প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ৩০ নভেম্বর, ২০২৫
‘মানবাধিকার’ একটি শব্দ, যার ভেতরে ন্যায়, স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং নিরাপত্তার সর্বজনীন আকাঙ্ক্ষা লুকিয়ে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ যখন মানবাধিকার সনদ ঘোষণা করে, তখন বিশ্ববাসী বিশ্বাস করেছিল যে এক নতুন যুগের সূচনা হলো, যে যুগে রাষ্ট্রগুলো আর নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করতে পারবে না, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে, দুর্বল জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু আজ, একবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাই মানবাধিকার রক্ষা করার সেই সুউচ্চ নীতির আড়ালে জন্ম নিয়েছে নতুন এক প্রবণতা, নতুন এক বৈশ্বিক কৌশল- ‘মানবাধিকারের নামে হস্তক্ষেপ’, যা আধুনিক ঔপনিবেশিকতার এক মোড়কবদ্ধ সংস্করণ ছাড়া আর কিছুই নয়।
বিশ্বায়নের যুগে মানবাধিকার সংক্রান্ত আলোচনার ব্যাপ্তি বেড়েছে বহুগুণ। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলসহ নানা সংস্থা এবং রাষ্ট্র তাদের নিজ নিজ রিপোর্ট ও বিবৃতির মাধ্যমে বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই আলোচনার ভেতরে কি সর্বদা নিরপেক্ষতা থাকে? নাকি শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর ভূরাজনৈতিক স্বার্থের ভিত্তিতেই মানবাধিকারকে ব্যবহার করা হয় কৌশলগত একটি অস্ত্র হিসেবে?
শীতল যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা জোট নিজেদেরকে বিশ্বমানবাধিকারের অভিভাবক হিসেবে উপস্থাপন করতে শুরু করে। ‘Responsibility to Protect’ বা জ২চ নীতি এই ধারণাকে আন্তর্জাতিক আইনের ভাষায় বৈধতা দেয়। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এই নীতি গৃহীত হয়, যার মূল কথা যদি কোনো রাষ্ট্র তার নাগরিকদের গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ বা জাতিগত নিধন থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সামরিক হস্তক্ষেপসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে। নীতির ভাষা মহৎ হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ হয়েছে নির্বাচিতভাবে, যেখানে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ জড়িত ছিল সেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ জোরালো হয়েছে, আর যেখানে তাদের বন্ধুপ্রতিম সরকারগুলো একই ধরনের লঙ্ঘন করেছে, সেখানে কৌশলগত নীরবতা বজায় রাখা হয়েছে। ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধ মানবাধিকারের নামে হস্তক্ষেপের সবচেয়ে সুস্পষ্ট উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছিল সাদ্দাম হোসেন গণবিধ্বংসী অস্ত্র বানাচ্ছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। পরে স্বয়ং মার্কিন তদন্তেই প্রমাণিত হয় ইরাকে এমন অস্ত্র ছিল না। মানবিক সংকট নিরসনের নামে শুরু হওয়া যুদ্ধ ইরাককে পরিণত করল একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে।
আরিফুল ইসলাম রাফি
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ