ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে নিয়ে সমাজ গড়ি

ড. মো. আনোয়ার হোসেন
প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে নিয়ে সমাজ গড়ি

রাত তখন গভীর। ঢাকার এক সরু গলির ছোট ঘরে শুয়ে রফিক তার অন্ধত্বের অন্ধকার জগতটাকে অনুভব করছিল। বাইরের ব্যস্ত দুনিয়ার শব্দ তার কানে আসলেও সে জগতের ছবি তার চোখে ধরা দিত না। রফিকের বয়স ৩০ ছুঁই ছুঁই, কিন্তু এই বয়সেই জীবনের সবরকম কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। জন্ম থেকেই দৃষ্টিহীন সে।

রফিকের শৈশব কেটেছে চরম দারিদ্র্য ও অবহেলায়। বাবা-মা দুজনেই অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতেন। প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। সমাজের মানুষের সহানুভূতি আর করুণা মেশানো দৃষ্টি রফিকের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। সে বুঝত, তার জীবনটা অন্যদের চেয়ে আলাদা, অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।

কিন্তু রফিক হার মানেনি। তার ভেতরে ছিল অদম্য জেদ। বাবার পুরোনো একটা ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শুনে শুনে সে হারমোনিয়াম বাজানো শিখেছিল। সুরের জগতটাই ছিল তার আনন্দ আর সান্ত¡নার আশ্রয়।

এক শীতের সকালে, এক বৃদ্ধ সঙ্গীত শিক্ষক রফিকের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকে তার স্কুলে ভর্তি করিয়ে নিলেন। সেই স্কুল ছিল প্রতিবন্ধীদের জন্য এক আলোর দিশারী। সেখানে রফিকের মতো আরও অনেকে ছিল, যারা দৃষ্টি, শ্রবণ বা শারীরিক কোনো না কোনো প্রতিবন্ধকতা নিয়ে লড়ছিল। তাদের দুঃখ, দুর্দশাগুলো প্রায় একইরকম হলেও, তাদের ভেতরের প্রাণশক্তি ছিল অবিশ্বাস্য।

স্কুলে রফিকের বন্ধুত্ব হলো সাকিবের সঙ্গে। সাকিব পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে দুই পা হারিয়েছিল, কিন্তু হুইলচেয়ারে বসেই সে ছবি আঁকত। তার তুলির আঁচড়ে ফুটে উঠত জীবনের জয়গান। অন্য বন্ধু মিতা, কথা বলতে পারত না, ইশারায় কথা বলত, কিন্তু তার হাতের কাজের জাদুতে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত।

তারা একসঙ্গে হাসত, খেলত, নিজেদের স্বপ্নগুলো ভাগ করে নিতো। রফিক বুঝতে পারল, সে একা নয়। এই বন্ধুদের মধ্যে সে এক নতুন পরিবার খুঁজে পেল। তাদের বেদনাগুলো ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি ছিল।

স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রফিক হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইল। তার সেই গান সবার চোখে জল এনে দিল। সেখানে উপস্থিত এক এনজিও কর্মকর্তা তার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকে তাদের সংস্থায় কাজের প্রস্তাব দিলেন।

আজ রফিক একজন প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত শিক্ষক। সে তার মতো আরও অনেক প্রতিবন্ধী শিশুকে গান শেখায়, তাদের জীবনে সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে দেয়। তার অন্ধ চোখ দিয়ে সে দেখতে না পেলেও, তার মন দিয়ে সে এক সুন্দর পৃথিবী দেখে, যেখানে দুঃখ, দুর্দশা নয়, বরং আনন্দ আর স্বপ্নই আসল রঙ।

আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস প্রতি বছর ৩ ডিসেম্বর তারিখে পালিত হয়। এই দিবসের তাৎপর্য হলো, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার, কল্যাণ এবং তাদের অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সমাজে তাদের ভূমিকা তুলে ধরা। ২০২৫ সালের এ দিবসের প্রতিপাদ্যবিষয় : ‘প্রতিবন্ধিতা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ি, সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করি’ (Fostering disability inclusive for advancing social progress)।

পৃথিবীর অধিকাংশ আন্তর্জাতিক সংগঠনের দৃষ্টিকোণ থেকে- প্রতিবন্ধী হলেন এমন একজন ব্যক্তি যার দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত বা ইন্দ্রিয়গত সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা সমাজে অন্যদের সঙ্গে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে বাধা দেয়। এই সংজ্ঞাটি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং পরিবেশগত বাধাকেও অন্তর্ভুক্ত করে, যা তাদের পূর্ণ ও কার্যকর অংশগ্রহণে বিঘ্ন ঘটায়।

জাতিসংঘের দৃষ্টিকোণ থেকে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে যার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত বা ইন্দ্রিয়গত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, যা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে সমাজে অন্যদের সঙ্গে সমানভাবে পূর্ণ ও কার্যকর অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করে। অর্থাৎ প্রায় একই সংজ্ঞা।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংজ্ঞা প্রধানত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩-এর মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। এই আইন অনুসারে, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তি’ অর্থ এমন ব্যক্তি যিনি : দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত বা সংবেদনগত (দৃষ্টি, শ্রবণ, বাক) ত্রুটির কারণে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে স্বাভাবিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। যিনি সমাজের অন্যদের সঙ্গে সমান সুযোগ লাভের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হন। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত মেডিকেল বোর্ড কর্তৃক পরীক্ষিত ও প্রত্যয়িত ব্যক্তিও এর অন্তর্ভুক্ত হবেন। এই আইনটি প্রতিবন্ধিতার ধরনকে সুনির্দিষ্টভাবে স্বীকৃতি দেয় (যেমন : অটিজম, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা, বাক প্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, মানসিক প্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা এবং অন্যান্য)।

সংক্ষেপে- আন্তর্জাতিক সংজ্ঞাগুলো সামাজিক বাধাগুলোর উপর বেশি জোর দেয়, যেখানে বাংলাদেশের আইনি সংজ্ঞা ব্যক্তি এবং সমাজের মিথস্ক্রিয়া উভয়কেই বিবেচনা করে একটি আইনি কাঠামো প্রদান করে।

প্রতিবন্ধিতার ধারণাটি মানব সভ্যতার প্রথম থেকেই বিদ্যমান ছিল, তবে এর আধুনিক ধারণা এবং অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা অনেক পরে এসেছে। প্রাচীন যুগ : প্রাচীন মিশরসহ বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজের অংশ ছিলেন। ১৯ শতক : কিছু নীতিগত পরিবর্তন শুরু হয় যা প্রতিবন্ধী তরুণদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। ১৯৭১ : জাতিসংঘ মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে। ১৯৭৫ : জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। ১৯৯২ : ৩ ডিসেম্বরকে ‘বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস’ হিসেবে পালন করা শুরু হয়।

বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৩০ কোটি বা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৬ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী। এই সংখ্যাটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থার জরিপের ভিত্তিতে নির্ধারিত। যদিও এই সংখ্যাটি বিভিন্ন জরিপে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে, অর্থাৎ এটি বিশ্বের একটি বিশাল জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে।

ড. মো. আনোয়ার হোসেন

প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত