ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

অবকাঠামোর অগোছালো শহর : ঝুঁকির ভেতর ঢাকা

সানিয়া তাসনিম লামিয়া
অবকাঠামোর অগোছালো শহর : ঝুঁকির ভেতর ঢাকা

এই বছরের একটি ঘটনায় পুরান ঢাকার একটি পাঁচতলা ভবন হালকা ভূমিকম্পে দুলে উঠে ভয়াবহ আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। পরে তদন্তে জানা যায়- ভবনটি নির্মাণের সময় অনুমোদিত নকশা মানা হয়নি, লোহার রড ও সিমেন্টের পরিমাণও যথাযথ ছিল না। এই একটি ঘটনাই ঢাকার বাস্তবতা স্পষ্ট করে : নগরজুড়ে এমন অসংখ্য ভবন রয়েছে, যেগুলো দাঁড়িয়ে আছে শুধু ভাগ্যের ওপর। ঢাকা আজ বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল মহানগর। আবাসনের চাহিদা আকাশছোঁয়া, আর সেই সুযোগে বহু সময়ে প্রভাবশালী নির্মাণকারী ও মালিকরা নিয়মণ্ডনীতি উপেক্ষা করে ভবন নির্মাণ করে চলেছেন। RAJUK -এর অনুমোদন, স্ট্রাকচারাল টেস্ট, মাটির ধারণক্ষমতা যাচাই, এগুলো কাগজে থাকলেও বাস্তবে তা অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত। ফলে শহরের এক বিশাল অংশে গড়ে উঠেছে অনিয়ন্ত্রিত, দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন-জঙ্গল।

সমস্যা শুধু নতুন নির্মাণে নয়; পুরান ভবনগুলোর অবস্থাও আরও ভয়ার্ত। বেশিরভাগ ভবনই Retrofit করা হয়নি, ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাঠামোগত শক্তি কমে যাচ্ছে। সংকীর্ণ গলি, অপরিকল্পিত বৈদ্যুতিক তার, দাহ্যসামগ্রীতে ভরা বাজার- এসব কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত উদ্ধার কাজ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ভূমিকম্পপ্রবণ দেশে ঢাকার এই অব্যবস্থাপনা শহরবাসীকে প্রতিনিয়ত অদৃশ্য ঝুঁকির মধ্যে রাখছে। কোনো বড় ভূমিকম্প বা অগ্নিকাণ্ড ঘটলে এর পরিণতি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে। তাই অনিয়ন্ত্রিত ভবন নির্মাণ সমস্যাটি শুধু নান্দনিকতা বা শৃঙ্খলার বিষয় নয়; এটি রাজধানীর কোটি মানুষের জীবন-মরণের সঙ্গে জড়িত এক গভীর সংকট।

ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় করা সাম্প্রতিক একটি জরিপে দেখা যায় অধিকাংশ বাসিন্দাই তাদের বসবাস করা ভবনের নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত নন। জরিপে অংশ নেওয়া মানুষের ৬৩ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদিত কি না, তা তারা জানেন না। ৪৮ শতাংশ মনে করেন ভবনের দেয়ালে ফাটল, স্যাঁতসেঁতে ভাব বা রড দেখা যাওয়ার মতো লক্ষণ নিয়মিতই দেখা যায়, কিন্তু মালিক পক্ষ সেগুলোকে গুরুত্ব দেন না। দমকল বিভাগের জরিপেও দেখা গেছে, ঢাকার বিপুলসংখ্যক ভবনে নেই জরুরি নির্গমন পথ বা আগুন নেভানোর উপযুক্ত ব্যবস্থা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব তথ্য প্রমাণ করে যে রাজধানীর উল্লেখযোগ্য অংশই কাঠামোগত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, এবং যেকোনো দুর্যোগ বড় বিপর্যয়ে পরিণত হতে পারে।

ঢাকায় অনিয়ন্ত্রিত ভবন নির্মাণের পেছনে রয়েছে বহুস্তরীয় কারণ। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং আবাসনের তীব্র চাহিদা নির্মাণকারীদের ওপর একটি অঘোষিত চাপ তৈরি করেছে। এই চাপের সুযোগ নিয়ে অনেক মালিক ও ডেভেলপার নিয়মনীতি উপেক্ষা করে দ্রুত লাভের জন্য ভবন নির্মাণ করে ফেলেন। অনুমোদন প্রক্রিয়ার জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা অনেককে ‘শর্টকাট’ পথে যেতে উৎসাহিত করে। ফলে অনেক ভবনই RAJUK -এর অনুমোদিত নকশা ছাড়া নির্মিত হয়, বা নির্মাণের সময় নকশা থেকে বিচ্যুতি ঘটে।

আবার দুর্বল মনিটরিং ও দুর্নীতি বড় ভূমিকা রাখে। নির্মাণের প্রতিটি ধাপে যথাযথ তদারকি থাকা প্রয়োজন হলেও বাস্তবে তা খুবই সীমিত। অনেক ক্ষেত্রে মানহীন ইট, বালু বা রড ব্যবহার করা হয় খরচ কমানোর জন্য। সাধারণ জনগণের মধ্যে ভবন নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতা কম। তারা জানেন না তাদের ভবন কাঠামোগতভাবে শক্তিশালী কি না, কিংবা ঝুঁকি কমাতে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কতটা জরুরি। তাছাড়া পুরান ভবনগুলোর Retrofit না করা এবং মেরামতের অভাব শহরকে আরও ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেয়। পাশাপাশি সংকীর্ণ রাস্তা, অবৈধ বিদ্যুতের সংযোগ, এবং অগ্নি-নিরাপত্তার দুর্বলব্যবস্থা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। এসব মিলিয়েই ঢাকার ভবন নিরাপত্তা আজ বড় একটি সংকটে রূপ নিয়েছে।

ঢাকার অনিয়ন্ত্রিত ভবন নির্মাণ সমস্যার কার্যকর সমাধান শুরু হতে হবে শক্তিশালী নীতি প্রয়োগ ও কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে। RAJUK-এর অনুমোদন প্রক্রিয়া আধুনিক ও স্বচ্ছ করতে হবে, যাতে কেউ বিলম্ব বা জটিলতার কারণে অবৈধ পথে যেতে না পারে। ডিজিটাল অনুমোদন ব্যবস্থা, নিয়মিত আপডেট ও অনলাইন যাচাই-ব্যবস্থা এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। নির্মাণকাজের প্রতিটি ধাপে মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে- মাটি পরীক্ষা, স্ট্রাকচারাল ডিজাইন, রড-বালু-সিমেন্টের গুণগতমান- এসব বিষয়ে নিয়মিত পরিদর্শন বাধ্যতামূলক করতে হবে।

পুরান ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর তালিকা তৈরি করে দ্রুত Retrofit বা পুনর্নির্মাণ করতে হবে। এগুলোকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন’ হিসেবে চিহ্নিত করে মালিকদের নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সংস্কারের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা জরুরি। চতুর্থত, অগ্নিনিরাপত্তা উন্নত করতে সব ভবনে জরুরি সিঁড়ি, অ্যালার্ম, ফায়ার এক্সটিংগুইশার এবং পানি সংগ্রহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা উচিত। দমকল বাহিনীর প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে এমন সংকীর্ণ রাস্তা বা অবৈধ স্থাপনা দ্রুত অপসারণ করাও জরুরি।

জনসচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত প্রয়োজন। বাসিন্দাদের শেখাতে হবে ভবনের ফাটল, দুলে ওঠা, পানি চুঁইয়ে পড়া—ইত্যাদি উপসর্গ কখন বিপদের ইঙ্গিত দেয়। সরকার, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং নগর উন্নয়ন সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগেই কেবল ঢাকার ভবন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। ঢাকার অনিয়ন্ত্রিত ভবন নির্মাণ শুধু একটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, এটি আমাদের সামগ্রিক মানসিকতার প্রতিচ্ছবি। আমরা অনেকেই এখনও মনে করি নিয়ম মানা মানেই ঝামেলা, আর শর্টকাটই শেষ কথা। কিন্তু এই অবহেলা ও অসচেতনতার মূল্য যে কত ভয়াবহ হতে পারে- রানা প্লাজা ধস, চকবাজারের আগুন কিংবা পুরান ঢাকার ভবন দুলে ওঠার ঘটনাগুলো বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয়। নিরাপত্তা এমন একটি বিষয়, যা একবার ভেঙে পড়লে আর ফিরে পাওয়া যায় না। তাই ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে কঠোর নীতি, শক্ত তদারকি এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া ঢাকার ভবনঝুঁকি কমানো সম্ভব নয়। সুতরাং, ভবন নিরাপত্তাকে জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, কারণ এটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষার প্রশ্ন। নিয়মমানা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, বরং সমাজের প্রতিটি ব্যক্তির দায়বদ্ধতা।

ঢাকার আকাশরেখায় দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য ভবন যেন এক মহানগরের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের দ্বৈত প্রতিচ্ছবি। যেখানে পরিকল্পনার অভাব ও অবহেলা মিলেমিশে তৈরি করেছে অদৃশ্য বিপদের ছায়া। নিরাপত্তা শুধুই কাঠামোর শক্তিতে নয়- মানুষের সচেতনতা, রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা ও সমাজের সতর্ক দৃষ্টিতেই তার প্রকৃতভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই সময় এসেছে স্বপ্নের শহরটিকে শুধু উঁচু ভবনের নয়, নিরাপদ জীবনের শহর হিসেবে গড়ে তোলার। নিয়ম, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার আলোই পারে এই অস্থির ইটকাঠের জঙ্গলকে নিরাপদ আশ্রয়ে রূপ দিতে।

সানিয়া তাসনিম লামিয়া

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত