ঢাকা মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

তেল-পেঁয়াজের আগুনে ভোক্তা পুড়ছে নিঃশব্দে

সুমাইয়া সিরাজ সিমি
তেল-পেঁয়াজের আগুনে ভোক্তা পুড়ছে নিঃশব্দে

বাজারে গেলেই আজকাল মনে হয় রান্না নয়, চলছে আগুন সামলানোর মহড়া। চুলায় আগুন জ্বালানোর আগেই প্রথম ধাক্কা লাগে বাজারদরের আগুনে। পেঁয়াজের ঝাঁজ আর তেলের তেজ মিলে এমন এক অবস্থা তৈরি করেছে যে, সবজি, ডাল, মাংস তো দূরের কথা- সাধারণ রান্না করাই এখন চ্যালেঞ্জ। প্রতিদিনের বাজার যেন এক নতুন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র, আর ভোক্তা সেই পরীক্ষায় অসহায়ের মতো লিখছে- ‘আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু বাজেট আমাকে ফেল করে দিয়েছে।’ মানুষের আস্থা যেন বারবার ভেঙে পড়ছে বাজারের অস্বচ্ছতার কারণে।

পেঁয়াজের দাম বেড়েছে, এ যেন আমাদের চিরচেনা গল্প। কারও মনে নেই কবে পেঁয়াজের বাজার স্থির ছিল! যেন প্রতি বছরই কোনো না কোনো অজুহাতে এর দাম আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। কখনও আমদানি মন্থর, কখনও উৎপাদন কম, কখনও বৃষ্টি বেশি, কখনও খরা। কিন্তু এ সব কারণের আড়ালেও একটা অদৃশ্য শক্তি বাজারে থাকে, যাকে আমরা মমতাভরে বলি ‘সিন্ডিকেট’। এদের কাজই হলো সাধারণ মানুষের নুনভাতের থালায় চাপ বাড়ানো।

পেঁয়াজের দাম এক লাফে ৪০ টাকা বেড়েছে। বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজিতে, যা বেশ কিছুদিন ধরে ১১০-১২০ টাকা ছিল। ভোজ্য তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও একই প্রেক্ষাপট পুনরাবৃত্তি করে। গেল বছরেও হঠাৎ করে তেলের দাম বেড়েছিল। কথিত আছে- আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে। পরে দেখা গেল, দাম কমার পরও দেশীয় বাজারে সেই প্রভাবের দেখা নেই। এ বছর আবার সেই পুরনো গল্প।

কোন ধরনের ঘোষণা ছাড়াই নীরবে ভোক্তা পর্যায়ে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সয়াবিন তেলের দাম।

এক লাফে লিটারে বৃদ্ধি পেয়েছে ৯ টাকার মতো। নতুন করে বাজারে আসা ৫ লিটারের বোতল এখন বিক্রি হচ্ছে ৯৬৫ টাকায়। বোতলজাত প্রতি লিটারর দাম ১৯৮ টাকা, যা এতদিন ১৮৯ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এছাড়া ভরা মৌসুমেও ঊর্ধ্বমুখী সবজির বাজারে স্বস্তি ফেরেনি। বেশিরভাগ সবজির দামই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।

সামনেই রমজান মাস। প্রতিবছর এই মাসেই বাজারে অস্থিরতার এক নিঃশব্দ উৎসব ও বছরের পর বছর একই দৃশ্য আমরা দেখি। রমজান সামনে এলেই নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম লাফিয়ে লাগিয়ে বাড়তে থাকে?, যেন মাসটি আসার আগমনী বার্তা শোনা মাত্র কিছু শক্তিশালী মহল দাম বাড়ানোর বোতাম টিপে দেয়। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বাজার আবারও সাধারণ মানুষের দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে।

দাম বাড়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে তবে কোনোটাই এমন নয় যা অভাবনীয়। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে নতুন মৌসুমী উৎপাদন বাজারে আসতে বিলম্ব হয়েছে, পুরনো মজুদ কমে এসেছে- কিন্তু এই ঘাটতি কখনই এত বিশাল নয় যে দাম হঠাৎ দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

বরং বাজারে সেই ঘাটতিকে বাড়িয়ে তুলে একটি কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়। উৎপাদক ও পাইকারি পর্যায়ে মজুতদাররা অপেক্ষা করে থাকে দাম বাড়ার জন্য; তারপর বাজারে পণ্য ছাড়া নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্ববাজারে সামান্য ওঠা নামাকে অজুহাত করে দাম বাড়ানো হয় অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও তার প্রতিফলন দেশে তেমন দেখা যায় না। তার ওপর আমদানির প্রক্রিয়ায় বিলম্ব, কাস্টমস জটিলতা, ডলার বাজারের চাপ- এসব ও ব্যবসায়ীদের হাতে দাম বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করে দেয়। সবমিলিয়ে সরবরাহ ব্যবস্থার অস্বচ্ছতা এবং সিন্ডিকেটের শক্তি দামের ওঠাণ্ডনামা প্রায় সম্পূর্ণ নির্ধারণ করে ফেলে।

এই অবস্থায় সরকারের ভূমিকা সব সময় প্রশ্নের মুখে পড়ে। বাজার মনিটরিং নামেই হয়, কিন্তু বাস্তবে প্রভাব বিস্তার করে না। মোবাইল কোর্ট, অভিযান, জরিমানা- এসবই সাময়িক। অভিযান শেষ হলেই দাম আবার আগের জায়গায় ফিরে যায়। সরকারের সবচেয়ে জরুরি করণীয় হলো নিয়মিত ও কঠোর তদারকি নিশ্চিত করা, আমদানি অনুমোদন সময়মতো দেওয়া, শুল্ক ও কাস্টমস প্রক্রিয়া দ্রুত করা, বাজারে মজুতদারির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রয়োজনের সরকারি পর্যায়ে ন্যায্য মূল্যের বিক্রয় কার্যক্রম চালু রাখা। এসব ব্যবস্থা বাস্তব নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা ভোক্তারা যেন কেনো দামে পরিবর্তন আসছে তার স্বচ্ছ ব্যাখ্যা পান, সেই তথ্য প্রবাহকে নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।

তাহলে কি এই মূল্য বৃদ্ধির অশুভ চক্র থামানো সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব- যদি সরকার, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা- তিন পক্ষই স্বচ্ছ বাজারব্যবস্থায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। সিন্ডিকেট ভাঙা, রিয়েল টাইম বাজার পর্যবেক্ষণ, ডিজিটাল মনিটরিং, বাজারের সব স্তরে মূল্য তালিকার বাধ্যতামূলক প্রদর্শন, মজুতদারির অপরাধে কঠোর শাস্তি- এসব পদক্ষেপ কার্যকর হলে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়বে। পাশাপাশি স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষকদের উৎসাহ দেওয়া দীর্ঘমেয়াদে পণ্য নির্ভরতা কমাবে এবং সরবরাহ স্থিতিশীল রাখবে।

কারণ স্পষ্ট না থাকলেও যখন নিত্যপণ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়, তখন ক্রেতাদের মনে অস্থিরতার এক ধোঁয়াশা তৈরি হয়। বিশেষ করে যারা দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভর করে জীবন চালায় অর্থাৎ দিনে আনে দিনে খায়- তাদের জন্য প্রতিটি দামবৃদ্ধি যেন নতুন এক আতঙ্ক। হিসাব মিলাতে না পেরে তারা থমকে দাঁড়ায়- কোথায় কমাবে, কীভাবে চলবে? মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের অবস্থাও আলাদা নয়; বাড়তি ব্যয়ের চাপে তাদের সংসারের ভারসাম্য প্রতিদিনই টলে যায়। তবুও আশাই ভরসা- যে একদিন সাধারণ মানুষ আবারও নিশ্চিন্ত হয়ে বাজারে যাবে, আর ন্যায্য দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে ফিরতে পারবে স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা; এটাই সময়ের দাবি।

সুমাইয়া সিরাজ সিমি

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত