ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলোপ দিবসে মুক্তির আহ্বান

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলোপ দিবসে মুক্তির আহ্বান

মানবসভ্যতার ইতিহাসে যত অন্ধকার, নির্মম ও লজ্জাজনক অধ্যায় আছে, দাসত্ব তার মধ্যে সবচেয়ে গভীর। সভ্যতার বয়স বাড়ল, প্রযুক্তি বদলাল, পৃথিবী আজ চাঁদ-মঙ্গল পর্যন্ত পৌঁছেছে- তবু মানুষকে মানুষ দুর্বল করে শোষণের প্রবণতা আজও অব্যাহত। প্রতি বছর ২ ডিসেম্বর যখন বিশ্ব ‘আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলোপ দিবস’ পালন করে, তখন এই সত্যটাই নতুন করে মনে করিয়ে দেয়- দাসত্বের গল্প ইতিহাসেরই অংশ নয়, বরং এর ছায়া এখনও আমাদের সমাজে অদৃশ্যভাবে বিদ্যমান।

প্রাচীন সভ্যতা থেকে আধুনিক পৃথিবী : দাসত্বের দীর্ঘ পথচলা। মানুষের ক্ষমতা ও দুর্বলতার সংঘাত শুরু যত পুরোনো, দাসত্বের শিকড়ও তত গভীর। মিশর, ব্যাবিলন, গ্রিস, রোম, যে সভ্যতাই ধরা হোক, তাদের আড়ালে লুকিয়ে ছিল দাসপ্রথার কঠিন বাস্তবতা।

যুদ্ধবন্দি, ঋণী বা নির্দিষ্ট বর্ণের মানুষকে তখন সম্পত্তির মতো কেনা-বেচা করা হতো। রোমান সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি যে দাসদের কাঁধের ওপর দাঁড়ানো ছিল, ইতিহাস আজও সেই সত্যের সাক্ষী।

মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সাম্রাজ্যেও দাসত্ব ছিল নিত্যদিনের বাস্তবতা। সৌদি আরব, ইরান, ওমান- এই অঞ্চলে যুদ্ধ, প্রতারণা বা ঋণ চাপিয়ে মানুষকে বাধ্য করে দাস হিসেবে রাখা হতো। প্রাচীন চীনে রাজবংশের ধনীরাও দাস ব্যবহার করত কৃষি ও নির্মাণ কাজে। এমনকি ভারতেও ব্রাহ্মণ, কুলীন বর্ণের শোষণের প্রথা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। এই যে সভ্যতার আড়ালে মানবতার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে, তা প্রমাণ করে- দাসত্ব কোনো সংস্কৃতির অনন্য বৈশিষ্ট্য নয়, বরং এটি মানব প্রকৃতির অন্ধরূপের অংশ।

বাণিজ্যের নামে মানুষ বিক্রি : মধ্যযুগের ভয়াবহতা। মধ্যযুগে দাসত্ব নিপীড়নই নয়, এটি বাণিজ্যের মাধ্যম হয়ে ওঠে। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে হানাদাররা সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে যেত, বাজারে বিক্রি করত। বহু জনপদ জনহীন হয়ে যেত। স্বার্থ ও লোভের এই বাণিজ্য মানবতার প্রতি এক ভয়াবহ আঘাত।

ইউরোপের সমৃদ্ধি, প্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্য- সবের পেছনে লুকিয়ে ছিল অসংখ্য দাসের শ্রম। কেউ জানত না, প্রতিটি বিলাসবহুল পণ্য, প্রতিটি সমৃদ্ধ নগরীর পেছনে লুকিয়ে আছে নিঃশব্দে ঝরে যাওয়া জীবন। মধ্যযুগে যে রূপে মানুষকে সম্পত্তি হিসেবে দেখা হতো, তার শিক্ষা আজও আমাদের বিবেককে সরিয়ে দেয়নি।

আটলান্টিক দাসবাণিজ্য : মানবতার সবচেয়ে অন্ধকার রাত। ১৬০০ থেকে ১৯০০ শতক- এই কয়েক শতাব্দী মানব জাতির বিবেককে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আফ্রিকা থেকে লাখ লাখ মানুষকে ধরে জাহাজে করে আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে পাঠানো হতো। যাত্রাপথের নিষ্ঠুরতা, গায়ে গুঁজে রাখা মানুষ, ক্ষুধা, রোগ- সব মিলিয়ে অসংখ্য জীবন নদীর মতো ঝরে যেত। যারা বেঁচে যেত, তারা সারাজীবন অন্যের সম্পত্তি হিসেবে দিন কাটাত। ইউরোপের শিল্প বিপ্লব, উপনিবেশিক সমৃদ্ধি- এসবের পেছনে অসংখ্য অশ্রু, রক্ত এবং কণ্ঠরোধ করা চিৎকার লুকিয়ে ছিল।

এই সময়ে দাসত্ব শুধু শ্রমিক শোষণ নয়, এটি একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের বাহন ছিল। দাসদের কোনো আইনগত অধিকার ছিল না; তারা পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থাকত, শিক্ষা ও মৌলিক মানবিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ইতিহাসের এই অধ্যায় আমাদের শেখায়- দাসত্ব শুধু শারীরিক শৃঙ্খল নয়, বরং এটি মানবতার সঙ্গে মানসিক ও সামাজিক নিপীড়নেরও প্রতীক।

বিলোপ আন্দোলন : মানবতার আলো জ্বলার শুরু। ১৮-১৯ শতকে ধর্মীয় মূল্যবোধ, মানবাধিকার ধারণা এবং নৈতিক চেতনার উত্থানে দাসত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। ব্রিটেন দাসবাণিজ্য নিষিদ্ধ করে ১৮০৭ সালে, যুক্তরাষ্ট্র দাসপ্রথা বিলোপ করে ১৮৬৫ সালে। মনে হয়েছিল- মানবতা জয়ী হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা অন্য কথা বলল। দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙল বটে; কিন্তু শোষণের রূপ পাল্টে গেল। নতুন সমাজে শ্রমের শোষণ, বর্ণগত বৈষম্য ও অর্থনৈতিক জুলুম এখনও লুকিয়ে ছিল।

বিলোপ আন্দোলন দেখায়- মানবতার জয় কখনও এক মুহূর্তে আসে না। এটি দীর্ঘ লড়াই, সহিংসতার ইতিহাসকে পেছনে ফেলে, মানবতার নৈতিক জাগরণকে শক্তি দেয়। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো- দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়াই শুধুমাত্র আইন দিয়ে সমাধান হয় না; এটি প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা, নৈতিক দায়িত্ব ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার।

আধুনিক দাসত্ব : অদৃশ্য কিন্তু সবচেয়ে বিপজ্জনক, আজকের পৃথিবীতে শিকল দেখা যায় না, কিন্তু মানুষ বন্দি হয় প্রতারণা, দারিদ্র্য, ভয় এবং অপরাধচক্রের জালে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে এখনও প্রায় ৫ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে আধুনিক দাসত্বে আছে। মানবপাচার, জোরপূর্বক শ্রম, শিশুশ্রম, জোর করে বিয়ে দেওয়া, যৌনশিল্পে শোষণ- এগুলোই দাসত্বের নতুন চেহারা।

বিশেষভাবে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি শিকার। তাদের ওপর নির্যাতন, পাচার, শোষণ- সবই আজকের বাস্তবতা। শুধু নাম পাল্টেছে, পদ্ধতি পাল্টেছে। আধুনিক প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক বৈষম্য এই নতুন দাসত্বকে আরও জটিল এবং দেখানো অদৃশ্য করে তুলেছে।

মানবপাচার : বিশ্বের দ্রুতবর্ধনশীল অপরাধচক্র, মানবপাচারের নেটওয়ার্ক এখন বহুজাতিক অপরাধশিল্পে পরিণত হয়েছে। চাকরির লোভ দেখিয়ে, বিদেশ পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে, কিংবা জোর-জবরদস্তি করে মানুষকে ফাঁদে ফেলা হয়। কেউ বুঝেই ওঠে না- তার স্বাধীনতা ঠিক কোন মুহূর্তে হাতছাড়া হলো।

বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতিসংঘ এই সমস্যার বিরুদ্ধে নিয়মিত সতর্কতা জারি করে। তবে অপরাধীরা প্রায়ই সীমান্ত ও আইনশৃঙ্খলা ফাঁকফোকর ব্যবহার করে মানুষকে শোষণ করে। মানবপাচারের এই আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক প্রতিটি দেশকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানায়।

বাংলাদেশের বাস্তবতার আয়না : আমাদের দেশে মানবপাচার ও শ্রমশোষণ এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখানো হয়, কিন্তু অনেকেই প্রতারণার শিকার হন। ইটভাটা, কৃষি, ঘরোয়া শ্রম—সবখানেই মাঝে মাঝে শোষণের খবর পাওয়া যায়। শিশুশ্রম সারাদেশে বিদ্যমান। সরকারের আইন আছে, উদ্যোগও আছে; কিন্তু প্রয়োগই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

গ্রামীণ ও শহরে এলাকায় নারী ও শিশুদের প্রতি নির্যাতন ও যৌন শোষণ এখনও উদ্বেগজনক। অর্থনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষার অভাব ও সামাজিক সচেতনতার ঘাটতি এই চক্রকে আরও শক্তিশালী করে। তাই বাংলাদেশে দাসত্বমুক্ত সমাজ গঠন একটি যৌথ ও বহুমুখী প্রচেষ্টা দাবি করে।

কেন এই দিবস আজও জরুরি : দাসত্ব শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়- এটি সমাজকে ভেঙে দেয়, বৈষম্য বাড়ায়, অপরাধচক্রকে শক্তিশালী করে। তাই ২ ডিসেম্বর শুধু একদিনের আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি একটি নৈতিক ডাক- মানবমুক্তির লড়াই এখনও শেষ হয়নি।

আমাদের করণীয় : শিশুদের বিদ্যালয়ে রাখা এবং শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করা। নারীর ক্ষমতায়ন, সুরক্ষা ও আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। সন্দেহজনক পরিস্থিতি দেখলে দ্রুত কর্তৃপক্ষকে জানানো। শ্রম শোষণমুক্ত ব্যবসা ও উদ্যোগ সমর্থন করা। এসব ছোট উদ্যোগ বৃহৎ পরিবর্তনের পথ তৈরি করে।

পরিশেষে বলতে চাই, একটি দাসত্বমুক্ত পৃথিবী কল্পনা নয়- এটি সম্ভব, যদি মানুষ মানবতার পাশে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলোপ দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়- যতদিন পৃথিবীর শেষ মানুষটিও স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস নিতে না পারে, ততদিন দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়াই থামানো যাবে না। মানবতার বিজয় একদিন নিশ্চিত- শুধু প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা, সাহস এবং অঙ্গীকার।

মানবতার প্রতি আমাদের নৈতিক দায়বদ্ধতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই লড়াই অসম্পূর্ণ থাকবে। মানবমুক্তির এই সংগ্রাম শুধু আইন বা নীতি নয়, এটি একটি সামাজিক আন্দোলন, যা আমাদের প্রত্যেকের অবদান ও সচেতনতার ওপর নির্ভরশীল।

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

কলাম লেখক ও গবেষক

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত