প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৯ নভেম্বর, ২০২৫
ঢাকার বস্তিগুলো যেন এখন একেকটি অগ্নিঝুঁকির ঘূর্ণিপাক। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি আমাদের নগর পরিকল্পনার ব্যর্থতার নির্মম সাক্ষী। জীবনের ঝুঁকি আর অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকা হাজার হাজার মানুষ আজও এসব বস্তিতেই আশ্রয় নিতে বাধ্য। কিন্তু রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণের খাতায় যেন এই মানুষগুলো নেই- তাদের জীবন, নিরাপত্তা কিংবা ভবিষ্যৎ যেন উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।
২৫ নভেম্বর ঢাকার করাইল বস্তিতে লেগে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড আবারও দেখিয়ে দিল বস্তিবাসীর জীবনে নিরাপত্তা কতটা অনুপস্থিত। মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়া আগুন শত শত পরিবারকে রাতারাতি গৃহহীন করে দেয়। শুধু করাইল নয়, ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে আগুন লাগা এখন প্রায় নিয়মিত ঘটনা। প্রতিবারই আগুন মানুষ থেকে কেড়ে নেয় তাদের মৌলিক অধিকার- বেঁচে থাকার অধিকার।
এই বিপর্যয়ের পেছনে রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দায়িত্বহীন ব্যবস্থাপনার এক জটিল চক্র। বস্তিগুলো যেমন ঘনবসতিপূর্ণ, তেমনি এগুলোর অধিকাংশই দাঁড়িয়ে থাকে বাঁশ, কাঠ, টিন, পলিথিনের মতো দাহ্য উপকরণে নির্মিত জরাজীর্ণ ঘরের ওপর। একটি ঘরের সঙ্গে আরেকটি ঘরের দূরত্ব এতই কম থাকে যে শর্ট সার্কিট বা অগ্নিসংযোগ ঘটলেই তা মুহূর্তের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখায় পরিণত হয়। তার ওপর অবৈধ বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগের জট পাকানো তারগুলো যেন আগুন লাগার জন্য অপেক্ষা করেই থাকে। আর সংকীর্ণ গলিপথ হওয়ায় দমকল বাহিনী দ্রুত পৌঁছাতেও পারে না।
বস্তিগুলোর অধিকাংশই গড়ে উঠেছে রেললাইন, সরকারি খাসজমি বা জলাধারের পাশে কোনো আইনি অনুমোদন ছাড়াই। ফলে এই বসতি যেন রাষ্ট্রের দৃষ্টির আড়ালে পড়ে থাকে।
উন্নয়ন, নিরাপত্তা কিংবা স্যানিটেশন- কোনো মানসম্মত পরিকল্পনার আওতায় কখনোই এদের আনা হয়নি। অথচ এই মানুষগুলোই শহরের অর্থনীতির নেপথ্যের মূল চালিকাশক্তি। রিকশাচালক, গার্মেন্টস শ্রমিক, গৃহকর্মী, পথের দোকানি, নির্মাণশ্রমিক- তাদের ঘামেই তো সচল থাকে ঢাকার অর্থনীতির চাকা। কিন্তু সংকট দেখা দিলে তাদের জন্য থাকে শুধু ত্রাণ আর সমবেদনা! মানবিক সমাধানের কোনো বাস্তব পরিকল্পনা দেখা যায় না।
প্রতিবার অগ্নিকাণ্ডের পর গঠিত হয় তদন্ত কমিটি, বিতরণ করা হয় কিছু ত্রাণ-এর মধ্য দিয়েই যেন কাজ শেষ হয়ে যায়। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা কেউ ভাবে না। অথচ স্থায়ী সমাধান ছাড়া এই শহরকে নিরাপদ করা সম্ভব নয়। বিদ্যমান বস্তিগুলোকে উচ্ছেদ করা হলেও বিকল্প বাসস্থানের ব্যবস্থা না করে হাজার হাজার পরিবারকে গৃহহীন করে রাখা কি রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতা নয়? নগরায়ণের পরিকল্পনায় যখন বহুতল ভবন, ফ্লাইওভার, দোকানপাট, আবাসিক এলাকা উঠে আসে- তখন কি এই মানুষগুলোর জন্য কোনো স্থান রাখা হয়?
একটি মানবিক সমাজে স্থায়ী ও নিরাপদ আবাসন নিশ্চিত করা অবশ্যই রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। বস্তিবাসীদের জন্য স্বল্পমূল্যের ফ্ল্যাট, সহজ কিস্তির আবাসন প্রকল্প এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত কমিউনিটি লিভিং ব্যবস্থা চালু করা এখন সময়ের দাবি। এছাড়া বস্তির ভেতরে ফায়ার হাইড্রেন্ট, প্রশস্ত রাস্তা, নিয়মিত মনিটরিং এবং জরুরি স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাও জরুরি।
নগর পরিকল্পনা শুধু রূপসজ্জা নয়- এটি জীবনরক্ষার পরিকল্পনাও বটে। পরিকল্পনার খাতায় যদি লাখো বস্তিবাসীর নাম না থাকে, তবে সেটি কোনো সামগ্রিক উন্নয়ন হতে পারে না। তথাকথিত ‘উন্নত ঢাকা’ গড়ার স্বপ্ন যদি এই প্রান্তিক মানুষের চোখে জল এনে দেয়, তবে সেই উন্নয়ন আসলে কাদের জন্য?
এখন সময় এক প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেওয়ার- বস্তিবাসীর জীবনের ঝুঁকি কি আমাদের পরিকল্পনার খাতায় উপেক্ষিত থাকবে, নাকি আমরা একে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার সাহস করব? আজকের শহরকে নিরাপদ করতে হলে আমাদের পরিকল্পনায় এই মানুষগুলোকেও স্থান দিতে হবে। নয়তো অগ্নিকাণ্ড শুধু ঘর জ্বালাবে না- আমাদের মানবিকতার ভিত্তিকেও পুড়িয়ে ফেলবে।
শাহরিয়ার কবির রিমন
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া