প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৯ নভেম্বর, ২০২৫
শহরে ভোরের আলোয় যখন ফুটপাতের বাগানগুলো রঙিন আবেশে সাজতে থাকে, তখন মুহূর্তের জন্য মনে হয়- নগরজীবনের কোলাহলের মাঝেও প্রকৃতি তার সামান্য ছোঁয়ায় সজীব রেখেছে গোটা শহরকে। সদ্য ফোটা চন্দ্রমল্লিকা, ব্যস্ত রাস্তায় ঝুলে পেটুনিয়া, আর লাল-গোলাপি গোলাপের গুচ্ছ আর নানান রঙের বাগান বিলাস ইট-পাথরের নগরে রেখে যায় প্রকৃতির আবেশ। এই সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়ালে প্রশ্ন জাগে- ফুল এত, রং এত- তবুও সেই পরিচিত গুঞ্জন কোথায়? ফুল আছে, কিন্তু মৌমাছি নেই। আর এই অনুপস্থিতি চোখে পড়লেই বোঝা যায়- শহর শুধু সাজে, প্রাণে নয়। এই সাজে কোথাও একটি শূন্যতা চোখে পড়ে। ফুল আছে, কিন্তু নেই সেই পরিচিত গুঞ্জন, নেই মৌমাছির ক্ষুদ্র ডানা ঝাপটানোর ছন্দময় সুর। শহরের ফুল যেন দর্শকের জন্য, জীবনের জন্য নয়।
নগরীর হৃদয়ে প্রকৃতির আনাগোনায় যে বাধা দেয় তা হলো দূষণ। শহরের বাতাস গন্ধহীন , দূষণের অদ্ভুত ভার বয়ে বেড়ায়। মৌমাছি যে ফুলের গন্ধ অনুসরণ করে খাবার খুঁজে পায়, সেই গন্ধ শহরের বাতাসে আছে কি? গাড়ির ধোঁয়া, কারখানার ধাতব বাষ্প সব মিলিয়ে বাতাস এমন এক রূপ নেয়, যা মৌমাছির সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়কে বিপর্যস্ত করে। শহরের ফুল যতই হাসুক, তার সুবাস মৌমাছির কাছে পৌঁছায় না। কংক্রিটের দেয়াল শহরকে একটি জীবন্ত মরুভূমিতে পরিণত করেছে। মৌমাছিরা ফুলের পাশাপাশি আশ্রয়ও খোঁজে গাছের কোণ, ঝোপঝাড়, ফাঁকা জমি, মাটির উঁচু-নিচু তলা। কিন্তু শহরে নির্মমভাবে কেটে ফেলা হয় বুনো গাছপালা। এই শহরে প্রকৃতি শুধু ‘নান্দনিকতার’ একটি ছোট্ট অংশ, জীবনের নিশ্চয়তার নয়। মৌমাছি বাসা বাঁধার জায়গা খুঁজে না পেলে, সে ফিরে যায়? তার জন্য নিরাপদ স্থানে। তাছাড়া কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার শহরের আরেক নীরব আতঙ্ক। ফুলের বাগানগুলোকে বাঁচানোর নামে সেখানে ছিটানো হয়, এমন সব রাসায়নিক যা পোকা তো নয়ই, মৌমাছিকেও নির্বিচারে মেরে ফেলে। মৌমাছি যখন কোনো ফুলে বসে মধু পান করে, তখন সেই স্প্রের বিষ শরীরে লেগে যায় এবং ধীরে ধীরে মৃত্যু ডেকে আনে। আমাদের সাজানো ফুল বাঁচে; কিন্তু ফুলের প্রাণ, মৌমাছি নিঃশেষ হয়ে যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নগরীর তাপদাহ।
মৌমাছি অতিরিক্ত তাপ সহ্য করতে পারে না। তাদের ক্ষুদ্র ডানা দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে, শরীর শুষ্ক হয়ে যায়, দিক নির্দেশনায় ভুল হয়। আরেকটি অদ্ভুত কারণ আছে, শহরের ফুলের প্রজাতি। আমরা শহরকে সাজাই হাইব্রিড ও সৌন্দর্যনির্ভর ফুলে, যেগুলোর সুগন্ধ কম, মধু কম, পরাগও পরাগায়নের উপযোগী নয়। মৌমাছি সৌন্দর্য দেখে না দেখে খাদ্য। শহরের ফুল অনেক সময় তার জন্য পুষ্টিহীন। তাই তারা সেই ফুলের ওপর ভরসা রাখে না দূর-দূরান্তে চলে যায় বুনো ফুলের সন্ধানে।এভাবে মৌমাছি না থাকলে শহরের কী ক্ষতি? ক্ষতি শুধু একটি ছোট্ট পতঙ্গের অনুপস্থিতি নয় ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুরো নগর বাস্তুতন্ত্র। মৌমাছি প্রকৃতির চক্রে একটি অপরিহার্য সেতুবন্ধন। তারা না থাকলে ফুলের স্বাভাবিক প্রজনন বাধাগ্রস্ত হয়, ফলন কমে, গাছের জীবনচক্র ব্যাহত হয়।
তবে আশার আলোও আছে। পৃথিবীর বহু শহর এখন ‘বি-ফ্রেন্ডলি সিটি’ গড়ে তুলছে- রাস্তার ধারে দেশীয় ফুল লাগানো, কীটনাশকের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, ছাদবাগান এবং মৌমাছির জন্য ছোট ছোট কাঠের ঘর বানানো এসব শহরে মৌমাছিকে ফিরিয়ে আনছে। এ উদ্যোগগুলো প্রমাণ করে, প্রকৃতিকে দূরে সরিয়ে নয় সঙ্গে নিয়ে বাস করাই টেকসই পথ। বাংলাদেশের শহরগুলোতেও একই পথে হাঁটা জরুরি। স্কুল, বাসাবাড়ি, অফিস, পার্ক- সবখানেই দেশীয় ফুলের চাষ বাড়াতে হবে। রাসায়নিকের বদলে কম্পোস্ট ব্যবহার করতে হবে। ছাদবাগান হতে পারে নগরীর ক্ষুদ্র বনের বিকল্প। আমরা যদি নিজেরা চাই শহরের গুঞ্জন একদিন ফিরে আসবে। শহরের ফুলগুলো দর্শনে উপলব্ধি হয় ফুলের সৌন্দর্য তখনই পূর্ণতা পায়, যখন মৌমাছি এসে বসে। যখন গুঞ্জন ভরিয়ে তোলে বাতাস তখন ফুল তার রঙ-ঘ্রাণের উদ্দেশ্য খুঁজে পায়। শহর তাই ফুল থাকলেই হবে না, থাকতে হবে ফুলের সঙ্গে মৌমাছির অবাধ যাতায়াতও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার থেকে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংস্থার পরিসংখ্যান- সব জায়গাতেই এক চিত্র ফুটে উঠছে। ২০১৬ সালে University College London (UCL))-এর তদন্ত জানায় শহরের দূষিত বাতাস ফুলের সুবাসকে ৩০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত বিকৃত করে ফেলে। সুবাস কমে গেলে মৌমাছির নেভিগেশন ব্যাহত হয়। এবং ফুল খুঁজে নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। এরপর ২০২০ সালে জার্মানির UFZ Helmholtz Centre ১২৩টি শহর নিয়ে যে জরিপ করেছে, সেখানে আরেকটি কঠিন বাস্তবতা উঠে এসেছে। প্রাকৃতিক সবুজ এলাকার মাত্র ১০ শতাংশ হ্রাস পেলেই মৌমাছির সংখ্যা কমে যায় প্রায় ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের সবুজ কমলে মৌমাছির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসে তা সে এলাকায় যতই ফুল রোপণ করা হোক না কেন। পৃথিবীর খাদ্যনিরাপত্তা নিয়েও গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে FAO।
তাদের রিপোর্ট বলছে, মৌমাছির বৈশ্বিক মৃত্যুর ৩৭ শতাংশ কারণ হচ্ছে নিয়োনিকোটিনয়েড নামের এক ধরনের কীটনাশক, যা শহর এবং গ্রাম- উভয় অঞ্চলে ব্যবহৃত হয়। ফলে ফুলে বসতে গেলেই মৌমাছির দেহে এই রাসায়নিক প্রবেশ করে, দুর্বল করে তোলে তাদের সমগ্র উপনিবেশকে। মৌমাছি কমলে ফল, শাকসবজি ও খাদ্য উৎপাদন সরাসরি হুমকির মুখে পড়ে। ২০১৯ সালে Harvard School of Public Health জানায়, তাপমাত্রা 35°C ছাড়ালেই মৌমাছির উড়ার ক্ষমতা অর্ধেকে নেমে আসে। দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলোর গ্রীষ্মে যে তাপমাত্রা থাকে সেখানে মৌমাছির উড়তে না পারা বা পথ ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। এই কারণেই গরমের কালেই শহরে মৌমাছির সংখ্যা আরও কমে যায়। পৃথিবীর খাদ্য সরবরাহের ওপর মৌমাছির কতটা প্রভাব- সেটিও স্পষ্ট করেছে UNEP। তাদের পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের ৭৫ শতাংশ খাদ্যফসল পরাগায়নের ওপর নির্ভরশীল, যার মূল চালিকাশক্তি মৌমাছি। মৌমাছি না থাকলে খাদ্যের বৈচিত্র্য, ফলন এবং বাজারের স্থিতিশীলতা- সবই বিপর্যস্ত হবে।
প্রকৃতি আর জীবন সমান তালে চলুক। হয়তো একদিন শহরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমরা আবার সেই কোমল গুঞ্জন শুনব। কিন্তু সব জরিপই হতাশাজনক নয়। ২০১৯ সালে Netherlands National Pollinator Survey দেখিয়েছে আশা। সেখানে সরকার মাত্র দুই বছরে দুই লাখের বেশি ‘Bee Hotel’ স্থাপন করে এবং দেশীয় ফুল লাগানোর জাতীয় কর্মসূচি চালায়। ফলাফল হিসেবে মৌমাছির সংখ্যা বেড়ে যায় ৫০ শতাংশ।
উম্মে সালমা রহমান কাশফিয়া
শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ