ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

রেমিট্যান্স যোদ্ধার কান্না বিমানবন্দরে লাগেজ কাটা এ কেমন জাতীয় সংস্কৃতি

ওসমান গনি
রেমিট্যান্স যোদ্ধার কান্না বিমানবন্দরে লাগেজ কাটা এ কেমন জাতীয় সংস্কৃতি

বিমানবন্দরে প্রবাসীদের লাগেজ কেটে তাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র চুরি বা ক্ষতি করার মতো অমানবিক ঘটনাটি যখন বারংবার বিভিন্ন মিডিয়ায় শিরোনাম হয়, তখন তা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ হিসেবে গণ্য করার সুযোগ থাকে না। এই নিচুতা ও হীনতা সমাজের এক গভীর ক্ষতকে উন্মোচন করে, যার পেছনে লুকিয়ে আছে এক অসুস্থতা, যা কার্যত একটি বিশেষ অংশের মধ্যে প্রায় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, স্বার্থপরতা, অন্যের প্রতি চরম অবহেলা এবং দায়িত্বহীনতার এক বিষাক্ত সংমিশ্রণ। যারা নিজ দেশ, পরিবার ও প্রিয়জনদের ছেড়ে সুদূর বিদেশে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কঠোর পরিশ্রমে নিজেদের জীবন ও দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেন, দেশে ফিরে আসার পর তাদের সঙ্গে এই ধরনের অপ্রত্যাশিত ও ন্যক্কারজনক আচরণ এক জাতীয় লজ্জা এবং চরম কৃতজ্ঞতার পরিচায়ক। আমাদের প্রবাসীরা দেশের মাটির স্পর্শ পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করেন, আর সেই অপেক্ষার ফলস্বরূপ তাদের বরণ করে নিতে হয় এক অনাকাঙ্ক্ষিত তিক্ততা, যা তাদের মনকে বিষিয়ে তোলে।

আমাদের দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের ভূমিকা অপরিসীম এবং অনস্বীকার্য। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস, যা আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে। এই মানুষগুলো শুধু অর্থই পাঠান না, সঙ্গে নিয়ে আসেন হাজারও স্বপ্ন, পরিবারের জন্য সামান্য উপহার, আর বিদেশ বিভুঁইয়ে কাটানো সীমাহীন কষ্টের প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি লাগেজ বা ট্রাঙ্ক শুধু জিনিসপত্রের ধারক নয়, এটি তাদের কঠোর শ্রম, ত্যাগের মানসিকতা এবং ভালোবাসার প্রতীক। তারা যে সামান্য কিছু জিনিস নিয়ে আসেন, তার প্রায় প্রতিটি পণ্যের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে একটি আবেগপূর্ণ গল্প, পরিবারের প্রতি গভীর মমতা এবং মাসের পর মাস ধরে সঞ্চয়ের হিসাব। বছরের পর বছর প্রবাসে থেকে যে মানুষটি তিল তিল করে সঞ্চয় করে, দেশে ফেরার পথে তার সেই সঞ্চিত ভালোবাসা, সেই কষ্টের ফসল যদি কতিপয় দুর্নীতিবাজ ও অসাধু কর্মচারীর লোভে খোয়া যায়, তবে এর চেয়ে বড় হতাশা আর কী হতে পারে? দেশের মাটির স্পর্শ পাওয়ার আগেই যদি জন্মভূমি তাকে এই অপ্রিয় অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করে, তবে দেশের প্রতি তাদের যে ভালোবাসা ও আস্থা, তাতে চির ধরে, যা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বরং একটি মানসিক আঘাত এবং গভীর বঞ্চনার অনুভূতি সৃষ্টি করে।

লাগেজ কাটার ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্নতা নয়, বরং এক সুসংগঠিত চক্রের অপকর্মের ফল হিসেবেই দৃশ্যমান হয়। যদিও সাম্প্রতিক কিছু তথ্য থেকে জানা যায় যে, কিছু ঘটনা হয়তো বহিঃস্থ বিমানবন্দর বা সেখানকার বিশেষ আইনি প্রক্রিয়ার কারণেও ঘটছে, তবে দেশের অভ্যন্তরে এই ধরনের ঘটনার অভিযোগ যখন ওঠে, তখন তা বিমানবন্দরের ভেতরের বিভিন্ন স্তরে কাজ করা অসাধু হ্যান্ডলিং কর্মী, নিরাপত্তা কর্মী বা অন্য কর্মচারীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার দিকেই আঙুল তোলে। এই চক্রটি জানে কখন, কোথায় এবং কীভাবে লাগেজ থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র সরিয়ে নেওয়া যায়। তাদের এই কর্মকাণ্ডে পদ্ধতিগত দুর্বলতা এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাব স্পষ্ট। একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো উচ্চ নিরাপত্তা জোনে যদি নিয়মিতভাবে এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সুযোগ থাকে, তবে তা কেবল স্থানীয় কর্মচারীদের দুর্নীতি নয়, বরং পুরো ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতাকেই নির্দেশ করে। প্রবাসীরা প্রায়শই বিমানবন্দরে নেমে বাড়তি হয়রানি, শুল্ক বিভাগের বাড়াবাড়ি এবং অসাধু কর্মচারীদের মুখাপেক্ষী হন। লাগেজ কাটা সেই হয়রানিরই এক চূড়ান্ত ও অমানবিক রূপ। এই ধরনের অপরাধ দেশের ভাবমূর্তিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যখন প্রবাসীরা বিদেশে তাদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন, তখন দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এটি একটি দেশের জন্য চরম বিব্রতকর পরিস্থিতি।

এই ঘটনাটিকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক অপরাধ হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এর পেছনে রয়েছে আমাদের সমাজের নৈতিকতার চরম অধঃপতন এবং অন্যের প্রতি সহানুভূতির অভাব। যে মানুষটি দেশকে সমৃদ্ধ করছে, তার প্রতি এই ধরনের আক্রমণ এক ধরনের সামাজিক কৃতজ্ঞতা। প্রবাসীরা দেশের উন্নয়নে এত বড় ভূমিকা পালন করার পরেও যখন তাদের প্রতি পদে পদে অপমান, হয়রানি এবং চুরির শিকার হতে হয়, তখন এই সমাজে মূল্যবোধের অবশিষ্ট কী থাকে? যখন একটি দেশের সরকারি সেবার সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা নিজেদের নৈতিক দায়িত্ব ভুলে গিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য দেশের অর্থনৈতিক চালকদের প্রতি এমন আচরণ করে, তখন বুঝতে হবে সামাজিক মূল্যবোধের ভিত্তি নড়ে গেছে। এই সংস্কৃতি হলো ‘যা পেয়েছি, তা-ই আমার’, এই হীন, পরজীবী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। এই মানসিকতা দেখায় যে কিছু মানুষ কীভাবে চোখের সামনে দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ত্যাগকে উপেক্ষা করে কেবল নিজের স্বল্পমেয়াদি লোভ চরিতার্থ করতে সচেষ্ট। এটি এক ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহার, যেখানে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও অসহায় প্রবাসীদের হয়রানি করা হয়, কারণ তারা জানেন যে হয়তো প্রতিবাদ করলেও বিশেষ লাভ হবে না।

এই অশুভ সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে হলে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য। কেবল দায়সারা তদন্ত নয়, এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার সামান্যতম প্রমাণ পেলেও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিমানবন্দরে কর্মরত প্রতিটি কর্মচারীকে কঠোর নজরদারির মধ্যে আনতে হবে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবিলম্বে চাকরিচ্যুতিসহ ফৌজদারি মামলা দায়ের করার একটি জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। এই শাস্তি এমন হতে হবে, যা অন্য কর্মচারীদের মনে ভীতি সঞ্চার করবে। লাগেজ হ্যান্ডলিং এলাকাগুলোতে উচ্চ রেজ্যুলেশনের সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও সেগুলোর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা আবশ্যক। এই ক্যামেরার ফুটেজ শুধুমাত্র তদন্তের জন্য নয়, বরং সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের জন্য ব্যবহার করতে হবে। এর পাশাপাশি লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ের প্রতিটি ধাপে কর্মীদের সুস্পষ্ট দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ক্ষতি বা চুরির ঘটনা ঘটলে সেই নির্দিষ্ট এলাকার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের শাস্তির আওতায় আনা যায়। একটি সিস্টেম তৈরি করতে হবে যেখানে প্রতিটি লাগেজের রুট ম্যাপ এবং হ্যান্ডলিংয়ের সময়কাল ট্র্যাক করা সম্ভব হয়। একইসঙ্গে, কর্মীদের মধ্যে নৈতিকতার শিক্ষা এবং প্রবাসীদের প্রতি সম্মান দেখানোর মানসিকতা তৈরি করতে কার্যকর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা বুঝতে পারে এই লাগেজগুলো শুধু পণ্য নয়, এগুলো একটি পরিবারের আশা ও দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। কর্তৃপক্ষের উচিত প্রবাসীদের জন্য অভিযোগ জানানোর একটি দ্রুত ও সহজ পদ্ধতি চালু করা এবং সেই অভিযোগের ভিত্তিতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া।

বিমানবন্দরে প্রবাসীদের লাগেজ কাটার ঘটনা কোনো সুস্থ সমাজের বা সভ্য দেশের সংস্কৃতি হতে পারে না। এটি একটি অসুস্থ মানসিকতা, যা আমাদের জাতীয় অগ্রগতি ও ভাবমূর্তির পথে বাধা সৃষ্টি করছে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই এই ‘লাগেজ কাটা সংস্কৃতিকে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলতে হবে। প্রবাসীরা যেন বিমানবন্দরে নেমে স্বস্তি ও সম্মান অনুভব করতে পারেন, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রতিটি নাগরিকের এবং রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব। কারণ, প্রবাসীদের কান্না বা হতাশা আমাদের অর্থনীতির জন্য শুভকর নয়, বরং এই অপমান পুরো জাতির জন্য এক গভীর লজ্জার দাগ। সময় এসেছে, নিজেদের হীন স্বার্থ ভুলে দেশের সেবায় নিবেদিত এই মানুষগুলোর প্রতি ন্যায় ও সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে একটি সভ্য, দায়িত্বশীল ও কৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করার।

এইভাবে বিশ্লেষণ করে দেখলে, বিমানবন্দরে প্রবাসীদের লাগেজ কাটা বা চুরি করার ঘটনাটি কেবল একটি আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়, বরং এটি আমাদের সামাজিক ও নৈতিক কাঠামোর গুরুতর দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়। প্রবাসীরা, যারা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, তাদের প্রতি এমন অকৃতজ্ঞতা ও অমানবিক আচরণ একটি জাতি হিসেবে আমাদের সামগ্রিক নৈতিকতার অবনতিকে নির্দেশ করে। এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পেছনে থাকা চক্রের উৎখাত এবং জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই কঠোর জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে, যেখানে প্রযুক্তিগত নজরদারি ও প্রতিটি স্তরে কর্মীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়। প্রবাসীদের লাগেজ শুধু পণ্য নয়, এটি তাদের শ্রম, স্বপ্ন আর ভালোবাসার প্রতীক। তাই, এই ‘লাগেজ কাটা সংস্কৃতিকে চিরতরে নির্মূল করে প্রবাসীদের জন্য বিমানবন্দরে সম্মান ও স্বস্তির পরিবেশ নিশ্চিত করাই হোক আমাদের জাতীয় কর্তব্য, যা দেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সভ্যতার পরিচায়ক।

ওসমান গনি

সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত