ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বিষাক্ত নিঃশ্বাসে বিপন্ন শৈশব

জান্নাতুল ফেরদৌস জেরিন
বিষাক্ত নিঃশ্বাসে বিপন্ন শৈশব

বিশ্বজুড়ে আজ বায়ুদূষণ এক মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা নীরবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম- শিশুদের জীবন ও স্বাস্থ্যকে এক চরম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে; বিশেষত ঘনবসতিপূর্ণ এবং দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে এমন দেশগুলোতে, যেমন বাংলাদেশে, বাতাসের গুণগত মান বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্যমতে, প্রতি বছর বিশ্বে অসংখ্য শিশু বায়ুদূষণজনিত কারণে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে এবং দূষিত বাতাসে থাকা ক্ষতিকর সূক্ষ্ম কণা (PM 2.5, PM 10), কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড এবং অন্যান্য বিষাক্ত গ্যাস শিশুদের অপরিণত শরীর ও মস্তিষ্কের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে, তাই এই প্রতিবেদনটি শিশুদের ওপর বায়ুদূষণের ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং এর মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপের গুরুত্ব তুলে ধরার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে, কারণ আমাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য নির্মল বাতাসের অধিকার নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

শিশুদের ফুসফুস প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় দ্রুত বিকশিত হতে থাকে এবং তারা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে বেশি পরিমাণে বায়ু গ্রহণ করে, ফলস্বরূপ, দূষিত বায়ুর ক্ষতিকর কণাগুলো সহজেই তাদের শ্বাসনালী ও ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা তৈরি করে; দূষণের কারণে শিশুরা প্রায়শই নিউমোনিয়া, ব্রংকিওলাইটিস এবং তীব্র শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ (Acute Respiratory Infections-ARI)-এর মতো রোগে ভোগে, যা তাদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ও উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন সৃষ্টি করে, আর এই তাৎক্ষণিক রোগগুলো ছাড়াও দীর্ঘ সময় দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে থাকার ফলে অ্যাজমা (হাঁপানি), দীর্ঘস্থায়ী কাশি এবং ব্রংকাইটিস-এর মতো দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসজনিত রোগ দেখা দিতে পারে, যা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও বাড়তে পারে এবং স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে, যেখানে ফুসফুসে থাকা সারফেকট্যান্ট নামক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তরল পদার্থ, যা ফুসফুসের অংশগুলোকে সংকুচিত হতে বাধা দেয়, তা দূষিত বায়ু দ্বারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যার ফলস্বরূপ শিশুদের শ্বাসকষ্ট তীব্র হয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের কার্যকারিতা কমে যায়, এবং ডব্লিউএইচও-এর তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণজনিত শ্বাসকষ্ট এবং ফুসফুসের সংক্রমণের কারণে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে এটি চিহ্নিত হয়েছে, যা এই সমস্যাটির ভয়াবহতাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।

বায়ু দূষণ শুধু শ্বাসযন্ত্রের রোগই সৃষ্টি করে না, এটি শিশুদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশেও মারাত্মকভাবে বাধা দেয়, যা তাদের ভবিষ্যত জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে, কেননা দূষিত বাতাসে থাকা ভারী ধাতু (যেমন সীসা, পারদ, আর্সেনিক) এবং অন্যান্য নিউরোটক্সিক বিষাক্ত পদার্থ রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্রবেশ করে এবং সহজেই রক্ত-মস্তিষ্ক প্রতিবন্ধক (Blood-Brain Barrier) অতিক্রম করতে পারে; এই বিষাক্ত উপাদানগুলো মস্তিষ্কের কোষের বৃদ্ধি ও স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্রমে সরাসরি বাধা সৃষ্টি করে, বিশেষ করে প্রারম্ভিক শৈশবকালে যখন মস্তিষ্কের দ্রুত বিকাশ ঘটে, যা জ্ঞানীয় বিকাশে গুরুতর ঘাটতির সৃষ্টি করে; এর ফলে শিশুদের শেখার ক্ষমতা, মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি এবং সামগ্রিক মানসিক বিকাশে ঘাটতি দেখা যায় এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে উচ্চ দূষণের শিকার হওয়া শিশুরা তুলনামূলকভাবে পরীক্ষায় কম স্কোর করে এবং তাদের মৌখিক ও গণিত দক্ষতা হ্রাস পায়, যা তাদের শিক্ষাজীবনে পিছিয়ে দেয়; এছাড়াও, বায়ুদূষণ শিশুদের মধ্যে আচরণগত সমস্যা যেমন অস্থিরতা, ঘুম কম হওয়া, খিটখিটে স্বভাব এবং ADHD (মনোযোগের ঘাটতি ও অতিসক্রিয়তা ব্যাধি) বা উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতার মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়াতে পারে এবং এমনকি মায়ের গর্ভে থাকা শিশুরও মস্তিষ্কের বিকাশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে, যখন মা দূষিত পরিবেশে শ্বাস নেন, কারণ দূষক কণাগুলো প্লাসেন্টা পেরিয়ে ভ্রুণের সংবেদনশীল মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়।

শিশুদের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব তাদের জন্মেরও আগে থেকে শুরু হতে পারে এবং গর্ভকালীন সময়ে এর ঝুঁকি সর্বাধিক থাকে; গর্ভবতী মায়েরা দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে থাকলে গর্ভস্থ শিশুর জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি হয়, যার মধ্যে নবজাতকের কম ওজন নিয়ে জন্ম (Lwo Birth Weight), অকাল (প্রিম্যাচিউর) জন্ম এবং এমনকি জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়; কম ওজনের শিশু এবং অকাল জন্ম নেওয়া শিশুরা পরবর্তী জীবনে নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত জটিলতা, যেমন ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের ঝুঁকিতে থাকে এবং এই জটিলতাগুলো শিশুর ভবিষ্যৎ শারীরিক বিকাশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে; অন্যদিকে, দীর্ঘস্থায়ী দূষিত পরিবেশে থাকার কারণে শিশুদের শরীরের প্রাকৃতিক রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেম) দুর্বল হয়ে পড়ে, যার ফলে তারা সহজেই সর্দি-কাশি, ফ্লু এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগে বারবার আক্রান্ত হয়, যা ঘন ঘন বিদ্যালয় অনুপস্থিতি এবং শারীরিক দুর্বলতার কারণ হয়; ফুসফুস ছাড়াও, বায়ুদূষণ হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এবং শিশুদের কার্ডিওভাসকুলার সমস্যা, চোখ, ত্বক, কিডনি এবং প্রাপ্তবয়স্ক হলে প্রজননক্ষমতা ব্যাহত করতে পারে, যার ফলে শিশুদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যঝুঁকির মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়।

বাংলাদেশে বায়ুদূষণের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে পুরোনো ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া, যা শহরের রাজপথগুলোতে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত করে, অবৈধ ইটভাটা ও শিল্পকারখানার অনিয়ন্ত্রিত নির্গমন, যা বায়ুতে সূক্ষ্ম কণার মাত্রা বাড়িয়ে তোলে, নির্মাণকাজের ধুলাবালি, বিশেষত বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য পোড়ানো, যা পরিবেশে ডাই-অক্সিনের মতো মারাত্মক বিষাক্ত উপাদান ছড়িয়ে দেয়; অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং অসহনীয় যানজট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে; সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজধানী ঢাকার বাতাসের গুণগত মান বিশ্বের অন্যতম খারাপের তালিকায় স্থান পেয়েছে, যেখানে সূক্ষ্ম কণা PM 2.5 -এর ঘনত্ব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত নিরাপদ সীমার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি থাকে, যা জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে; শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে সরকারকে এবং নাগরিকদের যৌথভাবে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া অত্যাবশ্যক।

নীতিগতভাবে যানবাহনের কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন, পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করা, ইটভাটা ও শিল্পকারখানার নির্গমন কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা উচিত; শহরের পরিকল্পনায় নির্মাণকাজের সময় ধুলোবালি নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর বিধিমালা প্রয়োগ করা এবং ব্যাপক সবুজায়ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া উচিত, যেখানে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে বায়ুর গুণগত মান সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য প্রচার করা এবং অভিভাবকদের সচেতন করে তোলা জরুরি; ব্যক্তিগত পর্যায়ে উচ্চ দূষণের সময়ে শিশুদের বাইরে যাওয়া সীমিত করা এবং প্রয়োজনে উচ্চমানের মাস্ক ব্যবহারের অভ্যাস তৈরি করা এবং বায়ুদূষণজনিত রোগের প্রাথমিক শনাক্তকরণ ও উন্নত চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নতি করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব, কারণ শিশুদের নির্মল বাতাসে শ্বাস নেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব এবং এই নীরব ঘাতক থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া অপরিহার্য।

জান্নাতুল ফেরদৌস জেরিন

শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত