প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫
বিশ্ব এখন কার্বনমুক্ত ভবিষ্যতের খোঁজে দৌড়াচ্ছে। সৌর প্যানেল, বৈদ্যুতিক গাড়ি, বায়ু টারবাইন-সবখানেই প্রযুক্তির সয়লাব। কিন্তু কঠিন সত্য হলো- এসব প্রযুক্তির প্রাণ মূলত লিথিয়াম, কোবাল্ট, নিকেল, তামা আর রেয়ার আর্থ উপাদানের মতো খনিজ। মোবাইল ফোনে যেমন এগুলো আছে, তেমনি জ্বালানি পরিবর্তনের বড় স্বপ্নও টিকে আছে ঠিক এই উপাদানের ওপর। সমস্যা হলো চাহিদা আকাশচুম্বী; আর সরবরাহের প্রশ্নে একদম হাঁপিয়ে ওঠার মতো দশা।
সাধারণ একটি গাড়ির তুলনায় একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি বানাতে প্রায় ছয় গুণ বেশি খনিজের প্রয়োজন পড়ে। উপকূলীয় বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পে লাগে গ্যাস টারবাইনের তুলনায় নয় গুণ বেশি। ফলে খনিজ নিয়ে প্রযুক্তিশীল দেশগুলোর নতুন হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, পরিষ্কার জ্বালানির জন্য ১৮ ধরনের খনিজ তাদের কাছে ‘গুরুত্বপূর্ণ’, কারণ এগুলোর সরবরাহ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যুক্তরাজ্যও ১৮টি খনিজকে গুরুত্বপূর্ণ বলেছে, কিন্তু তাদের তালিকা যুক্তরাষ্ট্রের থেকে ভিন্ন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) আবার আরও বড় তালিকা বানিয়েছে, তাদের হিসাবে ৩৪টি খনিজ গুরুত্বপূর্ণ।
তবে কারো তালিকাই শতভাগ আলাদা নয়। পরিষ্কার জ্বালানির জন্য সবচেয়ে জরুরি খনিজের (লিথিয়াম, কোবাল্ট, নিকেল, তামা) ওপর সবারই প্রায় একই গুরুত্ব, দুশ্চিন্তাও একই। এসব খনিজ ছাড়া শক্তির পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব?
আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (আইইএ) আগাম জানিয়েছে, বিশ্ব যদি ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিট-শূন্যে যেতে চায়, তাহলে ২০৪০ সালের মধ্যে এখনকার তুলনায় কমপক্ষে ছয় গুণ বেশি বিরল খনিজ লাগবে। কিন্তু সমস্যা হলো যত খনি আছে বা যেগুলো শুরু করার পরিকল্পনা আছে, সেগুলো দিয়ে এই চাহিদা কোনোভাবেই পূরণ হবে না। ২০৩০ সালেই বিশ্বে চাহিদার চেয়ে নিকেলের পরিমাণ ৬০ শতাংশের নিচে আর লিথিয়ামের ৩৫ শতাংশ ঘাটতি দেখা দেবে। ২০২৩ সালের শুরুতেই এই পূর্বাভাস দিয়েছিল সংস্থাটি।
এর বড় বাধা হলো সময় আর বিনিয়োগ। নতুন খনি খুঁজে বের করা থেকে খনিজ তোলা শুরু করতে এক দশকেরও বেশি সময় লাগে। এদিকে পর্যাপ্ত পরামর্শ না পাওয়া ও পরিবেশগত কারণে অনেক জায়গায় স্থানীয় মানুষ খনির বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। এতে প্রকল্প আরও দেরি হয়, এমনকি বন্ধও হয়ে যায়।
দামের ওঠানামাও পরিস্থিতি জটিল করে তুলছে। একসময় ব্যাটারি খনিজের দাম খুব বাড়লেও ২০২৩ সালে আবার দাম পড়ে যায়, বিশেষ করে চীনে বৈদ্যুতিক বাহনের (ইভি) চাহিদা কমায়।
দাম কমা ভালো মনে হলেও, এতে খনি কোম্পানিগুলোর লাভ কমে যায়, ফলে তারা কাজ ধীর করে দেয় বা নতুন প্রকল্প স্থগিত করে। সব মিলিয়ে সরবরাহ শৃঙ্খলের ভঙ্গুরতা এখন বিশ্বব্যবস্থার বড় মাথাব্যথা।
বিরল খনিজ উৎপাদন এখনও মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেশের হাতেই কেন্দ্রীভূত, যদিও বিশ্বের আরও অনেক অঞ্চলে বিশাল মজুত পড়ে আছে। দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা ও চিলিকে ঘিরে থাকা ‘লিথিয়াম ত্রিভুজে’ বিশ্বের প্রায় ৬০ শতাংশ লিথিয়াম মজুত রয়েছে। এর মধ্যে বলিভিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিচিত লিথিয়াম ভান্ডারের দেশ, কিন্তু বিস্ময়করভাবে এর বেশিরভাগ এখনও অব্যবহৃতই রয়ে গেছে।
অন্যদিকে আফ্রিকা বিশ্বের মোট গুরুত্বপূর্ণ খনিজের প্রায় ৩০ শতাংশ ধরে রেখেছে; যেমন কোবাল্ট, তামা, ম্যাঙ্গানিজ, লিথিয়াম, প্ল্যাটিনাম প্রচুর পরিমাণে আছে। কিন্তু মহাদেশটিতে খনি অনুসন্ধান ও বিনিয়োগ তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় এগুলো পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এ কারণে জিম্বাবুয়ের মতো কয়েকটি দেশ এখন খনিজের নিজস্ব উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, যাতে স্থানীয় মূল্য সংযোজন বাড়ে এবং বৈশ্বিক বাজারেও তারা শক্ত অবস্থান নিতে পারে।
তবে এখন খনিজ সংগ্রহের প্রতিযোগিতা এতটাই বেড়েছে যে দেশগুলো শুধু ভূপৃষ্ঠেই নয়, গভীর সমুদ্র, চাঁদ, এমনকি মহাকাশের গ্রহাণু থেকেও খনিজ আহরণ করতে চায়।
গভীর সমুদ্রে খনি মানে হলো সমুদ্রের তলদেশ থেকে ভ্যাকুয়াম মেশিনের মতো করে খনিজ টেনে তোলা। সেখানে ম্যাঙ্গানিজ, নিকেল, কোবাল্ট আর বিরল ধাতু প্রচুর থাকে, যেগুলো ইভি ব্যাটারির মূল উপাদান।
কিন্তু সমস্যা হলো এই ধারণা খুব বিতর্কিত। কারণ এই গভীর সমুদ্রের পরিবেশ সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। আর সেখানে খনন শুরু হলে দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে, যা থামানোও কঠিন হবে। ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন দাঁড়ায়, প্রকৃতি আর ভবিষ্যৎকে বাজি রেখে এই দৌড় কতটা টেকসই হবে?
খনি মানেই শুধু আর্থিক লাভ নয়, সঙ্গে থাকে পরিবেশ বিপর্যয়, নদী দূষণ, বন উজাড়, আর আদিবাসী সম্প্রদায়ের জমি দখলের দীর্ঘ ইতিহাস। প্রচলিত খনন পদ্ধতি অনেক সময় দূষণ, বন ধ্বংস আর স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক নিয়ম থাকা সত্ত্বেও অনেক জায়গায় খনির কারণে আদিবাসীদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়। ২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের অর্ধেকের বেশি বিরল খনিজ প্রকল্প আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জমির ওপর বা আশেপাশে অবস্থিত।
এখানে বড় প্রশ্ন হলো শক্তি পরিবর্তনের নামে কি আমরা আবারও একই অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি করব?
সরবরাহ শৃঙ্খল নিয়ে এখন কঠোর নজরদারি চলছে। ‘গ্লোবাল ব্যাটারি অ্যালায়েন্স’ বা ‘সোলার স্টুয়ার্ডশিপ ইনিশিয়েটিভ’-এর মতো উদ্যোগ খনিকে ন্যায্য করার চেষ্টা করছে।
স্বচ্ছতা ও যথাযথ পরিশ্রমের কাঠামোগত মান নির্ধারণে সহায়তা করছে। জাতিসংঘ দায়িত্বশীল খনিজ উন্নয়নের নীতিমালা তৈরি করছে। প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহারেও মনোযোগী হওয়ার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে পানির ব্যবহার কমাতে নতুন লিথিয়াম নিষ্কাশন পদ্ধতি, আর সোডিয়ামণ্ডআয়ন ব্যাটারি- যেগুলো ভবিষ্যতে লিথিয়ামের ওপর চাপ কমাতে পারে।
বৈশ্বিক জ্বালানি পরিবর্তন কতটা ঠিক পথে এগোচ্ছে- তা নির্ধারণের সময় এখনো হয়নি। কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছানোর এই পথ মোটেও মসৃণ নয়। খনিজ দরকার, খুব দরকার- তবে তা যেন ন্যায্যভাবে, স্বচ্ছভাবে এবং পরিবেশের ক্ষতি কমিয়ে উত্তোলিত হয়। আমরা যত বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হচ্ছি, তত বেশি টের পাচ্ছি অগ্রগতি কখনোই শুধু ইতিবাচক পথ নয়; ভূগর্ভস্থ কাঠামোও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ব যদি সত্যিই পরিচ্ছন্ন শক্তির যুগে যেতে চায়, তবে খনিজ উত্তোলনের পুরোনো কৌশল বদলাতেই হবে। প্রযুক্তি, নীতি, ন্যায় সবকিছুর সমন্বয় না ঘটলে নতুন সবুজ বিশ্বও শেষমেশ পুরোনো ভুলের ওপর দাঁড়াবে।
বাংলাদেশের মতো দেশ এখনো সরাসরি বিরল খনিজ উত্তোলনের প্রতিযোগিতায় নেই। কিন্তু জ্বালানি আমদানি, বৈদ্যুতিক যানবাহন, সৌর প্রযুক্তি সব ক্ষেত্রেই বিশ্ববাজারের এই অস্থিরতা আমাদের মাথার উপর তাপ বাড়াবে। তাই বৈশ্বিক খনিজ রাজনীতির দিকে আমাদের চোখ খোলা রাখা এখন সময়ের দাবি। কারণ শক্তির ভবিষ্যৎ এখন আর তেল-গ্যাসে সীমাবদ্ধ নয়, এটি খনিজ সম্পদের নতুন ভূ-রাজনীতি। আর এই জিওপলিটিক্সে পিছিয়ে থাকলে ভবিষ্যতে চোখে সরষে ফুল দেখা ছাড়া উপায়ই-বা কী!
সৈয়দ মুহাম্মদ আজম
মিডিয়া, কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগ, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ