ঢাকা রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

৫৪ বছরের অর্জন : অর্থনৈতিক জোয়ার নাকি নৈতিক খরা

সানিয়া তাসলিম লামিয়া
৫৪ বছরের অর্জন : অর্থনৈতিক জোয়ার নাকি নৈতিক খরা

স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে আজ বাংলাদেশ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে অগ্রগতির প্রতিটি মানদ-ই যেন দ্বৈত ছবি আঁকে- একদিকে চমকপ্রদ উন্নয়ন, অন্যদিকে গভীর নৈতিক সংকট। ১৯৭১ সালের যে স্বপ্ন নিয়ে দেশটি সামনে এগিয়েছিল, তা ছিল সমান সুযোগ, মানবিক রাষ্ট্র এবং মর্যাদাপূর্ণ নাগরিক জীবনের প্রতিশ্রুতিতে ভরপুর। পাঁচ দশক পর এসে দেখা যায়- অর্থনীতির সূচকগুলো ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী; কিন্তু সমাজের নৈতিক মানদ-গুলো কি সেই গতিতে সামনে এগোতে পেরেছে? এই প্রশ্নই আজ নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে।

বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি। পোশাকশিল্পের সাফল্য, বৈদেশিক রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক প্রবাহ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, অবকাঠামোর উল্লম্ফন, প্রযুক্তিতে অগ্রগতি- সব মিলিয়ে দেশটির অর্থনৈতিক যাত্রা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। শহর থেকে গ্রাম- পরিবর্তনের ঢেউ দৃশ্যমান। বিদ্যুৎ সুবিধা, সড়ক নেটওয়ার্ক, নারীশক্তির শ্রমবাজারে প্রবেশ, ডিজিটালাইজেশন- এসবই বাস্তব অগ্রগতি। আজকের বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে সম্ভাবনার দেশ হিসেবে পরিচিত।

কিন্তু অর্থনীতির এই জোয়ারের বিপরীতে সমাজের ভেতরে যেন অন্য এক স্রোত বইছে- সেই স্রোত হলো নৈতিক অবক্ষয়ের। দুর্নীতি, অনিয়ম, সামাজিক বৈষম্য, অবহেলা, স্বচ্ছতার অভাব, সহিংসতার বৃদ্ধির মতো সমস্যা আজ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অশান্তি, নৈতিক শিক্ষা থেকে বিচ্যুতি, প্রতিযোগিতার নামে অমানবিকতা, সামাজিক মাধ্যমনির্ভর কৃত্রিম জীবন- এসবই সমাজে মূল্যবোধের সংকট আরও তীব্র করে তুলছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের রথ যখন দ্রুতগতিতে সামনে ছুটে চলেছে, তখন মানবিক মূল্যবোধের ঘোড়াটি যেন ক্লান্ত, বিচ্ছিন্ন ও পিছিয়ে পড়া।

একদিকে আকাশচুম্বী ভবন, অন্যদিকে গ্রাম-শহরের বৈষম্য; একদিকে বিলাসিতার বিস্তার, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা- এই বৈপরীত্যই আজ সময়ের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন তুলে ধরে। উন্নয়নের স্থায়িত্ব শুধু সংখ্যায় নয়, মানুষের চরিত্র, সততা ও মূল্যবোধে নির্ভর করে। যদি এই অংশটি দুর্বল হয়, তবে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাও দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে। বর্ষপূর্তির এই মুহূর্তে প্রশ্ন দাঁড়ায়- দেশ কি সত্যিই এগোচ্ছে, নাকি একদিকে এগিয়ে অন্যদিকে পিছিয়ে যাচ্ছে? অর্জনের ঝুলিতে প্রাপ্তি আছে অনেক, তবুও অপ্রাপ্তির বড় অংশজুড়ে রয়েছে একটাই শব্দ- নৈতিকতা। তাই ৫৪ বছরের যাত্রাপথে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন আর অর্থনীতি নয়, বরং মূল্যবোধের পুনর্গঠন।

অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পরও নৈতিক খরার যে সংকট বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, তার পেছনে রয়েছে বহুস্তরীয় কারণ। প্রথমত, উন্নয়নপর্বে শারীরিক অবকাঠামোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হলেও নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা তেমনভাবে গুরুত্ব পায়নি। শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষাভিত্তিক প্রতিযোগিতা, ফলাফলকেন্দ্রিকতা ও মানসিক চাপ নৈতিকতার জায়গাটি ক্রমেই সংকুচিত করেছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক, নৈতিক পাঠ, মানবিক মূল্যবোধচর্চা- এসবই ধীরে ধীরে প্রান্তে চলে গেছে। ফলে প্রজন্ম বড় হচ্ছে সফলতার সংজ্ঞাকে শুধু আর্থিক অর্জন দিয়ে মাপতে শিখে, নৈতিকতা নয়। দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার সংস্কৃতি সমাজে একটি ‘স্বাভাবিক’ চেহারা পেয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম, টেন্ডারবাজি কিংবা প্রশাসনিক জটিলতা- এসবের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব মানুষের মনোজগতে অবক্ষয়ের অনুভূতি সৃষ্টি করেছে। যখন সমাজ দেখে যে ন্যায়ের চেয়ে শক্তি গুরুত্বপূর্ণ, যোগ্যতার চেয়ে সম্পর্ক বেশি কার্যকর- তখন নৈতিক পতন স্বাভাবিকভাবেই বাড়তে থাকে। এতে নীতিবান মানুষও ধীরে ধীরে হতাশ ও কোণঠাসা হয়ে পড়ে।

সামাজিক বৈষম্যের বাড়তে থাকা ফাঁকও নৈতিক সংকটের একটি বড় কারণ। উন্নয়ন সব জায়গায় পৌঁছালেও সুষমভাবে পৌঁছায়নি। সমাজের একশ্রেণি জীবনমানের উল্লম্ফন দেখছে- বিলাসবহুল জীবন, প্রযুক্তির সমৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ- অন্যদিকে বিপুল অংশ এখনও সংগ্রামে আটকে আছে। বৈষম্য যখন দৃশ্যমান হয়, তখন সমাজে হিংসা, প্রতিযোগিতা, অসন্তোষ এবং অপরাধপ্রবণতা বাড়ে। এতে নৈতিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে।

সামাজিক মাধ্যম নতুন যুগের এক ধরনের নৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ভার্চুয়াল জীবনে প্রদর্শনীবৃত্তি, জনপ্রিয়তার প্রতিযোগিতা, মিথ্যা অর্জন দেখানোর প্রবণতা, গুজব ছড়ানো- এসব মানুষকে সত্যের চেয়ে নাটকীয়তাকে বেশি গুরুত্ব দিতে শিখিয়েছে। ডিজিটাল দুনিয়া মানুষকে সংযুক্ত করেছে ঠিকই; কিন্তু একই সঙ্গে বাস্তব মানবিকতা, সহমর্মিতা ও মূল্যবোধকে ক্ষয় করেছে।

পরিবার নামক প্রাথমিক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভাঙনও বড় কারণ। ব্যস্ত জীবন, প্রবাসজীবন, ছোট পরিবারের আধিপত্য এবং অভিভাবকদের সময় সংকট- সব মিলিয়ে নতুন প্রজন্ম নৈতিক দীক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যে পরিবার একসময় মূল্যবোধ শেখানোর কেন্দ্র ছিল, তা এখন অনেকক্ষেত্রে শুধু আনুষ্ঠানিক কাঠামো হিসেবে টিকে আছে।

ন্যায়বিচারের বিলম্ব ও অসাম্যও নৈতিক খরাকে তীব্র করেছে। যখন অপরাধ করে কেউ পার পেয়ে যায়, আর নির্দোষ ভোগে- তখন মানুষের বিশ্বাস ভেঙে যায়। যে সমাজে বিশ্বাসহীনতা বাড়ে, সেখানে নৈতিকতা টেকসই থাকে না।

সব মিলিয়ে, অর্থনৈতিক অগ্রগতি চোখে দেখা যায়, কিন্তু নৈতিকতার শেকড় অদৃশ্যভাবে ক্ষয়ে যাচ্ছে- এটাই আজকের বাংলাদেশে নৈতিক খরার মূল কারণগুলো। অর্থনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও নৈতিক খরার যে চিত্র বাংলাদেশে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তার বহুমাত্রিক সমস্যাগুলো আজ সমাজের প্রতিটি স্তরকে গভীরভাবে স্পর্শ করছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতির স্বাভাবিকীকরণ। দুর্নীতি যেন আর ‘অস্বাভাবিক’ বলে মনে হয় না; বরং দাবি, সুপারিশ, সুবিধা- এসবকে আজ অনেকেই সিস্টেমের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করেন। প্রশাসন থেকে শিক্ষা, চিকিৎসা থেকে ব্যবসা- প্রতিটি ক্ষেত্রে এ সমস্যার বিস্তার সমাজের সৎ ও নীতিবান মানুষদের হতাশ করে তুলছে।

শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। শিক্ষার্থীরা জিপিএ, ব্র্যান্ডেড ক্যারিয়ার ও চাকরির প্রতিযোগিতায় এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা বা চরিত্র গঠনের পাঠ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাতেও সততা, মৌলিকতা ও কঠোর পরিশ্রমের মূল্যায়নের বদলে শর্টকাট, প্রভাব কিংবা প্রতিযোগিতাহীন পদ্ধতির ব্যবহার বাড়ছে।

সামাজিক বৈষম্যের তীব্রতা নৈতিক খরাকে আরও ঘনীভূত করছে। ধনী ও মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য তৈরি হয়েছে, আর এই পার্থক্য অনেকের মধ্যে অবিচারবোধ ও ক্ষোভ বাড়াচ্ছে। সমাজে যখন অসমতা বাড়ে, তখন অপরাধ, সহিংসতা, প্রতারণা, হতাশা এবং অবিশ্বাস স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়। এতে নাগরিক সমাজের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়ে।

ডিজিটাল যুগের বিকৃত বাস্তবতা নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে। সামাজিকমাধ্যমে লোক দেখানো সাফল্য, নকল glamour, ফিল্টার-পরিচালিত জীবন মানুষকে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। মানুষ সত্য, সততা ও স্বাভাবিক জীবনের চেয়ে কৃত্রিম প্রদর্শনীর পেছনে ছুটছে। গুজব, বিদ্বেষ, অপপ্রচার, ট্রলিং- এসব ডিজিটাল রোগ নৈতিক খরাকে আরও বাড়াচ্ছে।

আইন-বিচারের জটিলতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি মানুষের মানসিক কাঠামোতে বড় প্রভাব ফেলছে। যখন দেখা যায় অপরাধীরা বছরের পর বছর শাস্তি পায় না, মামলা ঝুলে থাকে, দুর্বলরা ন্যায় পায় না- তখন সমাজে নৈতিকতা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ন্যায়বিচার দুর্বল হলে মানবিকতা ক্ষয় হয়, আর ক্ষমতার অপব্যবহার বাড়ে।

পারিবারিক বন্ধনের দুর্বলতা। ব্যস্ততা, অভিবাসন, প্রযুক্তিনির্ভরতা- এসব কারণে পরিবারের ভেতর মূল্যবোধ শেখানোর সময় কমে যাচ্ছে। সন্তান প্রতিপালন হয়ে উঠছে কৃত্রিম, সম্পর্কগুলো যান্ত্রিক, আর দায়িত্ববোধ ক্রমে কমছে।

সর্বোপরি, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি নৈতিক খরা সমাজকে এমন এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে অর্জনের চেয়ে হুমকিগুলো দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে। মূল্যবোধের এই অবক্ষয় উন্নয়নকে স্থায়ী হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করছে- এটাই আজকের সবচেয়ে বড় সমস্যা।

অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি নৈতিক খরা রোধ করতে হলে বাংলাদেশকে এখন এমন একটি পথনকশা তৈরি করতে হবে, যেখানে উন্নয়ন শুধু সংখ্যায় নয়- মানুষের চরিত্র, চিন্তা, মূল্যবোধ ও আচরণেও প্রতিফলিত হবে। প্রথমত, শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষাকে কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হিসেবে পুনর্গঠন করা জরুরি। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত মানবিকতা, সততা, নাগরিক দায়িত্ববোধ, সহমর্মিতা ও চরিত্র গঠনের পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে বাস্তব জীবনের উদাহরণসহ। শিক্ষক প্রশিক্ষণেও নৈতিক মূল্যবোধ জোরালোভাবে রাখা প্রয়োজন, যাতে তারা নিজেরাই আদর্শ হয়ে উঠতে পারেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর শূন্য-সহনশীলতা নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মানে শুধু দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পেইন নয়- প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য খাতসহ প্রতিটি সেক্টরে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। প্রযুক্তিনির্ভর সেবা, যেমন ডিজিটাল ফাইল ট্র্যাকিং, অনলাইন বিলিং, স্বয়ংক্রিয় অনুমোদন ব্যবস্থা দুর্নীতির সুযোগ কমাতে কার্যকর হতে পারে। একইসঙ্গে আইনের প্রয়োগে কঠোরতা ও বিচার দ্রুত নিশ্চিত হতে হবে।

পারিবারিক কাঠামোকে শক্তিশালী করা আজকের সময়ের একটি জরুরি সমাধান। পরিবারই মানুষের প্রথম বিদ্যালয়। পরিবারে নিয়মিত কথোপকথন, মূল্যবোধ শেখানো, সন্তানদের দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলা- এসবই নৈতিক মানবসম্পদ তৈরি করতে সাহায্য করে। স্মার্টফোন ও সামাজিকমাধ্যম আসক্তি নিয়ন্ত্রণ, পরিবারে একসঙ্গে সময় কাটানো, উৎসব-অনুষ্ঠানে সক্রিয় অংশগ্রহণ- এসব ছোট পদক্ষেপও বড় পরিবর্তন আনে।

সামাজিক বৈষম্য কমাতে নীতি-হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে যাতে শহর-গ্রাম, ধনী-গরিব বিভাজন কমে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ন্যায্য মজুরি- এসব মানুষের জীবনমান স্থিতিশীল করবে এবং অবক্ষয়ের ঝুঁকি কমাবে। বৈষম্য কমলে সমাজে অসন্তোষ, অপরাধপ্রবণতা ও নৈতিক পতনও কমে। ডিজিটাল নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি। সামাজিকমাধ্যমে দায়িত্বশীল ব্যবহার, ভুয়া তথ্য প্রতিরোধ, অনলাইন নিরাপত্তা এবং সম্মানজনক আচরণ শেখাতে সচেতনতামূলক কর্মসূচি ও স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ডিজিটাল সিটিজেনশিপ কোর্স চালু করা যেতে পারে।

ন্যায়বিচারের নিশ্চিততা হলো- নৈতিক সমাজের মূলভিত্তি। বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত ও নিরপেক্ষ না হলে মানুষের বিশ্বাস ভেঙে যায়। তাই বিচারব্যবস্থায় সংস্কার, প্রযুক্তিনির্ভর কোর্ট ম্যানেজমেন্ট, হটলাইন অভিযোগ ব্যবস্থা এবং পুলিশের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। সব মিলিয়ে, নৈতিকতার পুনর্গঠন শুধু নির্দেশনা দিয়ে নয়- বরং পরিবার, শিক্ষা, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সমন্বিত প্রচেষ্টায় সম্ভব। অর্থনৈতিক জোয়ার টেকসই হবে তখনই, যখন নৈতিকতার শেকড় আরও গভীরে প্রোথিত হবে।

৫৪ বছরের পথচলাকে মূল্যায়ন করলে স্পষ্ট হয়- বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে যতটা এগিয়েছে, নৈতিকতার জায়গায় ততটা শক্ত ভিত গড়ে উঠতে পারেনি। আমার মতে, একটি সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন বোঝা যায় শুধু অবকাঠামো, জিডিপি বা প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে নয়- বোঝা যায় মানুষের আচরণে, সততায়, দায়িত্ববোধে এবং একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধায়। তাই এই বৈষম্যের মধ্যেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ লুকিয়ে আছে। অর্থনৈতিক জোয়ার নিঃসন্দেহে গর্বের, তবে এ জোয়ার যদি মানুষের নৈতিক কাঠামোকে শক্ত করতে না পারে, তবে উন্নয়ন দীর্ঘস্থায়ী হবে না। উন্নয়ন তখনই অর্থবহ যখন তা সামাজিক ন্যায়, মানবিক মূল্যবোধ এবং সুশাসনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোয়। আজকে সমাজে যে দুর্নীতি, বৈষম্য, প্রতিযোগিতার নামে অমানবিকতা, প্রদর্শনীবৃত্তি বা সহমর্মিতার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে- সেগুলোই মনে করিয়ে দেয় যে নৈতিকতার ভিত্তিতে বিনিয়োগ না করলে ভবিষ্যতের অগ্রগতি একসময় কাগজে আটকে যাবে।

নৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠা কোনো একক প্রতিষ্ঠানের কাজ নয়। পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা, রাষ্ট্র, গণমাধ্যম- সবাইকে নিজেদের অংশটুকু দায়িত্ব নিয়ে পালন করতে হবে। বিশেষত নতুন প্রজন্মকে সাফল্যের চেয়ে সততার মূল্য শেখানো সবচেয়ে জরুরি। কারণ নৈতিকতা শুধু একটি পাঠ নয়- এটি একটি অভ্যাস, একটি চর্চা, যা প্রতিদিন তৈরি হয়।

বাংলাদেশ এখন এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে যেখানে অর্থনৈতিক অর্জনের চেয়ে নৈতিক পুনর্গঠন বেশি জরুরি। উন্নয়ন টেকসই হবে তখনই, যখন মানুষের ভেতরে মানবিকতার শিকড় আরও গভীরে নামবে। তাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন- অর্থনৈতিক সাফল্যকে নৈতিক আলোর দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। শুধু তখনই এই দেশের যাত্রা হবে সত্যিকার অর্থে এগিয়ে যাওয়ার যাত্রা।

৫৪ বছরের অর্জন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি গর্বের অধ্যায়- অর্থনীতি, অবকাঠামো, প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন দেশকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তবে একই সঙ্গে নৈতিক খরার যে ছায়া সমাজকে ঘিরে ধরেছে, তা অগ্রগতির স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। শুধুমাত্র বৈদেশিক রিজার্ভ, সেতু, মহাসড়ক বা শিল্পায়নের পরিসংখ্যান দিয়ে একটি জাতির প্রকৃত উন্নয়ন পরিমাপ করা যায় না; বরং তা নির্ভর করে মানুষ কতটা ন্যায়পরায়ণ, দায়িত্বশীল, সহমর্মী ও সৎ হতে পেরেছে- তার ওপর।

এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো- অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে নৈতিকতার ভিত্তিকে সমানভাবে শক্ত করা। পরিবার, শিক্ষা, সমাজ, রাষ্ট্র- সব স্তর থেকেই মূল্যবোধ চর্চা ও ন্যায়ের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। যদি নৈতিকতা দুর্বল থাকে, তবে যেকোনো উন্নয়নই ভঙ্গুর হয়ে পড়তে পারে।

অতএব, স্বাধীনতার ৫৪ বছরে অর্জন অনেক, কিন্তু অর্জনকে অর্থবহ ও দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে নৈতিকতার ঘাটতি পূরণই হবে আগামী যাত্রার কেন্দ্রবিন্দু। উন্নয়ন আর নৈতিকতার সমন্বয়ই পারে বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে এগিয়ে নেওয়ার পথ তৈরি করতে।

সানিয়া তাসলিম লামিয়া

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত