প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫
বিশ্ব এখন এমন এক সময়ের মধ্যে প্রবেশ করেছে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন আর কোনো তাত্ত্বিক বা দূরবর্তী বিষয় নয়। এটি মানবসভ্যতার অস্তিত্বের জন্য সরাসরি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমান তাপপ্রবাহ, অনিয়মিত বৃষ্টি, হিমবাহের দ্রুত গলন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান এবং প্রকৃতির বিভিন্ন অস্বাভাবিক পরিবর্তন পৃথিবীকে যেন প্রতিটি মুহূর্তে সতর্কবার্তা দিচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রা, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অর্থনীতি এবং সামাজিক কাঠামো সবকিছুই এই পরিবর্তনের প্রভাবে ক্রমশ ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। ঠিক এমন এক সময়ে ব্রাজিলের আমাজন বনের কেন্দ্রস্থল বেলেমে অনুষ্ঠিত হলো কপ-৩০। বৈশ্বিক নেতারা, পরিবেশবিদরা, সাংবাদিকরা এবং সাধারণ মানুষ এই সম্মেলনের দিকে তাকিয়েছিল আশার আলো নিয়ে। এই সম্মেলনকে নিয়ে ছিল উচ্চ প্রত্যাশা। ভৌগোলিক অবস্থান, পরিবেশগত গুরুত্ব এবং বৈশ্বিক সংকটকে একত্রিত করে কপ-৩০ এর সামনে ইতিহাস গড়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু বৈঠক শেষে স্পষ্ট হয়ে গেল যে প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির ফারাক চরম রকমের বড়।
সম্মেলনের শুরুতেই চূড়ান্ত ঘোষণাপত্র নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। জীবাশ্ম জ্বালানি, যা পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ানোর প্রধান দায়ী, তার নামও চুক্তিতে উল্লেখ হয়নি। এটি শুধু রাজনৈতিক সমঝোতার দুর্বলতা নয়, বরং বৈশ্বিক জলবায়ু ন্যায়বিচারের প্রতি এক ধরনের উপহাস। এমন পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছিল, পৃথিবী যখন রেকর্ড ভাঙা তাপমাত্রায় কাঁপছে, তখন বৈশ্বিক নেতারা রাজনৈতিক স্বার্থে নিজেদের সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে আটকা পড়ে আছে। বেলেমের চুক্তিতে প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবধর্মী দিকনির্দেশনা ছিল না। দেশগুলোর কাছে বলা হয়েছে, তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় আগের চুক্তির সিদ্ধান্তগুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। কিন্তু এটি বাধ্যতামূলক নয়। অর্থাৎ প্রতিটি দেশ নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করতে পারবে এবং সুবিধাজনক পথে এগোতে পারবে। ইউরোপীয় কূটনীতিকরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন জীবাশ্ম জ্বালানির অবসান নিয়ে বাধ্যতামূলক সিদ্ধান্ত আনার। কিন্তু তেল-উৎপাদনকারী দেশগুলোর চাপ, চীনের কূটনৈতিক অবস্থান এবং যুক্তরাষ্ট্রের নীরবতা সব মিলিয়ে এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণে দেখা যায় যে এই চুক্তি তেল-নির্ভর দেশগুলোর জন্য বিজয় হলেও পৃথিবীর জন্য তা দুঃসংবাদ।
জলবায়ু ক্ষতির শিকার দেশগুলো চেয়েছিল ক্ষতিপূরণ তহবিল এবং অভিযোজন খাতে তহবিল তিনগুণ বৃদ্ধি। চূড়ান্ত নথিতে ২০৩৫ সালের মধ্যে অন্তত তিনগুণ বৃদ্ধি করার আহ্বান থাকলেও এটি বাধ্যতামূলক নয়। এমন অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি আগে বহুবার এসেছে, কিন্তু বাস্তবে কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে সেটি এখনও প্রশ্নের মধ্যে। বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপ এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য এই অনিশ্চয়তা নতুন হতাশা তৈরি করেছে। সম্মেলনের মাঝখানে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ড পুরো আয়োজনের গুরুত্বকে প্রভাবিত করেছে। প্যাভিলিয়ন বন্ধ থাকায় আলোচনায় অংশগ্রহণ কমে যায়। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বৈঠকে অংশ নিলেও মনোযোগ কম ছিল, যা সম্মেলনের ফলাফলের প্রভাবকেও সীমিত করে। বৈশ্বিক সংকটের আলোচনায় মানুষের আগ্রহ কমে যাওয়া একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। সত্ত্বেও কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছে। জলবায়ু ও স্বাস্থ্য খাতে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে। খাদ্য অপচয় ২০৩০ সালের মধ্যে অর্ধেক কমানোর লক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। আমাজনের আট দেশের বন উজাড় থামানোর ২০৩৫ সালের লক্ষ্য ঘোষিত হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নতুন দেশ যুক্ত হয়েছে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ভর্তুকি কমানোর অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এই উদ্যোগগুলো বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে কতোটা কার্যকর হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সংশয় রয়েছে।
চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল সীমিত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিঃসরণকারী দুই দেশই এবার কার্যকর নেতৃত্ব দেখাতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি চীন পূরণ করতে পারেনি। চীনের চাপেই একটি বাক্য চুক্তিতে যুক্ত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের বাধা দিতে নিরুৎসাহিত করে। এটি প্রমাণ করে, বৈশ্বিক রাজনীতির মূল কেন্দ্র এখনও অর্থনীতি, পরিবেশ নয়। বড় দেশগুলো পরিবেশ রক্ষার নামে এমন পদক্ষেপ মেনে নিতে রাজি নয় যা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আশার আলো জ্বালিয়েছে আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তারা তাদের ভূমি রক্ষার বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছে। এই অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণ হয় যে প্রকৃতি রক্ষার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি প্রায়শই স্থানীয় ও আদিবাসী জ্ঞানেই নিহিত। আমাজনের হৃদয়ে দাঁড়িয়ে তাদের বার্তা বৈশ্বিক পরিবেশ আন্দোলনে শক্তিশালী প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।
কিন্তু বড় প্রশ্ন থেকে যায়, পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে। জাতিসংঘের সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ শতকের শেষে তাপমাত্রা বাড়বে প্রায় ২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই বৃদ্ধি শুধু সংখ্যা নয়। এটি কৃষি ধস, খাদ্য সংকট, ভয়াবহ বন্যা, আবাদি জমির ক্ষয়, হিমবাহহীন পৃথিবী এবং মানবসভ্যতার অস্তিত্ব সংকটের ইঙ্গিত। কপ-৩০ দেখিয়েছে, বিশ্ব এখনও ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। ক্ষতিগ্রস্ত ও দায়ী দেশের মধ্যে দূরত্ব আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বড় দেশগুলো এখনও জ্বালানি বাজারকে আগলে রেখেছে। পৃথিবীর ভবিষ্যৎ যারা সবচেয়ে বেশি রক্ষা করতে চায়, তারা সবচেয়ে দুর্বল। যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে, তাদের কাছে শক্তির মোটা চাবি।
পরবর্তী সম্মেলন বসবে তুরস্কে, কপ-৩১। সেখানে হয়তো নতুন সিদ্ধান্ত আসবে এবং ইতিহাস লেখা হতে পারে। কিন্তু পৃথিবী কি এতটা অপেক্ষা করতে পারবে? বিজ্ঞানীরা বলছেন না। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মাস, প্রতিটি বছর আমাদের সময় কমিয়ে দিচ্ছে। শেষ কথাটি খুব সহজ। যদি বিশ্ব নেতারা সিদ্ধান্ত না নেন, পৃথিবী নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে। সেই সিদ্ধান্ত মানবজাতির জন্য কখনই সুখকর হবে না। কপ-৩০ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে এবং পৃথিবীর ধৈর্যের সীমা ক্রমেই সরু হয়ে আসছে। আমাদের কাছে আর অপেক্ষার সুযোগ নেই, সিদ্ধান্ত নেওয়া এখনই অত্যাবশ্যক। মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ এখন এই সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে।
সুদীপ্ত শামীম
কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক