প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫
পুরান ঢাকায় পাথর নিক্ষেপ করে মানুষ হত্যার নির্মম দৃশ্য কিছুদিন আগেই সমগ্র দেশকে কাঁদিয়েছে। প্রকাশ্যে গুলি করে একের পর এক প্রাণ কেড়ে নেওয়ার বর্বর চিত্রও আলোড়িত করেছে দেশকে। এসব অপরাধ সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পুরোপুরি ব্যর্থ। কিন্তু এবার যে ঘটনাটি জাতি দেখলো , তা যেন এক ভিন্ন স্তরের নিষ্ঠুর অমানবিকতার পরিচয় বহন করে। এবার সেই ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের শিকার হলো একেবারে অবুঝ নিষ্পাপ প্রাণী- আটটি কুকুর ছানা। তাদের পানিতে ডুবিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। আর সেই দৃশ্য দেখে, মা কুকুরটির সন্তানহারা অসহায় চাহনি এবং গগনবিদারী আহাজারি আমাদের হৃদয়কে গভীরভাবে আঘাত করেছে।
পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলা চত্বর ছিল জন্মদাত্রী মা সহ আটটি কুকুর ছানার আবাসস্থল। তাদের খেলার জায়গা, তাদের নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু সেই নিরাপদ আশ্রয়েই ঘটল এমন ভয়াবহ ঘটনা। মায়ের অনুপস্থিতিতে আটটি কুকুর ছানাকে বস্তাবন্দী করে পানিতে ডুবিয়ে মারা হলো। পরে যখন মা কুকুরটি ফিরে এসে দেখল তার আটটি ছানা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, সে মুহূর্তের করুণ দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। সেই দৃশ্য আমাদের মনে গেঁথে থাকবে অমানবিকতার এক চরম নিদর্শন হিসেবে।
এ কেমন অমানবিক আচরণ? দিন দিন কি আমরা হৃদয়হীন, সংবেদনাহীন হয়ে উঠছি? আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করি, অথচ অবুঝ প্রাণীদের প্রতি আমাদের এই অমানুষের মতো আচরণই বলে দিচ্ছে আমরা কতটা নিকৃষ্ট মানসিকতার অধিকারী হতে পারি। ‘কি দোষ ছিলো আটটি নিষ্পাপ কুকুর ছানার?’- এই প্রশ্নটি আজ আমাদের বিবেকের দরজায় আঘাত করছে। আমাদের হৃদয় মানছে না এই নির্মমতা। যে সমাজে মানুষ এমন নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারে, সেই সমাজে আর কোনো প্রাণের নিরাপত্তা কোথায়? মানবাধিকারে পিছিয়ে থাকা রাষ্ট্রে প্রানীও অনিরাপদ। কুকুরছানাদের মৃত্যু আমাদের এটিই বুঝি দিয়ে গেলো। যে রাষ্ট্র প্রাণীদের অধিকার রক্ষা করতে পারে না, সে রাষ্ট্রের শাসক মানুষ হয়ে কিভাবে মানুষের অধিকার রক্ষা করবে?
এই আটটি কুকুর ছানার নির্মম মৃত্যুর জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে একজন নারীকে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো- একজন নারী, যিনি মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করেছেন বা সেই সহজাত মমতার অধিকারী, তিনি কীভাবে এমন ঘৃণিত, চরম নিষ্ঠুর কাজটি করতে পারলেন? মাতৃত্বের পবিত্র অনুভূতি কি তাঁকে এতটুকুও বাধা দিল না? মা যখন নিজ হাতে অন্য একটি মায়ের কোল খালি করে দেয়, তখন আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না যে মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় হয়েছে, আবেগ ভালোবাসায় নেমেছে ধস।
এই ঘটনা আমাদের দেশের সামগ্রিক মানবাধিকার সংরক্ষণ ব্যবস্থার দৈন্যদশাটিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আমাদের সমাজে হরহামেশা নানান অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। আর এই আটটি কুকুর ছানার নির্মম মৃত্যু স্পষ্ট করে দিয়েছে যে- মানবাধিকারের দিক থেকে পিছিয়ে থাকা এই রাষ্ট্রে শুধু মানুষই নয়, প্রাণীরাও অনিরাপদ। পশু-পাখিদের সুরক্ষার জন্য আইন থাকলেও, তার প্রয়োগ কতটা দুর্বল, তা এই ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হলো। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকার কারণেই এমন কাজ করতে সাহস পাচ্ছে।
কুকুর আমাদের সমাজে এক অতি সাধারণ প্রাণী হিসেবে পরিচিত। আমাদের দেশের প্রায় সব জায়গায় এদের দেখা যায়। সামান্য খাবার পেয়ে গেলেই তারা হয়ে ওঠে আমাদের নির্জন পথে চলার বিশ্বস্ত সঙ্গী। তারা আমাদের বাসা-বাড়ির আশেপাশে থাকে, সার্বক্ষণিক সজাগ থাকে। মনিবের বাসায় অপরিচিত কেউ প্রবেশ করার সাথে সাথেই চিৎকার করে সতর্ক করে তোলে। কুকুরকে বিশ্বস্ত বন্ধুও বলা যায়।
ইতিহাস ও সাহিত্যের পাতায় কুকুরের স্থান অনেক উপরে। তাদের একনিষ্ঠতা, বিশ্বস্ততা এবং সাহসিকতার জন্য তারা যুগ যুগ ধরে সমাদৃত। এমনকি অনেক ধর্মগ্রন্থেও তাদের বিশেষ স্থান ও গুরুত্বের কথা উল্লেখ আছে। এই অবুঝ প্রাণীগুলো শহরাঞ্চলে ময়লা-আবর্জনা খেয়ে পরিবেশের দূষণ কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মনিবের প্রতি একনিষ্ঠ প্রাণী হিসেবে কুকুরের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে। তাদের এই উপযোগিতা এবং বিশ্বস্ততা সত্ত্বেও কেন তাদের প্রতি এত নিষ্ঠুরতা?
আসলে শুধু কুকুরই নয়, পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীই কোনো না কোনোভাবে আমাদের উপকারের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। সৃষ্টির প্রতিটি জীবই মহামূল্যবান। প্রতিটি প্রাণের প্রতি মমতা ও যত্নশীল হওয়া মানবিকতার প্রধান ভিত্তি। ধর্মীয় ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, জীবে প্রেম করা মানেই সৃষ্টিকর্তাকে খুশি রাখা। যে ব্যক্তি একটি জীবের যত্ন নিতে পারে না, ভালোবাসা দিতে পারে না, সে আসলে একজন অমানবিক ব্যক্তি হিসেবে স্রষ্টার কাছেও ঘৃণিত। আমাদের মনে রাখা উচিত, পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীই এই গ্রহের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় অপরিহার্য। তাদের অবদানের কারণেই আমাদের চারপাশের পরিবেশ এতো সুন্দর। আটটি কুকুর ছানার লাশ যখন পাওয়া গেল, সেই দৃশ্য দেখে সবার হৃদয় কেঁপে উঠেছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মা কুকুরটির বুকফাটা আর্তনাদ এবং অসহায়ত্ব আমাদের চোখে জল এনেছে।
আব্দুল কাদের জীবন
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়