প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৮ নভেম্বর, ২০২৫
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় বলেছেন- ‘বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ কাজেই বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে দেশপুনর্গঠনের জন্য নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিশাল জনসংখ্যার দেশে প্রায় অর্ধেক নারী আর অর্ধেক পুরুষ। তাই অর্ধেক জনসংখ্যাকে বাদ দিয়ে কোনো জাতি উন্নয়নের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারে না। একটি উন্নয়নশীল দেশগঠনে যেমন পুরুষের ভূমিকা রয়েছে, তেমনি নারীদেরও যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
আগেকার দিনে নারী ও পুরুষ একে অপরের সঙ্গে পরস্পর মিলন-বন্ধন থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের গৃহসামগ্রিক কল্যাণে বিবেচনা করা হতো। আবার কোনো কোনো পরিবারে অর্থাৎ স্বামীরগৃহে নারীদের ক্রীতদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সমাজে অধিকাংশ দরিদ্র পরিবার তাদের চিন্তাভাবনায় মেয়েদের বিয়ে দিতে পারলেই যেন দায়মুক্ত হয়। ফলে নারী শিক্ষা সম্পর্কে তেমন কোনো জ্ঞান ছিল না। সেকালে নারীরা শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক পিছিয়ে ছিল এবং দেশের উন্নয়ন ঘটেনি। মূলত নব্বই দশকের পর থেকে নারী শিক্ষাব্যবস্থাকে জোর দেওয়া হয়েছে।
বর্তমান দেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ হলো- পোশাকশিল্প, সেখানে অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। তাদের মধ্যে অনেকেই স্বল্পশিক্ষিত; কিন্তু কর্মক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা থাকলে আরও উন্নতির আশা করা যায়। এখনও কিছু গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নারী শিক্ষাকে মূল্যহীন ও অসার বলে মনে করেন। সমাজে যেসব নারী অশিক্ষিত, তারা শুধু পরিবারের জন্য নয়, বরং জাতির জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে একজন মা শিক্ষিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। তখন সমাজ থেকে বিতাড়িত হবে অন্ধকার ও মূর্খতার ছায়া। কেননা, মায়ের শিক্ষা-দীক্ষা প্রাথমিকভাবে সন্তানের ওপর প্রতিফলিত হয়। এ জন্য সম্রাট নেপোলিয়ন জাতির উদ্দেশ্যে বলেন- ‘আমাকে তোমরা শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’
আধুনিক বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে তাল মেলাতে আজ বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে। যার মূল কারণ হচ্ছে, পুরুষের পাশাপাশি নারী শিক্ষার প্রতি জোর দেওয়া এবং বিভিন্ন ধরনের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা। দেশের রাজনৈতিক শাখা কিংবা প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নারীদের সাফল্য তুঙ্গে। খেলাধুলা থেকে শুরু করে সুদূর এভারেস্ট জয় করতে নারীরা কখনও পিছু হটেনি। আশা করা যায়, একদিন এ দেশের নারীরা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো সাফল্যের ইতিহাস রচনা করবেন। কেননা, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারীরা বারবার প্রমাণ করেছে, পুরুষের চেয়ে কোনো কিছুতে তারা পিছিয়ে নেই। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, জাপান, ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, কানাডা, নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ডসহ বহু দেশে নারীরা শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও সামরিকপদে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে যাচ্ছে। এমন কি সমাজসেবা ও রাজনৈতিক শাখায় নারীদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। যাদের নাম সচরাচর আসে, তারা হলেন- হেলেন কেলার, মেরি কুরি, মাদার তেরেসা, সুলতানা রাজিয়া, বেনজীর ভুট্টো প্রমুখ।
পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম হলেও ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেক মুসলমানের ওপর জ্ঞানার্জন করা ফরজ। এ জন্য নারী শিক্ষাব্যবস্থাকে জোর দেওয়া উচিত। কেননা ইসলামের সর্বজনীন বিধানগুলো খুব সহজে জানতে ও বুঝতে পারবে। নিজেদের প্রতিবেশীর মধ্যে দাওয়াতের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে। ব্যক্তিগত বৈবাহিক জীবন কিংবা পারিবারিক জীবনকে আরও সুন্দর করে তুলতে পারবে। তাদের সন্তানকে সু-শিক্ষা দিয়ে সমাজ কিংবা রাষ্ট্রগঠনে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে। এক সময় আরব বিশ্বে নারীদের ক্রীতদাসী মনে করা হতো এবং সামাজিকভাবে তাদের কোনো অবস্থানই ছিল না। মহানবী (সা.)-এর আবির্ভাবের ফলে ধীরে ধীরে নারী শিক্ষার ব্যাপক উন্নতি হয়। সে সময় নারীরা অন্ধকার থেকে আলোর সন্ধানীপথে অগ্রসর হন। বেশ কিছু মহীয়সী নারী জন্মেছিলেন; তারা হাদিস বর্ণনা থেকে শুরু করে পাঠদান, গ্রন্থরচনা, ফতোয়া প্রদান ও ওয়াজ-নসিহতের মতো গুরুত্বপূর্ণ খেদমত করেছেন। ইসলামী সমাজে হাজার হাজার ইলমপিপাসু মানুষ তাদের থেকে জ্ঞানার্জন করেছেন। কাজেই একটি জাতিকে মননশীল হতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
সর্বোপরি, দেশের উন্নয়নে নারী ও পুরুষের যৌথ প্রচেষ্টা থাকতে হবে। নারী শিক্ষা ব্যাপারে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনপদ নিয়ে সরকারের বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে এবং পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। যেহেতু সরকার প্রতিবছর বিনামূল্যে পাঠ্যবই প্রদান এবং মেয়েদের প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে উপবৃত্তি প্রদান করে থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- গ্রামীণ সমাজ বা শহরের মধ্যে বিভিন্ন বস্তিতে এখনো বাল্যবিবাহ রোধ সম্ভব হয়নি।
ওই সমস্ত এলাকায় মেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষায় তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। এ জন্য নারীদের প্রতি অবহেলা নয় বরং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। ইদানীং কয়েকবছর ধরে বাংলাদেশে নারী শিক্ষার প্রসার ব্যাপকহারে উন্নতি হচ্ছে। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সারাজীবন নারীদের অগ্রগতি ও উন্নয়নের কথা ভেবেছিলেন, তা যেন আজ মর্মে মর্মে মিলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে সমাজ, বদলে যাচ্ছে দেশ। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আমরা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব।
হাফিজ মুহাম্মদ
শিশুসাহিত্যিক, গীতিকার ও কলাম লেখক