প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশের সড়কগুলো এখন আর শুধু যাতায়াত করার পথ নেই- এটি যেন ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে ভয়াবহ এক মৃত্যুর ফাঁদে। প্রতিদিন সংবাদমাধ্যম খুললেই চোখে পড়ে নতুন নতুন দুর্ঘটনার তালিকা, মৃত্যুর তালিকায় প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন কোনো নাম, প্রতিদিনই কোনো না কোনো পরিবারে নেমে আসছে শোক এবং অন্ধকার। বেপরোয়া গতি, চালকের অবহেলা, আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং যানবাহনের অযাচিত প্রতিযোগিতা- সব মিলিয়ে সড়কে মৃত্যু যেন স্বাভাবিক ঘটনার মতো গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যাচ্ছে। এই ভয়ানক বাস্তবতা আমাদের মধ্যে প্রশ্নের সৃষ্টি করে- জীবনের মূল্য কি এতই কম? অসচেতনতার পাশাপাশি যোগ হচ্ছে গতি নামক উন্মাদনার। বাংলাদেশের সড়কব্যবস্থায় যে ‘গতি নামক উন্মাদনা’ ছড়িয়ে পড়েছে, তা কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। অধিকাংশ বাস, ট্রাক, সিএনজি, প্রাইভেট কার, অটোরিকশা সড়কে এমনভাবে চলে যেন রাস্তায় দৌড় প্রতিযোগিতা চলমান! যাত্রী তোলার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা, গন্তব্যে আগে পৌঁছানোর প্রতিযোগিতা, ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা- যানবাহনের চালকরা মানুষের জীবনের চেয়ে অতি সামান্য সময় বাঁচানোকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় কারণ হলো যানবাহনের প্রয়োজনের অতিরিক্ত গতি, যা প্রায় ৫০ ভাগ মৃত্যুর জন্য দায়ী। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো- এই গতিকে থামানোর মতো কোনো শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা নেই আর নেই কোনো কার্যকর জরিমানা বা শাস্তি।
আমাদের দেশে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আইন তো আছে, কিন্তু সেই আইনের তেমন কোনো প্রয়োগ নেই। ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যাও বলতে গেলে নগন্য আবার সেই স্বল্পসংখ্যক ট্রাফিক পুলিশও সুবিধাবঞ্চিত এবং অনেক সময়ই প্রযুক্তিহীন। যেখানে উন্নত দেশগুলোতে স্পিড ক্যামেরা, ডিজিটাল মনিটরিং, স্বয়ংক্রিয় জরিমানা ব্যবস্থার মাধ্যমে গতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সেখানে আমাদের দেশ এখনও ম্যানুয়াল চেকিংয়ের উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও ফিটনেসবিহীন যানবাহন অবাধে রাস্তায় চলাচল করছে , প্রতিদিন অসংখ্য অদক্ষ চালক স্টিয়ারিং ধরছেন এবং নির্দ্বিধায় গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলস্বরূপ সড়কে প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। আবার, দুর্ঘটনার পর বিচার কার্যক্রম এত ধীর গতির এবং অনিশ্চিত হয় যে দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান খুব কম ক্ষেত্রেই শাস্তির আওতায় যায়। ফলে তারা আবারও রাস্তায় ফিরে আসে এবং স্টিয়ারিং-এ হাত রাখে। অতঃপর আবারও ঘটে দুর্ঘটনা- এই চক্র চলতেই থাকে।
অনেক সড়কই নির্মাণশৈলির দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, অপরিকল্পিত বাঁক, পর্যাপ্ত সাইনেজের অভাব, ভাঙাচোরা রাস্তা, রাতের আলোহীন দীর্ঘ সড়ক। এসব সড়কে গতি বাড়ালে দুর্ঘটনা অনিবার্য। বিশেষ করে, মহাসড়কে ওভারটেকিং লেনের অভাব, খোলা ট্রাক ও লরি বহরের চাপ, পথচারীদের পারাপারের জন্য নিরাপদ ব্যবস্থা না থাকা, এসব দুর্ঘটনার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। সড়কে অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাব মৃত্যুর সংখ্যাকে প্রতিদিনই বৃদ্ধি করছে এক কথায়। এছাড়াও গণপরিবহনে ডিউটির সময়সীমা প্রায়ই অনিয়ন্ত্রিত। রাতজেগে দীর্ঘসময় অবধি গাড়ি চালানো, পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নেওয়া, কাজের চাপ এবং প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ চালকদের মানসিক স্থিতি নষ্ট করছে। এতে তারা অনিবার্যভাবেই প্রতিনিয়ত ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, আচরণগত নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন এবং দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছেন। অন্যদিকে, বেশিরভাগ চালকই সঠিক প্রশিক্ষণ কিংবা লাইসেন্স ছাড়াই রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছেন- যা জীবনের সঙ্গে সরাসরি খেলার সমতূল্য।
সড়কে এই মৃত্যু নামক মহামারি বন্ধ করতে হলে কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যকীয়-
কঠোর আইন প্রয়োগ : স্পিড ক্যামেরা, স্বয়ংক্রিয় জরিমানা, ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম চালু করতে হবে।
চালকের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা : লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়ন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
নিরাপদ অবকাঠামো : মহাসড়কে ওভারটেকিং লেন, জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভার ব্রিজ, সাইনেজ বাড়াতে হবে।
গণপরিবহনের প্রতিযোগিতা বন্ধ : কাউন্টারভিত্তিক সময় নির্ধারণ থাকুক কিংবা না থাকুক চালকেরা কখনোই গতি বাড়িয়ে ছুটবে না, এরকম বিধিনিষেধ জারি করতে হবে।
জনসচেতনতা : পথচারী ও যাত্রীদেরও নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে আরও সচেতন করে তুলতে হবে এবং এ নিয়ে সেমিনারের আয়োজনও করতে হবে।
সড়কের প্রতিটি মৃত্যু নিছক কোনো দুর্ঘটনাই নয় শুধু- এটি যেন আমাদের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। প্রতিদিন যে বাবা ও ভাই কাজে বের হয়ে আর ঘরে ফিরে আসেন না, যে মা ও বোন বাসায় পৌঁছানোর আগেই পথে জীবন হারিয়ে ফেলেন, যে শিশুর বইভর্তি স্কুলব্যাগ আর কখনো কাঁধে উঠবে না- এই মৃত্যুগুলো শুধু একটি শিরোনামেই আবদ্ধ নয়, এগুলো আমাদের সামাজিক অবহেলার রক্তমাখা দলিলও বটে। আমরা যখন গতি নামক উন্মাদনায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি, তখন ভুলে যাচ্ছি- এক সেকেন্ডের বেপরোয়া গতি কারও কারও আজীবনের শোক হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্র যদি আইন প্রয়োগে কঠোর না হয়, সমাজ যদি সচেতন না হয়, আর চালকেরা যদি দায়িত্ববোধ না শেখে- তাহলে এই সড়ক আমাদের ভবিষ্যৎকেও কঠিনভাবে গ্রাস করবে। প্রতিটি নাগরিকের জীবনই মূল্যবান, প্রতিটি প্রাণহানি আমাদের জাতির তথা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। তাই এখনই সময় সড়ককে নিরাপত্তার জায়গায় ফিরিয়ে আনার এবং সেসব ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার, যে অগ্রাধিকার মানুষের জীবনকে রক্ষা করে। জীবনের মূল্য সবচেয়ে বড়, গতি নয়। গতি কমলে শুধু গাড়িই ধীরে চলে না, বেঁচে যায় অগণিত প্রাণ।
তাসনিয়া তাবাচ্ছুম
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ