকিস্তান-কাশ্মীর ভূমিকম্প প্রমাণ করে এই অঞ্চল ভূমিকম্পে পরিপূর্ণ। ভূমিকম্পের উৎপত্তি কোনো যান্ত্রিক দুর্ঘটনা নয়; এটি একটি চক্র। চাপ জমবে, এবং একসময় তা মুক্ত হবে, বড় কম্পনের মাধ্যমে। হিমালয় বেল্টের ভূমিকম্প চক্র অনুযায়ী, ৮+ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সময়সীমা এরইমধ্যে অতিক্রান্ত। অর্থাৎ চাপ এখন বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে।

গত ২১ নভেম্বর ২০২৫ সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে বাংলাদেশে এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প আঘাত হানে। উৎসগুলো অনুযায়ী এটি ছিল প্রায় ৫.৫-৫.৭ মাত্রার কম্পন, উৎসস্থল ছিল মাধাবদী, নরসিংদী জেলার একেই এলাকায়, রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে। কম্পনের গভীরতা মাত্র ১০ কিলোমিটার, যা ভূমিকম্পের প্রভাবকে বিশেষভাবে ভয়ানক করে তোলে। এই কম্পনে কমপক্ষে ১০ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছেন, পাশাপাশি অসংখ্য ভবনে ফাটল পড়েছে এবং অনেকেই আতঙ্কে ঘর-বাড়ি ছাড়া রাস্তায় নেমে এসেছে। এটি শুধু একমাত্র ঘটনা নয় এর পরেকালে একটি ছোট আফটারশকও ধরা পড়েছে যা মানুষকে আরও উদ্বিগ্ন করেছে।

এই ঘটনার গুরুত্ব শুধু সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়। কারণ এতে স্পষ্ট হয়ে গেছে ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় এমন কম্পন কখনও হয়নি সাম্প্রতিক সময়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি হয়তো শুধু ‘অপরিকল্পিত শক্তি মুক্তি’ নয় বরং বড় সঞ্চিত চাপের একটি ইঙ্গিত হতে পারে। অর্থাৎ ভবিষ্যৎ দিকে তাকিয়ে অবস্থান আরও সংকটময়। ফলে আমাদের প্রস্তুতি ব্যবস্থা, উদ্ধার কার্যক্রম, বিল্ডিং কোড ও নগর বাজেট পরিকল্পনায় দ্রুত সংস্কার আনার বিকল্প নেই।

অনেকে মনে করেন এই অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা ‘জিরো’। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে এমন ধারণা ভুল। প্লেট মুভমেন্ট কখনও থেমে নেই, তাই চাপও থামে না। ভূমিকম্প গ্যাপ জোনগুলো (যেখানে বহু বছর ধরে বড় কম্পন হয়নি) ক্রমশ বড় হচ্ছে।

সাদিয়া সুলতানা রিমি

শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত