ঢাকা মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

তামাক কোম্পানির প্রভাবমুক্ত আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি

ইকবাল মাসুদ
তামাক কোম্পানির প্রভাবমুক্ত আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি

তামাক নিয়ন্ত্রণের যে কোনো প্রচেষ্টার সবচেয়ে বড় বাধা হলো তামাক কোম্পানির প্রভাব, কৌশল এবং জনস্বাস্থ্যবিরোধী কর্মকাণ্ড। বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও তামাক কোম্পানি বিভিন্ন উপায়ে নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এবং আইন প্রয়োগে বাধা সৃষ্টি করতে সক্রিয়। বাস্তবে, বাংলাদেশে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপের সূচক ৬৯ ভাগ, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। গবেষণা বলছে, কোম্পানিগুলো কৌশলগতভাবে এমন সব প্রচারণা ও ব্যবসায়িক তৎপরতা চালায় যা সরাসরি জনস্বাস্থ্য, নীতি-প্রণয়ন প্রক্রিয়া এবং তরুণ সমাজকে প্রভাবিত করে। ফলে তামাক কোম্পানির আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা এবং তাদের কার্যক্রম কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনা সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে তামাক শিল্প হস্তক্ষেপের একটি বড় কারণ হলো দ্বৈত নীতি। সরকার ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি (বিএটি) বাংলাদেশে প্রায় ৯.২১ ভাগ শেয়ার ধারণ করছে (৩১ অক্টোবর ২০২৫ অনুযায়ী), যা নীতিনির্ধারণ ও আইন প্রয়োগকে প্রভাবিত করে। এছাড়া আইনের ফাঁকফোকরও কোম্পানিকে সুযোগ দেয়। পাবলিক প্লেসে ‘নির্দিষ্ট ধূমপান এলাকা’ অনুমোদিত, পরোক্ষ সিএসআর কার্যক্রম চলমান, তামাক দ্রব্যের প্রদর্শনী নিয়ন্ত্রণহীন এবং নতুন নিকোটিন পণ্যের (যেমন ই-সিগারেট ও হিটেড তামাক পণ্য) ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা নেই। তামাক চাষ প্রায়ই খাদ্য ফসলের জন্য দেওয়া সারসহ সহায়তা পায় এবং এগ্রিকালচার মার্কেটিং এ্যাক্ট ২০১৮-এ তামাক এখনও ক্যাশ ক্রপ হিসেবে তালিকাভুক্ত। তামাক পাতা রপ্তানিতে কর, যা আগে ২৫ ভাগ ছিল, তা বাতিল করা হয়েছে। এমনকি সরকার তামাক কোম্পানিকে নিকোটিন পাউচ কারখানা স্থাপন করতে অনুমতি দিয়েছে। পাশাপাশি, ই-সিগারেট এবং হিটেড তামাক পণ্যের ব্যবহার তরুণদের মধ্যে বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সব পরিস্থিতি তামাক কোম্পানির প্রভাব বজায় রাখার কৌশল সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত।

তামাক কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের ক্ষতিকারক প্রভাব ঢাকতে সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কার্যক্রম ব্যবহার করে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত অনুদানের মাধ্যমে তারা সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি তৈরি করে, যা প্রকৃতপক্ষে জনস্বার্থের জন্য নয়, বরং প্রভাব বিস্তারের কৌশল। একই সঙ্গে, কোম্পানিগুলো তরুণদের লক্ষ্য করে নতুন তামাক পণ্য বিপণন করে, যেমন আকর্ষণীয় প্যাকেজিং, ফ্লেভারযুক্ত পণ্য, সস্তা সিঙ্গেল-স্টিক সিগারেট, গোপন ডিজিটাল বিজ্ঞাপন এবং নতুন নিকোটিন পণ্যের প্রচারণা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা একে ‘সোশ্যাল ওয়াশিং’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সিএসআর নিষিদ্ধ করা তাই তামাক শিল্পের হস্তক্ষেপ মোকাবিলার জন্য অপরিহার্য।

শিল্পটি নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় লবিং, ব্যবসায়িক সংস্থা ব্যবহার এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করে। ডাব্লিউএইচও এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩ অনুসারে সরকারের দায়বদ্ধতা আছে, তামাক শিল্পের হস্তক্ষেপ থেকে জনস্বাস্থ্য নীতি রক্ষা করতে হবে। তামাক উৎপাদন ও চাষ পরিবেশের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে যেমন বন উজাড়, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, মাটির উর্বরতা হ্রাস এবং প্লাস্টিক দূষণ ইত্যাদি। তবে কোম্পানিগুলো প্রায়ই এই ক্ষতির দায় এড়িয়ে যায়। তামাক কোম্পানি প্রায়ই নিজেদের অর্থনৈতিক অবদান ভুলভাবে উপস্থাপন করে, সরকারের জন্য বড় আয় দেখায়, অথচ তামাক সংক্রান্ত অসুস্থতা, পরিবেশের ক্ষতি এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাসের প্রকৃত ব্যয় উপেক্ষা করে।

তামাক কোম্পানির প্রভাব রোধ করতে এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষা করতে বাংলাদেশে এখনই প্রয়োজন দ্রুত আইন পাস ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ। ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের খসড়া সংশোধনী দ্রুত চূড়ান্ত করা, এসেনশিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট ১৯৫৬ থেকে সিগারেট বাদ দেওয়া, সরকারের শেয়ার প্রত্যাহার করা এবং কোম্পানির সঙ্গে কর্মকর্তাদের জড়িত থাকা বন্ধ করা জরুরি। ব্লিউএইচও এফসিটিসির আর্টিকেল ৬ অনুযায়ী সহজ ও কার্যকরী কর ও মূল্য নীতি বাস্তবায়ন, তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ, বিকল্প ফসল প্রচার, নতুন কোম্পানি ও বিনিয়োগ বন্ধ করা এবং এসইজেড ও ইপিজেডে তামাক কারখানা নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। তামাক পাতা রপ্তানিতে কর পুনঃপ্রবর্তন এবং তামাককে ক্যাশ ক্রপের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া উচিত।

বাংলাদেশ কার্যকরভাবে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ না করলে তামাকমুক্ত জাতি গঠন সম্ভব নয়। জনস্বাস্থ্য রক্ষা করতে এখনই কঠোর বিপণন নিয়ন্ত্রণ, সিএসআর নিষিদ্ধকরণ, নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা, পরিবেশগত দায়বদ্ধতা এবং নতুন নিকোটিন পণ্যের নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিলম্ব বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তাই তামাক কোম্পানির প্রভাব মুক্ত হয়ে দ্রুত আইন সংশোধনের মাধ্যমে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করার একমাত্র পথ।

ইকবাল মাসুদ

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত